আবরার খুনী ২০ মেধাবীর ফাঁস
কোর্ট রিপোর্টার : আবরার খুনের বদলায় ২০ মেধাবীর ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। এ রায় একটা নজির হয়ে থাকবে দীর্ঘদিন।বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়ে ২০ আসামির ফাঁসির রায় দিয়েছে আদালত। এই রায়কে নজির হিসেবে উল্লেখ করলেও সন্তুষ্টির কিছু নেই বলে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানিয়েছেন। ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু জাফর কামরুজ্জামান বুধবার দুপুরে আলোচিত মামলাটির রায় ঘোষণা করেন। জানান, ২৫ আসামির সবাই দোষী। এর মধ্যে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন বিচারক।রায়ের পর ট্রাইব্যুনালের প্রধান পাবলিক প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজলের বলেন, প্রতিক্রিয়ার কিছু নাই। অনেকগুলো মেধাবী ছাত্রের ফাঁসির আদেশ হলো, তাতে সন্তষ্টির কিছু নাই। তবে এটা একটি নজির হিসেবে থাকবে।
আর যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিপীড়নের শিকার কাউকে না হতে হয়, এই শিক্ষা স্মরণীয় হয়ে যাতে থাকে এ জন্য বিজ্ঞ আদালত এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের জন্য সর্বোচ্চসংখ্যক এবং সর্বোচ্চ শাস্তির আদেশ দিয়েছে। ভবিষ্যতে যেন আর কোনো মেধাবী ছাত্রকে র্যাগিং করে অত্যাচারিত হয়ে হত্যার শিকার হতে না হয় তার জন্য এই রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বিচারিক আদালতের রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ তিনি বলেন, আজকের মামলায় যে রায় হলো, তা যেন উচ্চ আদালতে বহাল থাকে এবং দ্রুত কার্যকর হয়। তাহলে আবরারের আত্মা শান্তি পাবে। আমি এই কামনাই করি।
একই কথা বললেন আববারের মামা মোফাজ্জল হোসেন, আমি অবশ্যই আশা করছি বিচারিক আদালতে যে রায় দেয়া হয়েছে উচ্চ আদালতে তা বহাল থাকবে। রায় বহাল না থাকার ব্যাপারে আমাদের কোনো আশঙ্কা নেই। রায়ে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন আসামি তোহা, মাজেদ, ও মুজাহিদের আইনজীবী রেজাউল করিম সরকার। উচ্চ আদালতে যাবেন বলেও জানালেন তিনি। এই আইনজীবী বলেন, আদালত যা ভালো মনে করেছেন তাই করেছেন। আমরা এই রায় নিয়ে উচ্চ আদালতে যাব। উচ্চ আদালতে গেলে আমাদের আসামি খালাস পাবেন। কারণ মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সন্দেহাতিতভাবে প্রমাণিত হয়নি। মামলার এজাহার থেকে শুরু করে সবকিছু যথাযথভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হয়নি। তাই আসামিরা উচ্চ আদালতে গেলে খালাস পাবে।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আকাশ হোসেনের আইনজীবী সাহাবুদ্দীন মোল্লা বলেন, আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় অভিযোগ গঠন করে সাজা দেয়া যায় না। কারণ আবরারকে হত্যা করার জন্য কেউ মারপিট করেনি। তাকে প্রথম যে মেরেছে দ্বিতীয় জনের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। চড়থাপ্পড় মেরে চলে গেছে পরে আরেক জন এসে মেরেছে। এভাবেই একপর্যায়ে সে অক্সিজেনের অভাবে স্ট্রোক করে মৃত্যুবরণ করেছে।
বিচারক বলেন-
আলোচিত মামলাটির রায় দিতে বুধবার বেলা ১১টা ৫৭ মিনিটে বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান এজলাসে আসন গ্রহণ করেন। এর আগে বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে আসামিদের কাঠগড়ায় তোলা হয়। বেলা ১১টা ৫৮ মিনিটে আসামিদের নাম ধরে হাজিরা ডাকা হয়। দুপুর ১২টা ১ মিনিটে রায় পড়া শুরু হয়। এ সময় কাঠগড়ায় আসামিরা বিমর্ষচিত্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
রায়ে বিচারক কামরুজ্জামান বলেন, ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাত ৯টা থেকে ৭ তারিখ ভোর পর্যন্ত আবরারকে নির্মমভাবে রড, ক্রিকেট স্টাম্প, স্পিনার দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, যা ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত অধ্যায় বলে মানুষের মনে প্রতিফলিত হয়ে আছে। দণ্ডবিধির ৩০২, ৩৪, ১০৯ ধারায় সকল আসামির জোরালো সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। মামলার ঘটনা প্রমাণিত হয়েছে।
এ সময় ভারতের উচ্চ আদালতের দেয়া কয়েকটি মামলার নজির টেনে বিচারক বলেন, এ জাতীয় ঘটনায় আসামিদের সর্বোচ্চ সাজার নজির সৃষ্টি করা প্রয়োজন রয়েছে। আসামিরা নির্মমভাবে একজন মেধাবী ছাত্রকে হত্যা করেছে। তাকে অহেতুক শিবির সন্দেহে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এরপর ২০ আসামির মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচ আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সংক্ষিপ্ত রায় পড়ে শোনান বিচারক।
আমি ২৫ জনেরই পিতা-
রায়ের সময় আদালত প্রাঙ্গণে দেখা যায় আসামিদের স্বজনদের। তবে কেউ তাদের পরিচয় প্রকাশ করছিলেন না।স্বজনদের একজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া আসামি মোয়াজ আবু হোরায়রার বাবা। প্রিজন ভ্যানের পাশে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেন, আমি ২৫ জনেরই পিতা।
মোয়াজের বাবার দাবি, কোনো প্রমাণ ছাড়াই তার ছেলেকে সাজা দেয়া হয়েছে।
রায়ে যাদের ফাঁসি-
বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল (সিই বিভাগ, ১৩তম ব্যাচ), তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অনিক সরকার ওরফে অপু (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন ওরফে শান্ত (কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৫তম ব্যাচ), উপসমাজসেবা সম্পাদক ইফতি মোশারফ সকাল (বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), সাহিত্য সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির (ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৬তম ব্যাচ), ক্রীড়া সম্পাদক মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং, ১৫তম ব্যাচ), সদস্য মুজাহিদুর রহমান ওরফে মুজাহিদ (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সদস্য হোসেন মোহাম্মদ তোহা (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), সদস্য মুনতাসির আল জেমি (এমআই বিভাগ), সদস্য এহতেশামুল রাব্বি তানিম (সিই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), উপদপ্তর সম্পাদক মুজতবা রাফিদ (কেমিকৌশল), মোর্শেদ ওরফে মোর্শেদ অমর্ত্য ইসলাম (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মাজেদুল ইসলাম ওরফে মাজেদ (এমএমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), খন্দকার তাবাখ্খারুল ইসলাম ওরফে তানভীর (মেকানিক্যাল, ১৭তম ব্যাচ), শামীম বিল্লাহ (মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), এ এস এম নাজমুস সাদাত (এমই বিভাগ, ১৭তম ব্যাচ), মিজানুর রহমান ওরফে মিজান (ওয়াটার রিসোর্সেস, ১৬তম ব্যাচ), মাহামুদ সেতু (কেমিকৌশল) ও শামসুল আরেফিন রাফাত (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং), মাহমুদুল জিসান (ইইই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ)।তাদের সবার বয়স ২৪ থেকে ২০-এর মধ্যে। তাদের মধ্যে এহতেশামুল, জিসান ও রাফিদ পলাতক। আর প্রথম এজাহারের বাইরে ছিলেন তিনজন- মিজানুর রহমান, মাহামুদ সেতু ও শামসুল আরেফিন।
যাবজ্জীবন-যাদের
আইনবিষয়ক উপসম্পাদক অমিত সাহা (সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং), ছাত্রলীগের গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সম্পাদক ইসতিয়াক আহমেদ মুন্না (মেকানিক্যাল, তৃতীয় বর্ষ), সদস্য আকাশ হোসেন (সিই বিভাগ, ১৬তম ব্যাচ), সহসভাপতি মুহতাসিম ফুয়াদ (১৪তম ব্যাচ, সিই বিভাগ) ও মোয়াজ আবু হোরায়রা (সিএসই, ১৭ ব্যাচ)।তাদের বয়স ২১ থেকে ২৩ বছরের মধ্যে। আর তাদের মধ্যে মুন্না প্রথম এজাহারের বাইরে ছিলেন।আবরারকে যে রাতে হত্যা করা হয়, তার পরদিন ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর তার বাবা ১৯ শিক্ষার্থীকে আসামি করে চকবাজার থানায় মামলা করেন। তদন্তে নেমে পুলিশ এজাহারের ১৬ জনসহ মোট ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে।
পাঁচ সপ্তাহ তদন্ত করে তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পরিদর্শক ওয়াহিদুজ্জামান ওই বছর ১৩ নভেম্বর ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যে অভিযোগপত্র জমা দেন, সেখানে আসামি করা হয় মোট ২৫ জনকে।অভিযোগপত্র গ্রহণ করে গত ১৮ নভেম্বর পলাতক চার আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে আদালত। তাদের মধ্যে একজন পরে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে মামলাটি পরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ বদলির আদেশ দেয়া হয়। বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে মামলাটির বিচারকাজ শুরু করেন।২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু হয়।