চিরদিন দিন তোমারিত থাকবো
বিশেষ প্রতিনিধি : চিরদিন দিন তোমারিত থাকবো…এ ধরনের কালজয়ী শত শত গানের শ্রষ্ঠা লতা মঙ্গেশকরের চীর বিদায়ে দক্ষিণ এশিয়ায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি লতার জন্যে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। ভারতের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর টানা ২৮ দিন ধরে লড়াই করে অবশেষে মৃত্যুর কাছে হার মেনেছেন। আজ রোববার সকালে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। তার মৃত্যুতে আচমকাই যেন থমকে গেছে গোটা সুরের দুনিয়া। চারিদিকে এক নিশ্চিত নিস্তব্ধতা আর স্বজন হারানোর হাহাকার।
১৩ বছর বয়সে বাবাকে হারানো লতা মঙ্গেশকর ভাইবোনদের আগলে রেখেছিলেন আমৃত্যু। মা সুধামতি সে সময় দিশেহারা হয়ে পড়েন। বাধ্য হয়েই পরিবারের হাল ধরেন ছোট্ট লতা। শূন্য থেকে শুরু করে নিজের প্রতিভা দিয়ে হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি গায়িকা। তাঁর কিন্নর কণ্ঠের গান শুনে প্রেমে পড়েছেন লাখো পুরুষ। কিন্তু সেই লতাই কখনো কারও সঙ্গে জড়ালেন না। করলেন না বিয়ে, গড়লেন না আলাদা কোনো পরিবার।
যতীন মিশ্রর বই লতা সুর গাথায় লতা বলেছেন, ‘প্রায়ই রেকর্ডিং করতে করতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়তাম আমি আর ভীষণ খিদে পেত আমার। তখন রেকর্ডিং স্টুডিওতে ক্যানটিন থাকত। নানা রকম খাবার পাওয়া যেত কি না, সে বিষয়ে আমার মনে নেই। তবে চা-বিস্কুট খুঁজে পাওয়া যেত, তা বেশ মনে আছে। সারা দিনে এক কাপ চা আর দু-চারটে বিস্কুট খেয়েই কেটে যেত। এমনও দিন গেছে, যেদিন শুধু জল খেয়ে সারা দিন রেকর্ডিং করছি, কাজের ফাঁকে মনেই আসেনি যে ক্যানটিনে গিয়ে কিছু খাবার খেয়ে আসতে পারি। সারাক্ষণ মাথায় এটাই ঘুরত—যেভাবে হোক নিজের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে আমাকে।
লতার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ছোট বোন আশা ভোঁসলের জন্য। ঠিক এভাবে না বলে, বলা যায়— আশাকে ভালোবেসেই পড়াশোনা ছেড়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। চার বছরের ছোট বোন আশা বড় বোনকে খুব ভালোবাসতেন। চোখের আড়াল হতে দিতে চাইতেন না। বড় বোনও তাই ন্যাওটা আশাকে রাখতেন কাছে কাছে। স্কুলে যাওয়ার সময়ও বোনকে নিয়ে যেতেন সঙ্গে করে। কয়েক দিন বিষয়টি খেয়াল করার পর স্কুল কর্তৃপক্ষ বোনকে বাসায় রেখে স্কুলে আসার নির্দেশ দেয়। সেটা মানতে না পেরে নিজেই স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেন।
আর সেই বোনের সঙ্গেই বেশ কয়েক বছর কথা বলেননি লতা মঙ্গেশকর! আশা নিজেও নামকরা গায়িকা। উঠতি বয়সে প্রেম করে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেন গনপতি রাও ভোঁসলেকে। আশার সেই বিয়ে সুখের হয়নি। বোনের সঙ্গে সেই অভিমান ঘোঁচে আশার সঙ্গে গনপতি রাওয়ের বিচ্ছেদের পর। দুই সন্তান নিয়ে বাড়িতে ফেরার পর কথা না বলে এড়িয়ে যেতে পারেননি লতা।
লতা মঙ্গেশকরের বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর তাঁর মেয়েদের বিষয়ে ছিলেন ভীষণ রক্ষণশীল। মেয়েদের শাস্ত্রীয় সংগীতে উৎসাহ দিতেন। কায়দা করে পোশাক পরা, বেশি সাজগোজ (স্নো-পাউডার মাখা) পছন্দ করতেন না। এমনকি নিজের নাটকের দলের পরিবেশনা থাকলেও রাত করে সেটা সন্তানদের দেখতে যাওয়া পছন্দ করতেন না। সন্তানদের রুচি তৈরিতে বেশ কঠোর ছিলেন তিনি। কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী লতা মঙ্গেশকর ২৫ হাজারের বেশি গান করেন ৭ দশক ধরে।
লতা বলেন, ‘বাবা আমাদের সিনেমা দেখতে যাওয়াও পছন্দ করতেন না। তবে ব্যতিক্রম ঘটত শুধু মারাঠি নির্মাতা ভালজি পেনঢারকার ও ক্যালকাটা নিউ থিয়েটারসের সিনেমা এলে। বাবা মনে করতেন, তাদের সিনেমায় ভালো গল্প হয়, সংগীত আয়োজনও ঠিক থাকে।ছোটবেলা থেকেই তাই নিজেদের রুচিটা তৈরি হয়েছিল বলে মনে করেন মঙ্গেশকরের সন্তানেরা।
কিংবদন্তি গায়িকা লতা মঙ্গেশকর কেন বিয়ে করলেন না আজীবন? তিনি কি কাউকে ভালোবাসতেন? আজীবন চেষ্টা করেছেন ব্যক্তি লতাকে লুকিয়ে রাখতে, তাই এই প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর মেলেনি। তবে বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি নাম চর্চিত হয়েছে লতার সঙ্গে। বইয়ে উঠে এসেছে লতার জীবনের নানা কথা।
ছোটবেলা থেকেই লতা মঙ্গেশকর কিংবদন্তি গায়ক কে এল সয়গলকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন। এটার একটা কারণও ছিল। সে সময় লতাদের বাড়িতে সিনেমার গান বলতে শুধু সয়গলের গানই শোনার অনুমতি ছিল। কারণ, লতার বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর নিজেও পছন্দ করতেন সয়গলের গান। সেই শ্রদ্ধা থেকেই ছোট্ট লতার মন পড়ে ছিল সয়গলে। লতা মঙ্গেশকর: ইন হার ওউন ভয়েস বইতে উঠে এসেছে তার সবিস্তার, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি সয়গল সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাইতাম। বাড়িতে বলতাম, আমি যখন বড় হব তখন সয়গলকে বিয়ে করব। বাবা শুনে বলতেন, “তুমি বড় হতে হতে সয়গল তো বুড়ো হয়ে যাবে।” বলতাম, সে বুড়ো হলেও আমি বিয়ে করতে চাই।’
সয়গলের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের কখনো দেখা হয়নি। তবে সয়গলের স্ত্রী আশা রানি ও তাঁর সন্তানদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন লতা মঙ্গেশকর। সে সময় সয়গলের পরিবারের কাছ থেকে তাঁর ব্যবহৃত একটি আংটি উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন লতা। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে লতার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে একসময় কম কথা হয়নি। তবে সব জল্পনায় পানি ঢেলে লতা মঙ্গেশকর হেমন্তকে ভাইয়ের আসনেই রেখেছিলেন। হেমন্তের পরিবারের সঙ্গেও দারুণ সম্পর্ক ছিল তাঁর।
সাবেক বিসিসিআই (বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া) প্রেসিডেন্ট রাজ সিং দুঙ্গারপুর আর লতা মঙ্গেশকরের মধ্যে কি আদৌ কোনো প্রেম ছিল? বিভিন্ন সূত্রের দাবি, ছিল। এবং নিজেদের প্রেম পরিণতি না পাওয়ায় দুজনের কেউই আর বিয়ে করেননি। তাঁদের প্রেমে বাধা কী ছিল? কেন এক হলো না চার হাত? এখানে বড় বাধা ছিল রাজ সিং দুঙ্গারপুরের পরিবার। লতা মঙ্গেশকর ও রাজ সিং দুঙ্গারপুর কী শুধুই বন্ধু ছিলেন?
রাজস্থানের রাজ পরিবারের ছেলে রাজ সিং। এদিকে লতা ভারতের কিংবদন্তি গায়িকা হলেও রাজ পরিবারের নিয়ম রক্ষায় রাজ পরিবারের বাইরের কাউকে বিয়ে করতে পারেননি রাজ। দুজন যেহেতু দুজনকে অনেক ভালোবাসতেন, তাই আজীবন ভালো বন্ধুই থেকে গেছেন। ২০০৯ সালে আলঝেইমারে আক্রান্ত হয়ে চিরতরে বিদায় নেন রাজ সিং। লতা মঙ্গেশকরকে তিনি ভালোবেসে ডাকতেন ‘মিঠু’ নামে। লতা মঙ্গেশকরের ভাই হৃদয়নাথের সঙ্গে বন্ধুত্বের সুবাদেই মঙ্গেশকর পরিবারে যাতায়াত ছিল রাজের। সেখান থেকেই লতার সঙ্গে পরিচয় ও প্রেম।
মুঝে ভুলা না পাওগে-
ভারতের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী লতা মঙ্গেশকরের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল রোববার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্কে সর্বস্তরের জনগণের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন শেষ সেখানেই তার দাহকাজ সম্পন্ন হয়। এর আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন শ্রেনী পেশার বিশিষ্ঠজনরা তাকে শ্রদ্ধা জানান।
সন্ধ্যা ৭টায় লতার ‘মুঝে ভুলা না পাওগে…’ গানের মধ্যে দিয়েই চোখের জলে শেষবিদায় জানানো হয় গুণী এই কণ্ঠশিল্পীকে। ভক্ত-অনুরাগীরা বলছেন, পার্থিব শরীরে না থাকলেও লতা মঙ্গেশকর তার প্রতিটি গানের মধ্য দিয়ে বিশ্বের অসংখ্য মানুষের হৃদয়ে থেকে যাবেন।