শিপস্টোরের শতকোটি ধান্ধা
বিশেষ প্রতিনিধি/চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিনিধি : নাবিকদের শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা মদ-বিয়ার পাচার করে শত কোটি টাকার অবৈধ বানিজ্যে করছে শিপ স্টোরের মালিকরা। প্রকাশ্য দিবালোকে চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে অবস্থিত ৬টি শিট স্টোরের মালিকরা দীর্ঘদিন ধরে এই বানিজ্য করে লুটে নিয়েছে শত কোটি টাকা। অবৈধ টাকায় এই চক্রটি কাস্টমসকেও বস করে অবৈধ কাজ চালাচ্ছে। মোটা অংকের বখরার বিনিময়ে এই চক্রের সহযোগী কাস্টমসের একশ্রেনীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা।
এই চক্র নাবিকদের নামের বিদেশী মদ বিয়ার বিক্রি করে দিচ্ছিল ঢাকা ও চট্টগ্রামের মদের বার গুলিতে। দীর্ঘদিন ধরে কাস্টমসের সহযোগীতায় এই অপকর্ম চললেও এবার এনবিআর বাগড়া দিয়েছে অবৈধ চক্রের বিরুদ্ধে। কাস্টমস জানায়, শিপস্টোরের মদ খোলাবাজারে বিক্রি বন্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এজন্য ‘শিপ স্টোরগুলো’কে (সমুদ্রগামী জাহাজের পণ্যসামগ্রী বিপণন কেন্দ্র) নজরদারির আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এতে ডিপ্লোমেটিক বন্ডেড ওয়্যারহাউজের আদলে এসব স্টোরকেও সফটওয়্যারে আমদানি-বিক্রির তথ্য দিতে হবে। এত কার নামে মদ বিয়ার বিক্রি হচ্ছে তা লিপিবদ্ধ থাকবে। এর ফলে মদ বিয়ার পাচার অসম্ভব হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন কাস্টমস কর্তারা। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই সফটওয়্যার তৈরির কাজ শুরু হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
জানা গেছে, ‘শিপ স্টোরস’হচ্ছে এক ধরনের ওয়্যারহাউজ। যেখান থেকে সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিক-ক্রুরা নিজেদের ব্যবহার্য সামগ্রী কিনতে পারেন। এসব স্টোরে জাহাজের যন্ত্রপাতি, যন্ত্রাংশ, পেইন্ট, বার্নিশ, কেমিক্যাল, জ্বালানি, লুব্রিকেন্ট, নাবিক-ক্রুদের জন্য মদ-বিয়ার, সিগারেট, ওষুধ বিক্রি হয়। দেশে ৬টি শিপ স্টোর আছে। এগুলো হচ্ছে-চট্টগ্রাম বন্দরে বেলাজিও লিমিটেড, পোর্টল্যান্ড সার্ভিসেস, সি ওয়েজ বন্ডেড ওয়্যারহাউজ, পোর্টল্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল, হারবার্ট সন্স (বিডি) ও মোংলা বন্দরে বেলাজিও লিমিটেড। এর মধ্যে ৪টিকে গত অর্থবছরে ১৯ লাখ ৮০ হাজার ডলারের পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়।
সূত্র জানায়, উচ্চ শুল্ক থাকায় বৈধভাবে দেশে মদ-বিয়ার আমদানির পরিমাণ একেবারেই সামান্য। অভিজাত ক্লাব, বারগুলোর আমদানি অনুমতি থাকলেও কেউ আনছে না। অভিযোগ আছে, নাবিকদের ব্যবহৃত মদ-বিয়ার, সফট ড্রিকংস একটি চক্র এসব ক্লাব, বারে সরবরাহ করছে। তাই ডিপ্লোমেটিক বন্ডের মতো শিপ স্টোরগুলোর কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য গত ৩১ জানুয়ারি এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে শিপ স্টোরস পরিচালনা ও লাইসেন্স প্রদান নীতিমালার খসড়া নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় এনবিআর চেয়ারম্যান শিপ স্টোরগুলোকে মনিটরিং (নজরদারি) করার জন্য সফটওয়্যার বানাতে কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন।
জানা গেছে, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বৃদ্ধির কারণে প্রতি অর্থবছরই চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দরে জাহাজ আগমনের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ দুই সমুদ্র বন্দরে ৩ হাজার ৮৬৬টি জাহাজ আসে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৪ হাজার ৫৭৬টি, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪ হাজার ৬০২টি, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ হাজার ৭৩৪টি ও ২০২০-২১ অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ৫৪২টি জাহাজ বন্দরে ভিড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় জাহাজের নাবিক ও ক্রুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। সূত্র জানায়, বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে শুল্কমুক্ত বিপণিবিতান পরিচালনায় নীতিমালা থাকলেও সমুদ্রবন্দরগুলোয় শিপ স্টোর পরিচালনায় কোনো নীতিমালা নেই।
সংশ্লিষ্ট বন্ড কমিশনারেট বা কাস্টম হাউজগুলো শর্ত পূরণ সাপেক্ষে লাইসেন্স দিয়ে থাকে। সে অনুযায়ী প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়। এগুলো মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে স্থলবন্দরের শুল্কমুক্ত বিপণিবিতানের মতো নীতিমালা প্রণয়ন করার কাজ চলছে।এনবিআরের সদস্য (শুল্ক রপ্তানি ও বন্ড) হোসেন আহমেদ বলেন, এতদিন নীতিমালা ছাড়াই শিপ স্টোরগুলো কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। তাই এগুলোকে মনিটরিংয়ের আওতায় আনতে একটি খসড়া নীতিমালা করা হয়েছে। পরে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনাক্রমে সেটি বাস্তবায়ন করা হবে।
নতুন লাইসেন্সের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এনবিআরে আবেদন করতে হবে। এক্ষেত্রে আবেদনকারী যেসব পণ্য বিক্রি করবেন সেগুলো বিদেশে ক্রয়-বিক্রয়ে ৫ বছরের অথবা দেশে ন্যূনতম ১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানে টার্নওভার ন্যূনতম ২ কোটি টাকা থাকতে হবে। একজন বন্ড অফিসার (সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা) সামগ্রিক কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করবে। এজন্য শিপ স্টোরে অফিস কক্ষ রাখতে হবে। কর্মকর্তা আমদানি (ইন টু বন্ড) ও বিক্রয়ের (এক্স বন্ড) তথ্য ওই কর্মকর্তা রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করবে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, শিপ স্টোরস কর্তৃপক্ষ ওয়্যারহাউজে রক্ষিত সব পণ্যের নিরাপত্তা দেবে। পণ্য নষ্ট বা হারিয়ে গেলে বন্ডার দায়ী থাকবে। অফিস সময়ের বাইরে বন্ডার ও বন্ড কর্মকর্তার যৌথ স্বাক্ষরে সিলগালার মাধ্যমে শিপ স্টোরস বা ওয়্যারহাউজ তালাবদ্ধ রাখতে হবে। বন্ড অফিসারের উপস্থিতি ছাড়া সিলগালাকৃত স্টোর বা ওয়্যারহাউজ খোলা যাবে না। সমুদ্রবন্দরে আগত বা বহির্গামী আন্তর্জাতিক জাহাজের একজন ক্যাপ্টেন বা ক্রু একক আগমন বা বহির্গমনে সর্বোচ্চ ৫০০ ডলারের পণ্য কিনতে পারবেন। তবে একদিনে আড়াইশ ডলারের বেশি পণ্য কিনতে পারবে না। বন্দর ত্যাগের সময় দেশি-বিদেশি নাবিক বা ক্রুরা ২ হাজার ডলারের পণ্য কিনতে পারবে।
এতে আরও বলা আছে, হালনাগাদ অডিট ও নবায়ন না থাকলে প্রতিষ্ঠানকে আমদানি প্রাপ্যতা দেয়া হবে না। রাজস্ব ফাঁকি প্রমাণিত হলে অথবা ভয়-ভীতি, মিথ্যা অভিযোগ, বলপ্রয়োগ বা অন্যায় সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে কাস্টমস-কর্মচারীকে প্রভাবিত করলে লাইসেন্স সাময়িক স্থগিত বা বাতিল করা হবে। এছাড়া আমদানি-রপ্তানি পণ্যের চালান সম্পর্কে মিথ্য ঘোষণা উদঘাটনের ক্ষেত্রে কাস্টমসকে সহযোগিতা না করলে এবং নিরীক্ষা বা তদন্তের স্বার্থে তথ্য না দিলেও লাইসেন্স বাতিল বা স্থগিত করার বিধান রাখা হয়েছে নীতিমালায়।