সোনারগাঁওয়ে পাতিল কেলেংকারি
বিশেষ প্রতিনিধি : এবার ৫ তারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ের পাতিল কেনা নিয়ে তোলপাড় চলছে। জানা গেছে, হাঁড়ি-পাতিল কিনতে দুবাই ইস্তাম্বুল যাচ্ছেন সোনারগাঁওয়ের এমডিসহ চার কর্মকর্তা। এরা দুবাই তুরস্ক ভ্রমণ করে দেখে শুনে ভাল হাড়ি পাতিল কিনবেন। জমজমাট এ কেলেংকারি এখনো চলমান। অভিযোগ উঠেছে, রান্নাঘরের হাঁড়ি-পাতিল কিনতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই এবং তুরস্কের ইস্তাম্বুল যাচ্ছেন সোনারগাঁও হোটেলের (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) এমডিসহ আরও তিন কর্মকর্তা।
সফর নিশ্চিত করতে দলে যোগ দিয়েছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিব। সরকারি মালিকানাধীন পাঁচ তারকা হোটেল সোনারগাঁওয়ের মেইন কিচেনের (মূল রান্নাঘরের) সংস্কার করার জন্য ৩০ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ ছিল। কাজটি করার জন্য সোনারগাঁও হোটেল পরিচালনাকারী সরকারি বাণিজ্যিক সংস্থা হোটেলস ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড (হিল) কার্যাদেশ দেয় স্থানীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইন্টেরিয়রস-অ্যাকম জেবিকে।
কিচেনের যন্ত্রপাতি তুরস্ক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আনা হবে। যন্ত্রপাতির গুণগত মান, নির্মাণশৈলী এবং প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শনের (পিএসআই) জন্য তুরস্কের প্রস্তুতকারক কোম্পানি উকজেন এন্ডাস্ট্রিয়েল উরুনলার সান (Ucgen Endustriyel Urunler San) গত বছর ৫ অক্টোবর আমন্ত্রণপত্র পাঠায়। উকজেন ঠিকাদার ইন্টেরিয়রস-অ্যাকম জেবি নিয়োজিত উৎপাদনকারী সংস্থা। ঠিকাদারের সঙ্গে হিলের সম্পাদিত চুক্তির কন্ডিশন অব কন্ট্রাক্টে দুই দেশ ভ্রমণের সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ভ্রমণের ব্যয় ঠিকাদারেরই বহন করার কথা রয়েছে চুক্তিতে।
ভ্রমণের অনুমোদনের জন্য গত ৩ ফেব্রুয়ারি হিল থেকে প্রস্তাব পাঠানো হয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে এ ভ্রমণের অনুমোদন দিয়েছে এবং সরকারি আদেশ (জিও) জারি হয়েছে। যে চার কর্মকর্তাকে ভ্রমণের অনুমোদন দেওয়া হয় তারা হলেন হিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. আমিনুর রহমান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিবের পিএস এএইচএম জামেরি হাসান, হিলের ম্যানেজার (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) মো. এরশাদুল হক এবং প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও ঢাকার টেকনিক্যাল সার্ভিস ডিরেক্টর মো. আবুল বাশার খান।
অভিযোগ উঠেছে, রান্নাঘরের আধুনিক মানের চুলা, হাঁড়ি-পাতিল, খুন্তি বা অন্যান্য যেসব জিনিসপত্র দেখার জন্য প্রতিনিধিদল দুই দেশ যাচ্ছে তারা ওই দেশে যাওয়ার আগেই কার্যাদেশের ৭০ ভাগ মালামাল জাহাজে তুলে দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই তা হোটেল কর্তৃপক্ষের বুঝে নেওয়ার কথা।
হিলের বা সোনারগাঁও হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. আমিনুর রহমান বলেন, আমরা যাব কিচেনের যন্ত্রপাতির গুণগত মান পরীক্ষার জন্য। এ কাজে সরকারের কোনো অর্থ ব্যয় হবে না। আপনারা যেসব জিনিস দেখতে যাবেন তা ইতিমধ্যেই দেশে এসে পৌঁছেছে বলে জানা যাচ্ছে। বিষয়টি কি সত্যএ প্রশ্নে বিব্রত বোধ করেন হিলের এমডি। প্রসঙ্গটি নিয়ে পরে কথা বলবেন বলে জানালেও তিনি পরে আর কথা বলেননি।
এর আগে গত বছর ১১ নভেম্বর এ ভ্রমণের আরও একটি জিও জারি হয়েছিল। তখন সফরের টিম লিডার ছিলেন হিলের সচিব (সরকারের যুগ্ম সচিব) মো. আলতাফ হোসেন। তিনি সম্প্রতি পেট্রোবাংলায় বদলি হয়েছেন। এ কারণে ভ্রমণটি শেষ করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। ১১ নভেম্বরের আগেও একবার এ ভ্রমণের জিও বদল করতে হয়েছিল। জিও করার আগে আলতাফ হোসেন ছিলেন সরকারের উপসচিব। জিও জারি হওয়ার পর ভ্রমণের আগেই তিনি যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পান। এ কারণে জিও বদলে আলতাফ হোসেনের পদবি ঠিক করতে হয়েছিল।
আলতাফ হোসেন বদলি হয়ে যাওয়ার কারণে টিম লিডার হয়েছেন হিলের এমডি আমিনুর রহমান। দলটি ১২ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি অথবা ভ্রমণের তারিখ থেকে ৯ দিন তুরস্ক ও দুবাই অবস্থান করতে পারবে। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন, জিও জারির পরও গতকাল পর্যন্ত দলটি ঢাকা ত্যাগ করেনি।
হিলের প্রস্তাবে বারবার বলা হয়েছে এ ভ্রমণে কর্মকর্তাদের আসা-যাওয়া বাবদ বিমান ভাড়া, হোটেলসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় ঠিকাদার বহন করবেন। এ বিষয়ে হোটেলস ইন্টারন্যাশনাল কিংবা সরকারের কোনো আর্থিক সংশ্লেষ নেই। কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও ঢাকার একজন কর্মকর্তা জানান, আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এ ভ্রমণে সরকারের কোনো আর্থিক সম্পৃক্ততা নেই। কিন্তু বাস্তবেও কি তাই? আসলে তা নয়। এ চার কর্মকর্তাকে দুই দেশ ভ্রমণ করিয়ে আনতে ঠিকাদারদের কমপক্ষে ৩০ লাখ টাকা খরচ হবে। যদি তাদের এ ভ্রমণে না নিতে হতো তাহলে সরকারের মোট ব্যয় ৩০ লাখ টাকা কম হতো। ঠিকাদার প্রাক-জাহাজীকরণ পরিদর্শনের সুযোগ রাখে কর্মকর্তাদের এ ভ্রমণে নিয়ে খুশি করার জন্য। এতে ঠিকাদারের ব্যবসা ঠিক থাকে, কর্মকর্তারাও খুশি থাকেন। পরবর্তী কাজ পেতে কোনো সমস্যা হয় না।
৩০ কোটি টাকার কিচেনসামগ্রী নেগোসিয়েটেড প্রাইস, যা হিলের ৪০৭তম বোর্ড সভায় অনুমোদন হয়েছে বিষয়টি জানিয়ে হোটেলের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, গত দুই বছর হোটেলের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর ইনক্রিমেন্ট হয়নি। মহামারীর দোহাই দিয়ে কারও একটি টাকা বেতন বাড়েনি। সরকারের অন্য কোনো সংস্থার বেলায় কি এ ঘটনা ঘটেছে? গত দুই বছর ধরে হোটেলটি লোকসান দিলেও এর আগের ৩৮ বছর লাভ করেছে। এখনো হোটেলের অ্যাকাউন্টে ৩০০ কোটি টাকা জমা রয়েছে। গত ১০ বছর ধরে হোটেলটিতে কোনো নতুন কর্মী নিয়োগ হয় না। এসব বিষয়ে কোনো সমাধান নেই। সবাই রয়েছেন যার যার তালে।১৯৮১ সালে শুরু করা হোটেলটির অনেক কিছুই ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছিল। এরই মধ্যে এর সব অতিথি কক্ষ, স্যুট, প্যাসিফিক লাউঞ্জ, বলরুম, হেলথ ক্লাব, বার, সুইমিংপুল আধুনিকায়ন করা হয়েছে। এখন যেসব অংশ সংস্কার করা দরকার তার মধ্যে মেইন কিচেন অন্যতম।