আজ আল্লাহর কাছে যা চাইবেন তাই পাবেন
মাওলানা মুহাম্মদ মুনিরুল হাছান : শবে বরাতকে যে নামেই ডাকা হোক, মূল বিষয় এক ও অভিন্ন, যা কোরআনের আয়াত ও অসংখ্যা সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের রহমত, বরকত ও মাগফিরাত লাভের জন্য বছরের যে কয়েকটি রাতকে আলাদা বৈশিষ্ট্যপূর্ণ করে দিয়েছেন লাইলাতুল বরাত সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতকে বলা হয় ‘লাইলাতুল বরাত’। আরবি হিসাবে ১৫ শাবানের রাত। হাদিসের ভাষায় একে বলা হয় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’। উপমহাদেশে এটি ‘শবে বরাত’ নামে প্রসিদ্ধ। ফার্সি ভাষায় ‘শব’ অর্থ রাত আর ‘বরাত’ অর্থ মুক্তি। শবে বরাতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর অসংখ্য বান্দাকে ক্ষমা করেন, সেজন্য একে মুক্তির রাত বলা হয়। এ রাতকে লাইলাতুল মুবারাকা অর্থাৎ বরকতময় রাত, ‘লাইলাতুস সাক’ তথা পুরস্কারের সনদপ্রাপ্তির রাতও বলা হয়ে থাকে। (তাফসির কুরতুবি : ১৯/৯৯-১০৩)
শবে বরাত সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘সুস্পষ্ট কিতাবের শপথ, নিশ্চয়ই আমি এটিকে বরকতময় রাতে অবতীর্ণ করেছি। আমি তো সতর্ককারী। এই রাতে বণ্টন করে দেওয়া হয় প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়।’ (সুরা দুখান : ১-৩)। বিখ্যাত তাবেয়ি ইকরামা (রা.) ও একদল মুফাসসিরের মতে লাইলাতুম মুবারাকা বা বরকতময় রাত হলো শাবানের মধ্যরাত। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) আয়াতের তাফসিরে বলেন, ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ হলো শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত। আর সেটাই লাইলাতুল বারাত।’ (তাফসিরে দুররে মানসুর : ৭/৪০১)
শবে বরাতের ফজিলত সম্পর্কে অনেক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিতÑ নবীজি (সা.) বলেছেন, যখন অর্ধ শাবানের রাত আসে তোমরা এ রাতকে ইবাদত-বন্দেগিতে অতিবাহিত করো এবং দিনে রোজা রাখো। কেননা এই রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হয়ে বলেন, ‘কোনো ক্ষমাপ্রার্থী আছে কি? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। রিজিক প্রার্থনা করার কে আছে? যাকে আমি রিজিক প্রদান করব। কে বিপদগ্রস্ত আছে? আমি বিপদমুক্ত করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত মানুষের প্রয়োজনের কথা বলে আহ্বান করতে থাকেন।’ (ইবনে মাজা : ১৩৮৮)। আরবের বিখ্যাত আলেম শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানী (রহ.) এ হাদিসের সমর্থনে আরও সাতটি হাদিস উল্লেখ করে বলেন, এসব রেওয়ায়েতের মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে এই হাদিসটি নিঃসন্দেহে সহিহ প্রমাণিত হয়। (সিলসিলাতুল আহাদিসিস সহিহা : ৩/১৩৫)
আল্লাহর রাসুল (সা.) এ রাতে বিশেষ ইবাদতে নিমগ্ন হতেন। নফল নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত, কবর জিয়ারত ইত্যাদি আমলে ব্যস্ত থাকতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি এক রাতে উঠে দেখি নবীজি (সা.) ঘরে নেই। তখন আমি তাকে খুঁজতে ঘর থেকে বের হয়ে বাকিতে (মদিনার কবরস্থান) পেয়েছি। তিনি আমাকে বললেন, তুমি কি ভয় করো যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসুল তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! মূলত তা-ই নয়। বরং আমি মনে করেছি, আপনি আপনার অন্য কোনো স্ত্রীর কাছে এসেছেন। তখন নবীজি (সা.) বললেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে প্রথম আসমানে অবতীর্ণ হন এবং কালব গোত্রের বকরির সমুদয় পশমের চেয়েও বেশি গুনাহ ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি : ৭৩৯; ইবনে মাজা : ১৩৮৯)
বিখ্যাত তাবেয়ি খালিদ বিন মাদান, মকহুল, লোকমান বিন আমের (রহ.) প্রমুখ প্রসিদ্ধ তাবেয়িরা মধ্য শাবানের রাতকে সম্মান করতেন এবং এতে স্বাভাবিক অভ্যাসের চেয়েও বেশি ইবাদত-বন্দেগি করতেন। (লাতায়েফুল মায়ারিফ : ২৬২)। তাবেয়ী আতা ইবনে ইয়াসার (রহ.) বলেন, ‘লাইলাতুল কদরের পর শাবানের পঞ্চদশ রাত অপেক্ষা উত্তম রাত আর নেই।’
ইমাম শাফেয়ি (রহ.) বলেন, বছরের পাঁচটি রাতে দোয়া কবুল হয়। জুমার রাত, দুই ঈদের দুই রাত, অর্ধ শাবানের রাত এবং রজব মাসের প্রথম রাত। (কিতাবুল উম্ম : ২/৪৮৫)। ইমাম ইবনে নুজাইম মিসরি (রহ.) বলেন, রমজানের শেষ দশকের রাত, দুই ঈদের রাত, জিলহজের প্রথম দশকের রাত, অর্ধ শাবানের রাতে ইবাদত করা মুস্তাহাব। কারণ এর সপক্ষে অসংখ্যা হাদিস বর্ণিত হয়েছে। (আল বাহরুর রায়েক : ২/৫৬)। নবীজি, সাহাবি ও তাবেয়িদের আমল দেখে সে যুগের মক্কার লোকেরাও শবে বরাতে রাতভর ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন।
শবে বরাতে মক্কার অধিবাসীদের আমল সম্পর্কে আল্লামা আবু বকর ফাকেহী (২১৭-২৭৫ হিজরি) বলেন, অতীতকাল থেকে আজ পর্যন্ত আহলে মক্কার বা মক্কাবাসীর আমল ছিলÑ অর্ধ শাবানের রাতে সাধারণ মানুষেরা মসজিদুল হারামের উদ্দেশে বের হতো। তারা নামাজ আদায় করত, তওয়াফ করত এবং সারা রাত ইবাদত-বন্দেগিতে অতিবাহিত করত। এমনকি সকাল পর্যন্ত কোরআন তেলাওয়াত, খতমে কোরআন এবং নামাজের মাধ্যমে অতিবাহিত করত। নামাজের মধ্যে তারা প্রতি রাকাতে সুরা ফাতিহা এবং দশবার সুরা ইখলাস পড়ত। তারা জমজমের পানি পান করত, তা দিয়ে গোসল করত এবং অসুস্থদের জন্য জমা করে রাখত। উদ্দেশ্য ছিল এই রাতের বরকত হাসিল করা। (আখবারে মক্কা : ৩/৮৪)
তবে বিশেষ এ রাতেও কিছু মানুষ রহমত-বরকত থেকে বঞ্চিত হন। কিছু কিছু এমন গুনাহ রয়েছে তা তওবা ছাড়া মাফ হবে না। মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) ইরশাদ করেছেন- আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহিহ ইবনে হিব্বান : ৫৬৬৫)বরাত রাতে করণীয় হলো নফল নামাজ আদায় করা, কোরআন তেলাওয়াত করা, তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করা, তওবা-ইস্তেগফার করা, দরুদ শরিফ পাঠ করা, জিকির-আজকারে নিয়োজিত থাকা, কবর জিয়ারত করা, দান-সদকা করা এবং পরের দিন রোজা পালনসহ ইত্যাদি ইবাদতে মশগুল থাকা।
হজরত ওমর ইবনে আবদুল আজিজ (রহ.) নিজেই এই রাতে ইবাদত করতেন এবং অন্যদেরকেও ইবাদত-বন্দেগি করার জন্য নির্দেশ দিতেন। একদা তিনি বসরার গভর্নরের উদ্দেশে চিঠি দিয়ে জানালেন যে, তারা যেন লাইলাতুল বরাতে বিশেষ ইবাদত করে। একদা তিনি নিজে এই রাতে নামাজ আদায়কালে সেজদা থেকে মাথা উত্তোলন করে দেখতে পেলেন একটি সবুজ কাপড়ের টুকরো যার থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়ে আসমানের সঙ্গে মিলিত হয়েছে। ওই টুকরোর মধ্যে লেখা ছিল মহাপরাক্রমশালীর পক্ষ থেকে এটি তাঁর বান্দার জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তির বার্তা। (রুহুল বয়ান : ৮/৩১১)
শবে বরাত মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুমিন বান্দার জন্য অনেক বড় অনুগ্রহ। এই রাতে ইবাদত-বন্দেগি থেকে দূরে থাকা ঈমানদারের কাজ নয়। পাশাপাশি ইসলামী শরিয়ত বিবর্জিত কুপ্রথা থেকে বেঁচে থাকাও জরুরি। যেমন- আতশবাজি ফোটানো, খেলাধুলায় মত্ত থাকা, ঘরবাড়িতে আলোকসজ্জা করা, মহিলাদের ঘরের বাইরে যাওয়া শরিয়তবিরোধী কাজ এবং অপচয়। এগুলোতে শয়তান বেশি খুশি হয়। অভিশপ্ত শয়তান তার গোপন কৌশলের মাধ্যমে নেক আমলের মধ্যে মন্দ প্রথা ও অপচয়ের মনোবৃত্তি তৈরি করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এবং অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানদের ভাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)লেখক: সিনিয়র শিক্ষক (ইসলাম শিক্ষা) চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজ