গণঅভ্যুত্থানে আমরা গণসংগীত গাইতাম
শাহীন সামাদ : আমি সেই সময় ছায়ানটে। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান থেকেই আমাদের লড়াই শুরু হয়ে যায়। সাংস্কৃতিক জগতের যত বড় বড় এবং মেধাবী মানুষ ছিলেন তাদের পদচারণায় ছায়ানট ছিল মুখরিত। পটুয়া কামরুল হাসান, আলতাফ মাহমুদ, সুজেয় শ্যাম, অজিত রায়, তিমির নন্দী সব কিংবদন্তি আসতেন।ছায়ানটে আমাদের রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীতের পাশাপাশি গণসংগীত শেখানো হতো। আসলে সেখান থেকেই আমরা অনুপ্রেরণা পেতাম।
গণঅভ্যুত্থানের সময় আমরা গণসংগীত করতাম। গানগুলো আমরা বিভিন্ন সমাবেশে গাইতাম। সেটা শহীদ মিনার থেকে শুরু করে পথেঘাটে যেখানেই হোক। তখন তো গণসংগীত একটা বড় প্রতিবাদ ছিল। এক দেশে যখনই কোনো দুর্যোগের ঘনঘটা দেখা দেয়, তখন তার বিরুদ্ধে সবার আগে সাংস্কৃতিক অঙ্গনই সোচ্চার হয়। আমরা তখন যে গানগুলো গাইতাম সেসব গান মানুষের মনে প্রেরণা জোগাত। আর এ গানগুলো গাইতে গাইতে আমার মধ্যেও কেমন জানি একটা তাগিদ অনুভব করতে থাকলাম। আসলে ছায়ানটই আমার অনুপ্রেরণার প্রথম উৎস।
এলো ২৫ মার্চের সেই ভয়াল কালরাত্রি। সেই রাতের কথা আমি এখনো ভুলতে পারি না। কখনো ভুলতে পারবও না। যতদিন বেঁচে থাকব এই দিনটার কথা মনে থাকবে। ওই দিনগুলোর বিদীর্ণ শব্দ এখনো আমার কানে বাজে। চারদিকে আগুন, ধোঁয়া, থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। আমরা সবাই ভেঙে পড়েছিলাম আগত দিনগুলোর কথা ভেবে। আমাদের বাসা তখন লালবাগ কেল্লার উল্টো দিকে। পরদিন যখন কারফিউ ভাঙল, আমার বড় ভাই বাইরে থেকে ঘুরে এসে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থায় অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসেছিল। অনেক পরে সে জানাল যে, চারদিকে শুধু লাশ আর লাশ। সে কী তাণ্ডব! পলাশী, সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে পাকিস্তানি আর্মিদের নৃশংসতার চিহ্ন চারদিকে। আমি সবেমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম। মার্চ মাসে মাত্র কয়েকটা ক্লাস করেছি। আমাদের বিভাগের অধ্যাপক জি সি দেব স্যারকেও মেরে ফেলেছে শুনে কেঁদে ভাসালাম। দৌড়ে ছাদে গিয়ে দেখি, চারদিকে শুধু কালো ধোঁয়া আর কোথাও কোথাও আগুন জ¦লছে।
আমি ভেতরে ভেতরে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি যে যুদ্ধে যাবই, সেটা কাউকে বুঝতেও দিইনি। আমি তো আর বন্দুক নিয়ে যুদ্ধ করতে পারব না, আমার কণ্ঠ আছে, সেটাকেই আমি দেশের জন্য উৎসর্গ করতে পারি। গান ভীষণ শক্তিশালী একটা মাধ্যম। গান দিয়েই আমি যুদ্ধ করব। আর সঙ্গে ৭ মার্চের ভাষণ তো আছেই। আমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল।
ঠিক করলাম কিছু একটা করবই। কিন্তু বাসা থেকে বের হবো কীভাবে। আম্মা তো সারাক্ষণই আমাকে চোখে চোখে রাখছেন। তার চোখকে ফাঁকি দিই কী করে। আমার কলেজের ইংরেজির শিক্ষক জাকিয়া খাতুনের সঙ্গে আমার বন্ধুর মতো সম্পর্ক। আম্মাও ওনাকে খুবই পছন্দ করতেন। উনি বাসায় এলে আম্মা আর আমাকে পাহারায় রাখতেন না। এর মধ্যে উনি এক দিন বাসায় এলে আমি তাকে আমার মনের ইচ্ছেটা জানালাম। কথাটা শুনেই ভয় পেলেন জাকিয়া আপা। বললেন, চারদিকে এমন অবস্থা; তিনি আমাকে নিরুৎসাহিত করলেন।
৭১-এর মে মাসের শেষদিকে। আমাদের বাসার নিচতলায় এক ভাড়াটিয়া থাকতেন। ১২ বছর ধরে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক। তাদের একটাই ছেলে সুজা। আমি তাকে ধরলাম। বললাম আমার ইচ্ছেটার কথা। শুনেই সে বাধা দিল। প্রথমেই না। তাকে অনেক করে বোঝালাম। একপর্যায়ে সে রাজি হলো। বলল, সে নিচের মেইন দরজাটা খুলে রাখবে। আর সেটা যেন কেউ জানতে না পারে। আমি তো খুশি। যোগাযোগ করলাম জাকিয়া আপার সঙ্গে। জানালাম আমার প্ল্যানিং। এরপর সে রাতেই সবাই যখন ঘুমে, আমি এক কাপড়েই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। তারপর তো অনেক কথা। আমার বিয়ে হলো। আমি ঢাকায় থাকলাম তিন দিন। তারপর ভারতের উদ্দেশে রওনা হলাম।
আমরা আসলাম কলকাতার ১৪৪ নম্বর লেনিন সরণির বাড়িতে। সেখানে ‘বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি’ নামে একটা সংগঠন ছিল। তারা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করত। সেই ধারাবাহিকতায় গড়ে ওঠে ‘বাংলাদেশি মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। সেখানে ছিলেন ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, সৈয়দ হাসান ইমাম, মুস্তাফা মনোয়ার, আলী যাকের, লায়লা হাসান, ইনামুল হক, আসাদুজ্জামান নূর, ডালিয়া নওশীনসহ আরও অনেকে। দেখলাম, একটা ঘরের মধ্যে শতরঞ্জি বিছানো, সেখানে বেশ কয়েকজনকে নিয়ে ডালিয়া নওশীন গান শেখাচ্ছেন। আমিও যোগ দিলাম। আমাকে পেয়ে সবাই এতটাই আনন্দিত হলো যে, সত্যি বলতে কি, আমার মধ্যে নিজের পরিবার বা বাসার কোনো চিন্তাই ছিল না। এর আগে পর্যন্ত আম্মাকে নিয়ে একটা চিন্তা সবসময় মাথায় আসত। কিন্তু লেনিন সরণির এ বাড়িতে এসে সব ভুলে গেলাম।
শুরু হলো নতুন করে গানচর্চা। রবীন্দ্র-নজরুল থেকে শুরু করে ডিএল রায়, ফোক, বলা যায় সব ধরনের বাংলা গান। সেই অনুযায়ী আমরা চর্চা করতাম। আমাদের একটা স্ক্রিপ্ট থাকত, যার নাম ছিল ‘রূপান্তরের গান’। সেটাতে ধারাবর্ণনা করতেন সৈয়দ হাসান ইমাম। আর পেছনে ব্যাকগ্রাউন্ড স্ক্রিন বানাতেন মুস্তাফা মনোয়ার। যত দিন গেছে এ বাড়িতে শিল্পীদের সংখ্যা প্রতিনিয়তই বেড়েছে। সবাই যে প্রশিক্ষিত শিল্পী তা না, কিন্তু প্রত্যেকের গলায় যেন সুর ছিল। দেশমাতার মুক্তির জন্য সেই সময়টাতে সবাই যেন শিল্পী হয়ে উঠেছিলেন। আমরা প্রতিদিনই কলকাতার কোথাও না কোথাও প্রোগ্রাম করতাম। তখন আমাদের একটাই উদ্দেশ্য, প্রচুর টাকা জোগাড় করা। যেটা দেশে পাঠানো হবে, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য।
বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পেও আমরা গান শোনাতে যেতাম। তবে এ ক্ষেত্রে আমরা গান বাছাই করতাম অনেক ভেবেচিন্তে। কারণ অধিকাংশ ক্যাম্পেই এ দেশের সহজ-সরল গ্রামের মানুষরা ছিলেন। যারা কঠিন গানগুলো বুঝবেন না। তাই তাদের সহজ বোধগম্য গানগুলোই গেয়ে শোনাতাম। সবাই খুবই খুশি হতেন। এমনও হয়েছে, বৃষ্টি হচ্ছে আর আমরা মাথায় মাচা ধরে গান গাইতাম। পানি জমে গেছে, তারপরও আমরা গান গেয়ে শোনাচ্ছি। আমাদের তখন একটাই উদ্দেশ্য, সবাইকে উৎসাহ দেওয়া। সবার মধ্যে দেশের প্রতি টানটা ধরে রাখা। গান গাইতে ভারতের রাজধানী দিল্লিতেও গিয়েছিলাম। সেখানে সূর্যকন্যা কল্পনা যোশির সাহচর্য পাই। এক মাস ছিলাম। এরপর আবার কলকাতায় ফিরে আসি।
একসময় শ্রদ্ধেয় সমর দাস ‘স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র’ থেকে আমাদের আমন্ত্রণ জানান। আমরা ৮-১০ জনের মতো একটি দল গিয়েছিলাম। তখন আমাদের দিয়ে আটটি গান রেকর্ড করা হয়। এরপর যখন আবার ডাকলেন তখন আমরা জাতীয় সংগীত গেয়ে আসি বেতারকেন্দ্রে। যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে টালিগঞ্জ স্টুডিও থেকে ১৪টি গান রেকর্ড করে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে জমা দিয়ে আসি। সেই গানগুলোই সবসময় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে বাজত।
গত ৫০ বছরে সেদিনের সেই গানগুলো অজস্রবার গেয়েছি, নতুন করে রেকর্ডও করা হয়েছে। যতগুলো রেকর্ড হয়েছে, তার সবগুলোতেই আমার কণ্ঠ আছে। বিভিন্ন জায়গায় সম্মানিত হয়েছি। শ্রোতারা আমাকে মূল্যায়ন করেছেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ফিরেছি। স্বাধীনতার পরপরই আমরা দেশে ফিরতে পারিনি। কারণ তখন ভারতে আশ্রয় নেওয়া লক্ষ লক্ষ বাঙালি বাংলাদেশে ফিরছে। যার ফলে যানবাহনের একটা সংকট দেখা দিল। ফিরে মনটা খারাপ হয়ে গেল। চারদিকে শুধু ধ্বংসস্তূপ। মেনেই নিতে পারছিলাম না। ঢাকায় ফিরেছিলাম সন্ধ্যা নাগাদ। সেদিন আর বাসায় যাইনি। পরদিন সকালে বাসায় ঢুকি মনের মধ্যে এক অজানা আশঙ্কা নিয়ে। সবাই বেঁচে আছে তো? নাকি পাকিস্তানি মিলিটারিরা মেরে ফেলেছে। প্রথমেই দেখা পেলাম আম্মার, উনি তো আমাকে দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। তার ধারণা ছিল, আমি হয়তো মরেই গেছি। কারণ আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগই ছিল না। তারা আমার কোনো খোঁজই পায়নি। লেখক : কণ্ঠযোদ্ধা, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র