শফিক রহমান : অনলাইন জুয়া প্রকাশ্য রুপ নিয়েছে। মোবাইলে ৩ কোটি টাকা লেনদেন করে ধরা পড়েছে এক পল্লী চিকিৎসক। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মিলেছে অনেক রথি মহারধির অনলাইন জুয়ার কানেকশন। যেগুলো খতিয়ে দেখছে সিআইডি। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযান চালায় র্যাব। ওই দিন রাতেই একে একে ওয়ান্ডার্স ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা চিত্তবিনোদন ক্লাব, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র, গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ ক্লাবে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ক্যাসিনোর খোঁজ মেলে। ধারাবাহিক অভিযানের সূত্র ধরে ওই বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট থেকে নামিয়ে আনা হয় অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধানকে।
২০২১ সালের ১৯ মে দেশে নিষিদ্ধ অ্যাপ ‘স্ট্রিমকার’ পরিচালনায় জড়িত অভিযোগে চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুরিশ জানায়, লাইভ ভিডিও ও চ্যাট আপে সুন্দরী তরুণীদের সঙ্গে আড্ডার লোভ দেখিয়ে লোকজনকে টেনে নিয়ে অনলাইন জুয়ার ফাঁদে ফেলা হতো। এর মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে বছরে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে এ চক্র। অনলাইনে এ কার্যক্রম পরিচালনায় বিন্স ও জেমস নামের দুটি ‘ডিজিটাল মুদ্রা’ ব্যবহার করা হতো।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন জমির উদ্দিন, কামরুল হোসেন ওরফে রুবেল, মনজুরুল ইসলাম হৃদয় ও অনামিকা সরকার। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকার বনশ্রী, সাভার এবং নোয়াখালীর সুধারামপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয় বলে পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট (এটিইউ) জানিয়েছে। এটিইউর পুলিশ সুপার (মিডিয়া অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস) মোহাম্মদ আসলাম খান বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা স্ট্রিমকার ব্যবহার করে মুদ্রা পাচার করে আসছিলেন। অ্যাপটিতে গ্রুপ চ্যাট, লিপ সিং, ড্যান্স, গল্প ও কবিতা আবৃত্তিসহ নানা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে সেখানে জুয়া খেলার ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল।
যাহোক, মোবাইল ফোন, প্লে স্টেশন, ট্যাব, ল্যাপটপ ছাড়াও যে কোনো ইলেকট্রনিক্স মাধ্যম দিয়ে চলছে অনলাইন জুয়া। দেশের পাড়া মহল্লায় হাট বাজারে অলি গলিতে প্রকাশ্যই মোবাইলে লুডু, ফ্রি ফায়ার, পাবজি, ক্রিকেট গেম খেলতে দেখা যায়। এসব গেম খেলা চলাকালে বেট ধরা হয়ে থাকে। অনলাইন জুয়ার মূল ডেভেলপার হচ্ছে চীন, হংকং, কোরিয়া, ফিলিপাইন ও ইউক্রেনের মতো কিছু দেশ। এসবের প্রতিরোধে কঠোর নজরদারি বাড়াতে হবে।
এ সম্পর্কে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে র্যাবই প্রথম এটি খুঁজে বের করে। এখনো চলছে নজরদারির মাধ্যমে আমরা ধরছি। তবে এগুলো মূলত বিদেশি ডোমেইন, প্রক্সি সার্ভার বা গেটওয়েতে চলছে। এগুলো বন্ধ করা কঠিন। নজরদারির মাধ্যমে এসব চক্রের প্রতারণা ও অর্থপাচার ধরাছি আমরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন) ব্যবহার করে চালানো হচ্ছে এসব জুয়ার অ্যাপ। অনুমোদনহীন গেটওয়ের মাধ্যমে বন্ধ হওয়া সাইট বা নতুন সাইট ব্রাউজ করে জুয়া খেলা চলছে। অনলাইন ক্যাসিনোর সাইটগুলোর ডোমেইন দেশের বাইরে। নির্ধারিত সময় পর পর এসব সাইটের আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) ঠিকানা পরিবর্তন করে নিয়ন্ত্রণকারীরা। অনেকে প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করে সুনির্দিষ্ট সাইট ব্রাউজ করতে পারছে।
আইপিএল ক্রিকেট ও ফুটবলের ইউরোপিয়ান লীগসহ জনপ্রিয় খেলার সময় বাজির সাইটগুলো বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রলুব্ধ করে। দেশি চক্রগুলো এতে হোস্ট অ্যাকাউন্ট করে লাইভ স্ট্রিমের নামে তরুণীদের দিয়ে ফাঁদ পাতে। এর পর ডিজিটাল মুদ্রায় হাতিয়ে নেয় টাকা। দেশের বাইরে থাকা মূল হোতাদের সঙ্গে দেশীয় এজেন্টরা মিলে এ অপরাধমূলক কাজ করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নজরদারির মাধ্যমে গেটওয়ে এবং প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার বন্ধ করা না গেলে অনলাইন ক্যাসিনো আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। এ জন্য সরকারকে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে বলে জানান তাঁরা।
র্যাবের নজরদারিতে সে সময় জানা যায়, কমপক্ষে ১৫টি চক্র ১৫০টি সাইট থেকে অনলাইন ক্যাসিনোর কারবার করছিল। সেলিম ধরা পড়লে ‘সাইবার থ্রেট ডিটেকশন অ্যান্ড রেসপন্স’ প্রকল্প থেকে ৬৭টি গ্যাম্বলিং সাইট বন্ধ করার তথ্য মেলে। অনলাইনে জুয়া খেলার সাইটগুলো নেট দুনিয়ায় ‘বেটিং সাইট’ নামে পরিচিত। মূলত শিক্ষার্থী, বেকার যুবক ও তরুণরা অনলাইন জুয়ায় বেশি আসক্ত। সাইটগুলোতে অ্যাকাউন্ট খুলে নিবন্ধিত হয়ে ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে চিপস, বিট কয়েন বা অনলাইন মুদ্রা (ডিজিটাল কারেন্সি) কিনতে হয়।
এরপর নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিয়ে জুয়া খেলায় অংশ নিতে হয়। বাংলাদেশে এই জুয়ার বৈধতা নেই। দেশীয় চক্র মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আদান-প্রদান করে থাকে জুয়ার টাকা। পরে আন্তর্জাতিক কার্ড ব্যবহারসহ হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করে।
এর আগে রায়হান হোসেন (২৯) নামে এক যুবককে গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। তিনি বিট কয়েন বিক্রি ও প্রতারণা করে এরই মধ্যে কোটিপতি বনে গেছেন। তাঁর ২৭১টি অ্যাকাউন্টে মাত্র এক মাসে ৩৫ হাজার ডলার লেনদেন হয়েছিল। পাকিস্তান, রাশিয়া ও নাইজেরিয়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলে এই বিট কয়েন কেনাবেচা করতেন রায়হান।
গত বছরের ২৬ অক্টোবর থেকে ২ নভেম্বর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে এসপিসি নামে একটি অ্যাপের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গত ২০ ফেব্রুয়ারি সাতরাস্তা থেকে মাহমুদুর রহমান জুয়েল নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে ডিবি। জুয়েল বিট কয়েন, ইথিরিয়াম, ইউএসডিটি নামে ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচা করতেন। তিনি ‘ব্লক চেইন’, ‘বাইনান্স’ ও ‘কয়েন বেইজ’ নামে তিনটি অ্যাপের মাধ্যমে বিট কয়েনের কারবার করছিলেন।
তদন্তকারীরা জানান, ইউরোপিয়ান ফুটবল লিগ ও আইপিএল ক্রিকেট নিয়ে এখন বেশি বেটিং চলে। ‘বেট ৩৬৫ লাইভ’ নামে এসেছে মোবাইল ফোনের অ্যাপস ভার্সন, যেখানে আইপিএল নিয়ে দেদার চলে জুয়া। এমন কিছু সাইটের ব্যাপারে তথ্য থাকার পরও কিছু সীমাবদ্ধতার জন্য অনলাইন ক্যাসিনো বন্ধে হিমশিম খাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রশাসনের চোখ এড়াতে ক্লাবের ক্যাসিনো বাদ দিয়ে অনলাইন ক্যাসিনোতে মনোযোগ দিয়েছে কিছু চক্র। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনলাইন জুয়ার ১৭৬টি সাইট বন্ধ করেছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। গত দুই বছরে অর্ধশতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর অনলাইনে বেটিংয়ের আদলে ক্যাসিনো চালানোর অনেক তথ্য পেয়েছে র্যাব।
সূত্র জানায়, ভিপিএনসহ কিছু অনুমোদনহীন গেটওয়ের মাধ্যমে বন্ধ হওয়া সাইট বা নতুন সাইট ব্রাউজ করে জুয়া খেলা হয়। সাইটগুলোর ডোমেইন দেশের বাইরে এবং নির্ধারিত সময় পর পর সাইটের আইপি ঠিকানা পরিবর্তন করে নিয়ন্ত্রণকারীরা। বিট কয়েনে লোকসানের কোনো রেকর্ড থাকে না। ফলে কালো টাকার মালিকরা দেদার পাচার করছে টাকা।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ উজ্জল চৌধুরী বলেন, সরকার বিটিআরসির মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু সাইট বন্ধ করেছে। কিন্তু কিছু গেটওয়ে আছে, যেগুলোর নিয়ন্ত্রণ সরকারের কাছে নেই। প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করে কেউ যাতে কোনো সাইটে ঢুকতে না পারে সে জন্য ন্যাশনাল গেটওয়েতে আপডেটেড আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মডেলিং ল্যাংগুয়েজ (এআইএমএল) থাকা প্রয়োজন। সেটা না থাকায় যে কেউ প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করে সুনির্দিষ্ট সাইট ব্রাউজ করতে পারছে। তিনি আরো বলেন, তরুণরা বেটিং গেমের নামে জুয়ায় বেশি ঝুঁকে পড়ছে।