মাউশির নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসকারী ২ বিসিএস ক্যাডার
স্টাফ রিপোর্টার : এবার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে নিয়োগের নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার ও মাউশির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। ৩১ ও ৩৪তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের দুই কর্মকর্তার জড়িত থাকার তথ্য পাওয়ার পর তাদের নজরদারি করা হচ্ছে। এই চক্রটি ৭ থেকে ১০ লাখ টাকায় পরীক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয় পরীক্ষার প্রশ্নের সব উত্তর। চক্রের এক সদস্যের একটি হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ১২ পরীক্ষার্থীর কাছে উত্তর পাঠানোর তথ্য পেয়েছে ডিবি। তাদের বেশিরভাগের বাড়ি পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায়। তবে মাউশির প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটি, নাকি পরীক্ষার কেন্দ্রে বিতরণের সময় এ প্রশ্ন ফাঁস হয় তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি ডিবি। ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে ৩৪তম বিসিএসের সরকারি কলেজের এক শিক্ষক ও ৩১তম বিসিএসের মাউশির এক শিক্ষা অফিসারের জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। তবে তাদের বিষয়ে আরও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।তবে মাউশির প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের দাবি, প্রশ্ন তৈরি ও মুদ্রণের সময় ফাঁস হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেন্দ্রে বিতরণের সময় ফাঁস হতে পারে বলে তাদের ধারণা।ডিবির যুগ্ম কমিশনার (উত্তর) হারুন অর রশিদ বলেন, প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত চারজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করেছি। আরও কিছু লোকের নাম আসছে। এখানে কোনো রাঘববোয়ালকে আমরা ধরব না এমন নয়। যারাই জড়িত থাকবে তাদের আমরা গ্রেপ্তার করব।
গত শুক্রবার রাজধানীর ইডেন মহিলা কলেজ কেন্দ্রে মাউশির অফিস সহকারী-কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার অভিযোগে সুমন জমাদ্দার (৩০) নামে এক পরীক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করে ডিবি তেজগাঁও বিভাগ। তার প্রবেশপত্রের পেছনে প্রশ্নের সব উত্তর লেখা ছিল। এর পরই তদন্তে নেমে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেতে থাকে ডিবি। গতকাল পর্যন্ত মাউশির দুই কর্মচারী ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষকসহ মোট চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবি। তারা হলেন, পটুয়াখালী সরকারি কলেজের বেসরকারি কর্মচারী সুমন জমাদ্দার, পটুয়াখালী খেপুপাড়া বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক (গণিত) সাইফুল ইসলাম, মাউশির উচ্চমান সহকারী আহসান হাবীব, মাউশির অফিস সহকারী মো. নওশাদুল ইসলাম।
প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ইডেন মহিলা কলেজের শিক্ষক আবদুল খালেক বাদী হয়ে রাজধানীর লালবাগ থানায় মামলা করেছেন। এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে পরীক্ষা শুরু হয় বেলা ৩টায়। পরীক্ষার কেন্দ্র থেকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সুমন জমাদ্দার জানান, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বেলা ২টা ১৮ মিনিটে তার মোবাইলে পটুয়াখালীর সাইফুল ও টাঙ্গাইলের খোকন উত্তরপত্র পাঠান। মাউশি সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার ঢাকার ৬১টি কেন্দ্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এদিন ৫১৩টি পদের জন্য পরীক্ষার্থী ছিলেন ১ লাখ ৮৩ হাজার।
ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ইডেন কলেজ কেন্দ্র থেকে গ্রেপ্তার সুমন জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন তিনি শিক্ষক সাইফুলের কাছ থেকে প্রশ্ন পেয়েছেন। চাকরি হলে সাইফুলকে সাত লাখ টাকা দেওয়ার চুক্তি হয়। এ তথ্যের ভিত্তিতে সাইফুলকে গ্রেপ্তার করার পর তিনি জানিয়েছেন, মাউশির এক কর্মচারী তাকে প্রশ্ন দিয়েছে। সাইফুল হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ১২ জন পরীক্ষার্থীকে উত্তর পাঠিয়েছেন বলে প্রাথমিক তথ্য পাওয়া গেছে। তবে ডিবির ধারণা, শতাধিক পরীক্ষার্থীকে চক্রটি উত্তর পাঠিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। চুক্তিবদ্ধ অনেক পরীক্ষার্থীর প্রবেশপত্রও রয়েছে গ্রেপ্তারকৃতদের মোবাইল ফোনে।চক্রটি অনেক বড়। প্রশ্ন প্রণয়ন কমিটিতে যারা ছিলেন তাদের ওপরও নজর রাখা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরীক্ষা কমিটির সদস্য ছিলেন ৫ জন। তারা হলেন মাউশির এক পরিচালক, এক উপপরিচালক, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের এক সদস্য, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন ও মাউশির উচ্চশিক্ষা বিভাগের একজন। এ কমিটির সদস্যরা গত বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টায় মাউশিতে প্রশ্ন প্রণয়ন শুরু করেন। পরদিন বিকেল ৪টার দিকে সেখান থেকে বের হন তারা। তাদের দাবি, প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সময় সেখানে বাইরের কারও ঢোকারও সুযোগ থাকে না আবার বাইরে যাওয়ারও সুযোগ থাকে না। প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হয় ট্রাঙ্কে সিলগালা করে। মাউশির কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিভিন্ন পর্র্যায়ে দায়িত্বে থাকেন।
পরীক্ষা কমিটির প্রধান মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, ‘প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, মুদ্রণ ও বিতরণের কোন পর্যায়ে ফাঁস হয়েছে তা তদন্তের বিষয়। এই মুহূর্তে বলা যাবে না। কারণ কর্মচারীরা বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করেন। কারা জড়িত রয়েছেনসেটি নিশ্চয়ই তদন্তে বেরিয়ে আসবে।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাউশির যে দুই কর্মচারী গ্রেপ্তার হয়েছেন তাদের একজন কেন্দ্রে প্রশ্ন নেওয়ার কাজে জড়িত ছিলেন।চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। গত ২১ জানুয়ারি প্রতিরক্ষা মহাহিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের অধীন ‘অডিটর’ নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় রাজধানী থেকে বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা পরিষদের বর্তমান মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরিনসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর আগে গত বছরের নভেম্বরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান নিখিল রঞ্জন ধরের নাম আসে পুলিশের তদন্তে। এরপর বুয়েট কর্র্তৃপক্ষ তাকে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়। পাশাপাশি তাকে কোনো পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে তার বিরুদ্ধে এখনো কোনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের আরেকটি ঘটনায় বরখাস্ত হওয়া দুই ব্যাংক কর্মকর্তা ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক এক কর্মকর্তার ব্যাংক হিসাবে গত বছর ছয় কোটি টাকা পায় সিআইডি।