মানবাধিকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে নির্বাচন দেখতে চাই: হাস
কূটনৈতিক রিপোর্টার : বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির মূল হচ্ছে মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা, এইসব বিষয়ে কোনো ছাড় দিবে না যুক্তরাষ্ট্র। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য এই বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদেরকে মানবাধিকার আইন মেনে চলতে হবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকার কূটনৈতিক বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন ডিকাব টকে অংশ নিয়ে মঙ্গলবার (৩১ মে) এমন মন্তব্য করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। ডিকাব সভাপতি রেজাউল করিম লোটাসের সঞ্চালনায় এবং সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মঈন উদ্দিনের স্বাগত বক্তব্যে ডিকাব টক জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায়। গত ৫০ বছরে দুই দেশের মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠেছে তা আগামী ৫০ বছরে ছাড়িয়ে যাবে। আমরা নিরাপত্তা, বিনিয়োগ, জলবায়ুসহ একাধিক ইস্যূতে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক আরো সম্প্রসারিত করতে চাই। বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। যা আমরা এর আগেও প্রকাশ্যে এবং ব্যক্তিগত আলাপে জানিয়েছি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়েও উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে। এছাড়াও আরো কিছু আইন আছে যেগুলো স্বাধীন সংবাদ মাধ্যমের জন্য অন্তরায়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন, বিশেষ করে বিচারবর্হিভূত হত্যা এবং গুম সংক্রান্ত ইস্যূতে। যে কারণে গত ডিসেম্বরে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে র্যাবের ওপর নিষেধ্বাজ্ঞা দেওয়া হয়। বাংলাদেশে শ্রম অধিকারের অপর্যাপ্ততা এবং রুগ্ন শ্রম পরিবেশ নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ২০১৩ সালের বাংলাদেশের পণ্য জিএসপি সুবিধা হারিয়েছে। একই কারণে উন্নয়ন সংক্রান্ত তহবিলের অর্থ সহায়তা পাচ্ছে না বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র, এমন মন্তব্য করে রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বলেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে বাংলাদেশের জনগণকেই এগিয়ে আসতে হবে। এই দেশের জনগণ, সরকার, মিডিয়া সকলকে মিলেই আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। এই নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন পরিচালনার স্বার্থে তাদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। আনুষ্ঠানিক না হলেও বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। তাই এখন থেকেই আসন্ন নির্বাচন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী অনুষ্ঠান করতে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বলেন, র্যাবের ওপর অভিযোগের সুরাহায় সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা ও বাহিনীটিকে জবাবদিহিতায় আনা ছাড়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সুযোগ নেই।তিনি বলেন, আমরা র্যাবকে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় কার্যকর একটি বাহিনী হিসেবে দেখতে চাই। তবে তাদের মৌলিক মানবাধিকারও মেনে চলতে হবে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বলেন, ২ জুন ওয়াশিংটনে দুইপক্ষের মধ্যে অর্থনীতি বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের সংলাপ অনুষ্ঠান হবে। সেখানে শ্রম অধিকার গুরুত্ব পাবে। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা পাওয়া এবং উন্নয়ন বিষয়ক তহবিল থেকে আর্থিক সুবিধা পেতে হলে পূর্ণাঙ্গ শ্রম অধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বাস্তবায়ন করতে হবে।পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন পশ্চিমারা নিজেদের উন্নয়ন অংশীদার বললেও উন্নয়নের বিষয়ে কোনো সহযোগিতা করে না। উল্টো বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এই বিষয়ে সাংবাদিকরা মন্তব্য জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের পররাষ্ট্র নীতির মূল হচ্ছে মানবাধিকার সুরক্ষা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা। এই ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দিবে না যুক্তরাষ্ট্র।
বাংলাদেশের কী শ্রীলঙ্কার মত ঋণের ফাদে পড়ার ঝুকি আছে কিনা, জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত হাস বলেন, বাংলাদেশ আর শ্রীলঙ্কা এক নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি তার নিজের মতো চলে এবং অনেক মজবুত। এরই মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনীতিতে ঈর্ষনীয় সাফল্য দেখিয়েছে, যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বেশ ভালো এবং এখানে সামষ্টিক অর্থনীতির ভালো ব্যবস্থাপনা রয়েছে। ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে এর শর্তগুলো কেমন এবং ঋণ কীভাবে ব্যবহার করা হবে তা নিয়ে বাংলাদেশ যথেষ্ট সচেতন। বাংলাদেশের ঋণের ক্ষেত্রে চীনের হার তুলনামূলকভাবে বেশ কম। বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের বড় অংশ এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), বিশ্ব ব্যাংক ও জাপান। কাজেই শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে একভাবে দেখার সুযোগ নাই। তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে না, এটা এখনই বলা যায় না।তিনি আরো বলেন, এই মুহূর্তে মুদ্রাস্ফীতিসহ ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের ফলে বিশ্ব বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের জনগণের ওপর বাড়তি বোঝার চাপ বাড়বে। মূলত বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা দুই দেশের চ্যালেঞ্জ ভিন্ন রকমের।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাংলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে, সেই গণহত্যার স্বীকৃতি যুক্তরাষ্ট্র দিবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত হাস বলেন, এটি আইন সংক্রান্ত খুবই জটিল প্রশ্ন। যেখানে গণহত্যা (জেনোসাইড) নিয়ে আইনগত সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা আছে। এই মুহূর্তে আমি এই বিষয়ে বলতে পারছি না। আপনারা যুক্তরাষ্ট্রের হলকাস্ট জাদুঘড়ের সাইটে গেলে এই বিষয়ে ধারণা পেতে পারেন।জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্ম-স্বীকৃত খুনি যুক্তরাষ্ট্রে লুকিয়ে আছেন। তাকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে হালনাগাদ তথ্য জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বলেন, বিষয়টি আইনগত। এই নিয়ে আদালতে কাজ চলছে।