বিশেষ প্রতিনিধি : ছোটভাই কামালের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সিম্পল লিভিং, হাই থিঙ্কিং (সাধারণ জীবনযাপন এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষা) এটাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। ক্ষমতার জৌলুশ আরাম-আয়েশের দিকে যেন নজর না যায় সেভাবেই আমাদের মানুষ করে গেছেন মা। কামাল ছিল সাদাসিধে। কামাল এবং নূর চৌধুরী দু’জন একইসঙ্গে কর্নেল ওসমানীর এডিসি হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় ১৫ আগস্ট সেই নূরই প্রথম আসে আমাদের বাড়িতে। কামাল বোধহয় ধোঁকায় পড়ে গেছিল তাকে দেখে, ভেবেছিল তাদের উদ্ধার করতে আসছে। কিন্তু সে (নূর) যে ঘাতক হয়ে এসেছে সেটা বোধহয় জানত না। প্রথম তারা কামালকেই গুলি করে। এরপর একে একে পরিবারের সবাইকে হত্যা করে।
শুক্রবার (৫ আগস্ট) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় আয়োজিত বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামালের ৭৩তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন এবং শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার-২০২২ প্রদান অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।তিনি বলেন, শেখ কামালের নীতি ও আদর্শ অনুসরণ করে আমাদের যুব সমাজ নিজেদেরকে গড়ে তুলবে। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও বাংলাদেশের মর্যাদাকে আরো সমুন্নত করবে। মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল আমাদের জন্য যে নীতি আদর্শ, কর্মপন্থা ও দিক নির্দেশনা রেখে গেছেন, তা থেকে আমাদের যুব সমাজ তাদের চলার পথে তার আদর্শকে সামনে রেখে, তা অনুসরণ করে নিজেদেরকে গড়ে তুলবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা শুধু দেশে নয়; বিশ্ব তথা আন্তর্জাতিক পর্যায়েও যেন আমাদের মেধা ও মননকে বিকশিত করে বাংলাদেশের মর্যাদাটাকে আরো উন্নত করতে পারি, সেভাবেই আমাদের ছেলে-মেয়েরা কাজ করবে সেটাই আমি চাই। আজকে কামাল আমাদের মাঝে নেই। আধুনিক ফুটবল খেলা এবং আবাহনী ক্রীড়া চক্র গড়ে তোলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন খেলাধুলায় ছোট্ট শিশু থেকে শুরু করে তরুণ প্রজন্মকে অন্তর্ভুক্ত করার একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছে কামাল। পাশাপাশি সংগীত চর্চায় স্পন্দন শিল্পী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করে বিভিন্ন দেশিয় গানকে আধুনিক বাদ্যযন্ত্রে তুলে তাকে জনপ্রিয় করার কাজটিও সে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করে গেছেন। কেননা বহুমুখী প্রতিভা নিয়েই জন্মেছিলেন শেখ কামাল।
প্রধানমন্ত্রী স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, বাসার ছাদে তার সঙ্গীত দলের এই অনুশীলন চলতো যেখানে ফিরোজ সাঁই, ফেরদৌস ওয়াহিদ, নাসিরউদ্দিনসহ অনেকেই আসতো। জাতির পিতা হত্যার ৬ বছর পর দেশে ফিরে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের জাতির পিতার বাড়িটি মিউজিয়াম করলে সেখানে ফিরোজ সাঁই কামালের অর্গান, যেটি দিয়ে তিনি গান তুলতেন সেটি দিয়ে যান। তার সেই অর্গান এবং কামালের ‘সেতার’টি সেখানেই রেখেছি।শেখ হাসিনা বলেন, শেখ কামাল সেনাবাহিনীতে কমিশন পেলেও যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান শ্রেণির লেখাপড়া তখনো শেষ হয়নি। তাই মাস্টার্স ডিগ্রি গ্রহণের জন্য সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে আবারো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সে ভর্তি হয়। কিন্তু মাস্টার্সের রেজাল্ট প্রকাশিত হবার আগেই না ফেরার দেশে চলে যায়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার প্রবর্তনে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন, এর ফলে মুক্তিযোদ্ধা এবং ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে শেখ কামালের অবদান সকলের মনে থাকবে। সঙ্গে সঙ্গে এটা আমি চাই আমাদের দেশের যুব সমাজ খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা ও সমাজসেবাসহ সবদিকে আরো উদ্যোগী হবে এবং নিজেদেরকে আরো বেশি সম্পৃক্ত করবে সেটাই আমার আকাঙ্ক্ষা।প্রধানমন্ত্রী বলেন, এজন্য আওয়ামী লীগ যখনই সরকারে এসেছে তখনই দেশের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক জগতের উন্নতির প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দুঃস্থদের সেবায় শেখ কামাল যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেই পদাঙ্ক অনুসরণ করেই সরকার সিড মানি দিয়ে বিভিন্ন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে দিয়েছে।
যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক হারুনুর রশীদ এবং স্পন্দন শিল্প গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কাজী হাবলু স্মৃতিচারণমূলক বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে শেখ কামালের জীবন ও কর্মের ওপর নির্মিত ‘এক আলোর পথের যাত্রী’ শীর্ষক একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। প্রধানমন্ত্রী পরে শেখ কামালকে নিয়ে রচিত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন শেখ কামাল আলোকিত তারুণ্যের প্রতিচ্ছবি’ শীর্ষক সচিত্র স্মারক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন।
যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০২২ সালে সাতটি ক্যাটাগরিতে নয়জন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব এবং দুটি প্রতিষ্ঠানকে শেখ কামাল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ পুরস্কার দেওয়া হয় এ অনুষ্ঠানে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল বিজয়ীদের হাতে পুরষ্কার তুলে দেন। হারুনুর রশিদকে আজীবন সম্মাননা; সংগঠক হিসেবে ভূমিকার জন্য সাইদুর রহমান প্যাটেল ও নাজমা শামীম; ক্রীড়াবিদ ক্যাটাগরিতে ক্রিকেটার লিটন দাস; শুটার আব্দুল্লাহ হেল বাকী এবং ভারোত্তোলক মোল্লা সাবিরা; উদীয়মান ক্রীড়াবিদ ক্যাটাগরিতে আর্চার দিয়া সিদ্দিকী ও ক্রিকেটার শরিফুল ইসলাম, পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রিন ডেলটা ইনসুরেন্স, ক্রীড়া সাংবাদিকতায় কাশীনাথ বসাক, এবং ক্রীড়া সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন এবার পুরস্কার পেয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে কামালের জন্মদিন। কামাল বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলো। একাধারে সে হকি খেলত, ফুটবল খেলত, ক্রিকেট খেলত। আবার সেতার বাজাত। ভাল গান গাইতে পারত। নাটকে অংশ গ্রহণ করত। তার অনেক নাটক করা আছে। উপস্থিত বক্তৃতায় সে সব সময় পুরস্কার পেত। এত প্রতিভার কামাল রাজনৈতিকভাবেও সচেতন ছিল। শাহীন স্কুল থেকে পাস করে যখন ঢাকা কলেজে পড়ত তখন থেকে সে ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। আমরা সংগঠন করতাম, কখনো কোনো পদ নিয়ে আমাদের চিন্তা ছিল না।
তিনি বলেন, আমার বাবা শিখিয়েছেন মানুষের জন্য রাজনীতি করা। তার আদর্শ নিয়ে আমরা পথ চলতাম। তিনিই আমদের শিখিয়েছিলেন সাদাসিদে জীবন যাপন করতে হবে। কাজেই ‘সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং’। এটাই ছিল আমাদের মটো। এটাই আমাদের শিখিয়েছিলেন এবং আমরা সেটাই করতাম। শেখ কামাল সব সময় অত্যন্ত সাদাসিদেভাবে চলাফেরা করতেন। তার পোশাক-পরিচ্ছদ, জীবন যাত্রা খুবই সীমিত ছিল। এমনকি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর ছেলে হিসেবে তার কোনো অহংকার ছিল না। শুধু একজন ক্রীড়াবিদ নয় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার যেমন দূরদর্শিতা ছিল তেমনি লেখাপড়াতেও ছিলেন মেধাবী।
শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণে জাতির পিতা যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে। সেই কথা মেনে সারাদেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সুসংগঠিত হচ্ছিল এবং শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে কাজ করছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ধানমন্ডি ১৯ নম্বর রোড, আবাহনী ক্লাব এলাকা ও সাত মসজিদ এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকার যুব সমাজকে সংগঠিত করার কাজ করেছিলেন। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ওই রাস্তায় বেরিকেড দেওয়ার জন্য সে বাসা থেকে চলে যায়। কামালকে কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন লেখাপড়া করার জন্য তাকে সবরকমের সহযোগিতা করবেন। কামাল তাতে রাজি না হয়ে বরং বলেছে, আমি যুদ্ধ করতে এসেছি যুদ্ধই করবো, ট্রেনিং নেব। সে দেরাদুনে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর এডিসি নিযুক্ত হয়। সে এবং মেজর নূর কর্নেল ওসমানীর এডিসি ছিল। প্রধানমন্ত্রী ও বড় বোন শেখ হাসিনা শেখ কামালের সঙ্গে ছেলে বেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। পিঠেপিঠি ছোটভাই কামাল তার খেলার সঙ্গীও ছিল। এ সময় ছোট্ট কামালকে নিয়ে কারাগারে বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখতে যাওয়ারও টুকরো স্মৃতির কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
