আইভি আপা বললেন ঝুমু বাসায় আসিস তারপরই সব অন্ধকার..
এস রহমান : ”শেষ বিকেলে তখন প্রচণ্ড রোদের খরতাপ। সবাই ঘামছিল। কোথাও পা ফেলার মতো অবস্থা নেই। মঞ্চে তখন বক্তৃতা দিচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। আইভি আপা আমাকে বললেন, ঝুমু, বাসায় আসিস। এটুকু বলেই আপা সামনে দিকে এগিয়ে গেলেন। আর তারপরই তো সব অন্ধকার হয়ে গেল। আইভি রহমানের সঙ্গে সেটিই ছিল আমার শেষ কথা। তারপর সর্বত্র ধোঁয়া আর অন্ধকার। তারপর নিজেকে আবিস্কার করি হাসপাতালে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার দুঃসহ স্মৃতির কথা তুলে ধরে এসব কথা বলেন সাবেক সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট আসমা জেরিন ঝুমু”।
২০০৪ সালের ভয়াল ২১ আগস্টের রক্তাক্ত গ্রেনেড হামলার কাল ১৮ বছর। ওই সময় ঘটনাস্থলের খুব কাছে ছিলেন সাবেক মহিলা এমপি, রাজধানীর রমনা তেজগাঁও হাতিরঝিল সংসদীয় আসনের জনপ্রিয় নেত্রী আসমা জেরিন ঝুমু। ওই দিন বিএনপি জামায়াত জোটের সৃষ্ঠ জঙ্গিদের গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্যে রক্ষা পান তিনি। কিন্তু তাঁর সারা শরীরে স্প্লিন্টার বিঁধেছিল। দীর্ঘ সময় চিকিৎসা নিয়ে ছিলেন দেশে-বিদেশের হাসপাতালে। তারপরও এখনও তিনি শরীরে বহন করে চলেছেন ২১ আগস্টের ভয়াল গ্রেনেডের স্প্লিন্টার। চিকিৎসকরা বলেছেন যতদিন বাঁচবেন এগুলো শরীরে বহন করেই বাঁচতে হবে!
ভয়াল ২১ আগস্টের রক্তাক্ত গ্রেনেড হামলায় সেদিনের লোমহর্ষক ঘটনা সম্পর্কে দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে সাবেক মহিলা এমপি, জনপ্রিয় নেত্রী আসমা জেরিন ঝুমু এক দীর্ঘ সাক্ষাতকার দিয়েছেন তাঁর মগবাজারের বাসভবনে।
তিনি বলেছেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ওই দিনে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী শান্তি সমাবেশে কিভাবে নজির বিহীন গ্রেনেড হামলা চালানো হয়েছিল। তিনি জানালেন, চোখের সামনে দলীয় নেতাকর্মীরা মানববর্ম রচনা করে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছিল। ওই দিন তাঁর প্রায় সামনেই গ্রেনেডের আঘাতে আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ মোট ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ লুটিয়ে পড়েছিল।
সেদিনের হামলায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারানো আইভি রহমানের খুব কাছে ছিলেন আসমা জেরিন ঝুমু। তিনি বললেন, শেষ বিকেলে তখন প্রচণ্ড রোদের খরতাপ। সবাই ঘামছিল। কোথাও পা ফেলার মতো অবস্থা নেই। মঞ্চে তখন বক্তৃতা দিচ্ছেন জননেত্রী শেখ হাসিনা। আইভি আপা আমাকে বললেন, ঝুমু, বাসায় আসিস। এটুকু বলেই আপা সামনে দিকে এগিয়ে গেলেন। আর তারপরই তো সব অন্ধকার হয়ে গেল। আইভি রহমানের সঙ্গে সেটিই ছিল আমার শেষ কথা। তারপর সর্বত্র ধোঁয়া আর অন্ধকার। তারপর নিজেকে আবিস্কার করি হাসপাতালে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার দুঃসহ স্মৃতির কথা তুলে ধরে এসব কথা বলেন সাবেক সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট আসমা জেরিন ঝুমু।
দেখতে দেখতে চলে গেল ১৭টি বছর। সাবেক মহিলা এমপি আসমা জেরিন ঝুমুর শরীরে এখনও স্প্লিন্টার। বাম হাতের কব্জিতে বিঁধে থাকা একটি স্প্লিন্টার দেখালেন। দেখাগেল এখনো ফুলে আছে কব্জির ওই অংশের চামড়াটা। বাম পায়ের হাঁটুতেও আছে চারটা স্প্লিন্টার। এখনো তাই ওই পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুল নাড়াতে পারেন না। আঙুলেও এখনো কিছু স্প্লিন্টার বিঁধে আছে। ডান পায়ের উরুতেও আছে একটা। শরীরজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা স্প্লিন্টারগুলোর কারণে প্রচুর ব্যথা অনুভব হয় এখনো। হাঁটুর স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় এখনো ঘুম ভেঙে যায় এই নারী নেত্রীর।
ঝুমু বলছিলেন, “সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশ ছিল আমাদের। সমাবেশের শেষের দিকে জননেত্রী (প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা) বক্তৃতা শেষে স্লোগান দিলেন ‘জয় বাংলা’। আমরাও সেই স্লোগানও শুনলাম। আর ঠিক সেই সময়ই হঠাৎ এক বিকট আওয়াজ। শুধু দেখতে পেলাম, আইভি আপা (আওয়ামী লীগের সাবেক মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী) ছিটকে এসে পড়লেন। চারপাশ যেন নরক গুলজার। এরপর আর কিছু মনে করতে পারছিনা। জ্ঞান ফিরলে দেখলাম রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছি। কতক্ষণ পড়েছিলাম, মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে দেখি চারদিকে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে অনেকেই। চারপাশে কেবল আহাজারির শব্দ। তখনো বুঝতেই পারিনি কী ঘটেছে। চেষ্টা করলাম দাঁড়ানোর। কিন্তু শক্তি পাচ্ছিলাম না পায়ে। মনে হচ্ছিল, আমার পা অবশ হয়ে আছে।
ঠিক তখনই আরও একটি বিকট শব্দ। ঝুমু বলেন, তার মুখের পাশ থেকে কিছু যেন উড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই রাস্তায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ি। তখন কানেও কিছু শুনতে পাচ্ছিলেন না। চিৎকার করে কেবল বলছিলাম, বাঁচাও, বাঁচাও কেউ আমাদের বাঁচাও। তবে নিজের চিৎকার যেন নিজেই শুনতে পাচ্ছিলাম না। ফের জ্ঞান হারান ঝুমু। তিনি বলেন, কতক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম, মনে নেই। জ্ঞান ফিরলে মনে হলো প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনার কথা, তিনি কেমন আছেন? কিন্তু নড়াচড়াই করতে পারছিলাম না। শরীরের কোনো সাপোর্টই পাচ্ছিলাম না। শুধু অসহ্য যন্ত্রণা।
ঝুমু জানালেন, ভারতে সাত বার ও ঢাকায় দু বার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার শরীর থেকে অর্ধশতাধিক স্প্লিন্টার বের করা হয়। তারপরও বাম পা, হাঁটু ও গোড়ালিসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে এখনো রয়ে গেছে অসংখ্য স্প্লিন্টার। বাম পা ঠিকমত চলেনা। এই পায়ের হাঁটুতে থাকা চারটি স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় এখনো প্রায়ই রাতে ঘুম ভেঙে যায়। বাম কানও প্রায় ক্ষতিগ্রস্ত। কোনোমতে ডান কান দিয়ে শুনতে পাই। ডান হাতটি কিছুটা ভালো হলেও ভারী কিছু এখনো তুলতে পারি না।
১৮ বছর আগের সেই ভয়াল দিনের কথা এখনো ভাবতেই ভয়ে শিউরে ওঠেন ঝুমু। সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রার শেষে ট্রাকে তৈরি করা হয়েছিল মঞ্চ। সেই মঞ্চে জনসভার শেষ বক্তা শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হতে না হতেই চালানো হয় গ্রেনেড হামলা। ঝুমু জানালেন, গ্রেনেড হামলার ৯ দিন পর কলকাতার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিলেন। এখনো চিকিৎসার মধ্যেই আছেন।
ঝুমু অভিযোগ করে জানান, নাগরিকদের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের হলেও বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের নিদারুণ অবহেলা পেতে হয়েছিল আমাদের। শুধু তাই নয়, গ্রেনেড হামলায় আহতদের চিকিৎসাতেও বাঁধা দিয়েছে ওই সময়ের বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। সেই সময় তো হাওয়া ভবন থেকে তারেক জিয়ার (বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান) নির্দেশে দেশ চালানো হতো। শুনেছি হাওয়া ভবনের নির্দেশেই সেই সময় প্রতিটি হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সদের নির্দেশ দেওয়া হয়, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহতদের যেন কোনো ধরনের চিকিৎসা না দেওয়া হয়।
যাহোক,
সেদিন ঘটনাস্থল থেকে একটা ভাঙাচোরা মাইক্রো দিয়ে আমাদের বের করা হয়। দোয়েল চত্বরে যাওয়ার পরই শুনি কোনো মেডিকেলে স্থান নেই। সেখান থেকে যাই হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও আমার চিকিৎসা করা হয়নি। পুরো হাসপাতালে তখন মানুষের ‘মা গো-বাবা গো’ বলে আর্তনাদের শব্দ। কিন্তু সেখানে কোনো ডাক্তার-নার্স ছিল না সেবা দেওয়ার-। দলীয় কর্মীরা এসে আমাদের রক্ত মুছছিল। শুনলাম, হাওয়া ভবন থেকে ডাক্তার-নার্সদের বলে দেওয়া হয়েছে চিকিৎসা না দেওয়া জন্য। পরে সেখান থেকে চলে যাই গুলশানের শিকদার মেডিকেলের কার্ডিওলজি বিভাগে। সেখানে জরুরি বিভাগে আমাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। ডাক্তাররা জানান, জরুরিভিত্তিতে অপারেশন করাতে হবে। সেখান থেকে তাই আবার পাঠিয়ে দেওয়া হয় রায়ের বাজার শিকদার মেডিকেলে।
ওই সময় আমার চেহারা এতটাই বিকৃত হয়ে গিয়েছিল যে আমার পরিবারের কেউই আমাকে চিনতে পারেনি প্রথমে। পরে তারা আমাকে নিয়ে ছোটাছুটি করেছে এখান থেকে ওখানে। রায়ের বাজার যখন যাচ্ছিলাম, তখন একটা ফোন আসে। বলা হয় জোরে কান্না না করতে। কান্নার আওয়াজ পেলেই নাকি থানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে!
পরে রায়ের বাজার শিকদার মেডিকেলে অপারেশন করানো হয়। রাতে অপারেশন শেষে সকালে ফের তার নাভিতে স্প্লিন্টার পাওয়া যায়। পরে সকালে আবার অপারেশন করানো হয় তার। তবু তার শরীর থেকে সব স্প্লিন্টার বের করা যায়নি। পরে ভারতের পিয়ারলেস হাসপাতালে প্রদীপ সেনের অধীনে চিকিৎসা হয় ঝুমুর।
১৮ বছর ধরে শরীরে স্প্লিন্টারের ক্ষত বয়ে বেড়ানো ঝুমু সেগুলোর যন্ত্রণায় এখনো ভুগছেন। বলেন, এখনো ব্যথার কাছে নিজেকে অসহায় মনে হয়। মনে হয় যেন শরীরের ভেতর স্প্লিন্টারগুলো বিদ্রোহ করছে। যন্ত্রণায় এপাশ-ওপাশ করতে থাকি, সবকিছু অসহ্য মনে হয়। তবু এখন তো যন্ত্রণা কিছুটা হলেও কম। ওই সময়ে যে যন্ত্রণায় ভুগতে হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। কিন্তু তবু ওই সময়কার সরকার ক্ষান্ত হয়নি। সময় পেলেই নির্যাতন করত আমাদের। ২০০৫, ২০০৬ সালে ২১ আগস্ট এলেই আমাদের খোঁজা হতো এমনভাবে যেন আমরাই অপরাধী।
জিয়ার মূর্খ ছেলে হয়তো ভেবেছে শেখ হাসিনাকে
হত্যা করে তার বেনিফিট পাবে-মুক্তার সর্দার
চার প্রজন্ম ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত আসমা জেরিন ঝুমুর পরিবার। ৯ বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান ৩৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছোট ভাই মুক্তার সর্দারও ছিলেন সেদিনের জনসভায়। একটি স্প্লিন্টার তার মাথার পেছন দিক ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। সেটার ক্ষত আজও তিনি বয়ে বেড়ান।
সেই ব্যথা নিয়েই মুক্তার বলেন, ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যেভাবে জিয়া ও তার পরিবার বেনিফিশিয়ারি হয়েছিল, সেভাবেই তাদের মূর্খ ছেলে হয়তো ভেবেছে শেখ হাসিনাকে হত্যা করে তার বেনিফিট পাবে। এই জঘন্য কাজ করে কি তারা শান্তিতে আছে? একটা জঘন্য কাজের জন্য কতগুলো মিথ্যার আশ্রয় তারা নিয়েছে? জজ মিয়া নাটক বানিয়েছে। তাও কি তারা পেরেছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার বন্ধ করতে? সব বাঁধা পেরিয়ে আজ আমরা একটা রায় পেয়েছি।
সরকারের কাছে ঝুমুর দাবি বঙ্গবন্ধু হত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে সাজাপ্রাপ্তদের শাস্তি যেভাবে কার্যকর হয়েছে, ২১ আগস্টের খুনিদের রায়ও যেন সেভাবে দ্রুত কার্যকর করা হয়। আসমা বলেন, সেই রায় কবে কার্যকর হয়— আমরা তারই অপেক্ষায় রয়েছি। আর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত, তারা যেন এই বাংলাদেশে আর কখনো রাজনীতি করার সুযোগ না পায়— এটাই প্রত্যাশা করি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এদেশের বিজ্ঞ বিচারকদের কাছে।