ব্রিটেনে আরেক লৌহমানবী হচ্ছেন ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস
ডেস্ক রিপোর্ট : মার্গারেট থ্যাচারের পর আরেক লৌহমানবী হচ্ছেন ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস। কনজারভেটিভ পার্টির নেতা হিসেবে বরিস জনসনের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার দৌড়ে জয়ী হয়ে লিজ ট্রাস যুক্তরাজ্যের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। বেক্সিটের সমর্থক কনজারভেটিভ পার্টির ডানপন্থীদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে লিজ ট্রাসের। সাবেক লিবারেল ডেমোক্র্যাট কর্মী লিজ ট্রাস আশির দশকে লৌহমানবী হিসেবে পরিচিত ব্রিটেনের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও এখন নিজেকে থ্যাচারপন্থী শিখার রক্ষক বলে দাবি করেন। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী তেরেসা মের মন্ত্রিসভায় বিচারমন্ত্রী ছিলেন তিনি। এরপর তিনি যুক্তরাজ্যের ট্রেজারি মন্ত্রী এবং তারও পরে অর্থাৎ ২০১৯ সালে বরিস জনসন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান ট্রাস। গত বছর যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন তিনি।
মেরি এলিজাবেথ ট্রাস যে একটি রাজনৈতিক যাত্রায় রয়েছেন তা বলাই যায়। ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে তার পূর্বসূরির মতো ঘরোয়া নাম নাও পেতে পারেন ট্রাস। এমনকি বরিস জনসনের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার দৌড়ে টরি এমপিদের প্রথম পছন্দও ছিলেন না তিনি।কিন্তু তার কর হ্রাস ও রাষ্ট্রকে সঙ্কুচিত করার মতো মৌলিক রক্ষণশীল মূল্যবোধে ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি সঠিক প্রমাণিত হয়েছে এবং দলের সদস্য যারা জনসনের কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন তারাও ট্রাসের অবস্থান জানতে চেয়েছিলেন।
নেতৃত্ব নিয়ে তিক্ততা শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত জনসনের অনুগত ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস। তৃণমূলের টরি সমর্থকরা মার্গারেট থ্যাচারের মতো লিজ ট্রাসের মাঝে অটল, অনমনীয় এবং দৃঢ় সংকল্পের গুণাবলী দেখেন। বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক অবস্থান এবং আনুগত্য বদলানো সত্ত্বেও এসব শব্দ প্রায়ই শোনা যায় যখন বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যরা তাকে ‘উচ্চাভিলাষী’ চরিত্রের অধিকারী বলে বর্ণনা করেন। লিজ ট্রাসের বয়স এখন ৪৭ বছর। জন্ম অক্সফোর্ডে।বাড়ি লন্ডনে। শিক্ষা লিডসের রাউন্ডহে স্কুল ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালযয়ে। হিসাবরক্ষক হাগ-লিরিকে বিয়ে করেছেন ট্রাস। তাদের সংসারে রয়েছে দুই মেয়ে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লিজ ট্রাসের সমসাময়িক শিক্ষার্থী মাউরিজিও গিউলিয়ানো। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুুকানোর পর দুই সহপাঠীর একবার দেখা হয়েছিল লিবারেল ডেমোক্র্যাটের এক অনুষ্ঠানে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রাসকে কেমন দেখেছিলেন মাউরিজ? তিনি বলেন, অন্যান্য শিক্ষার্থীদের চেয়ে আলাদা ছিলেন লিজ ট্রাস।
আমার মনে আছে, সে অন্য ১৮ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের তুলনায় খুব পরিপাটি পোশাক পরেছিল। সেই বয়সে আমরা যেমন ছিলাম তার তুলনায় ট্রাসের আচরণ একজন সত্যিকারের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মতো ছিল।’
১৯৭৫ সালে অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণকারী ট্রাস তার গণিতের অধ্যাপক বাবা এবং নার্স মাকে ‘বামপন্থী’ হিসাবে বর্ণনা করেন। একেবারে তরুণী বয়সে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের এক আন্দোলনে ট্রাসকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার মা।
সেই সময় লন্ডনের পশ্চিমের আরএএফ গ্রীনহ্যাম কমনে মার্কিন পারমাণবিক ওয়ারহেড স্থাপনে থ্যাচার সরকারের অনুমতির সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছিল একটি সংগঠন। সেই সংগঠনের ডাকে আন্দোলনে মায়ের সাথে যোগ দিয়েছিলেন ট্রাসও। যদিও তিনি এখন লিডসের একজন গর্বিত কনজারভেটিভ। আর সেই সময়ে তিনি একজন স্কটিশ লিবারেল ছিলেন।
তরুণী বয়সে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের এক আন্দোলনে ট্রাসকে নিয়ে গিয়েছিলেন তার মা
ট্রাসের চার বছর বয়সের সময় তার পরিবার গ্লাসগোর ঠিক পশ্চিমের পেসলে শহরে চলে যায়। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি মিছিলে অংশ নেওয়ার সময় স্কটিশ উচ্চারণে ‘ম্যাগি, ম্যাগি, ম্যাগি – ওট, ওট, ওট’ বলে চিৎকার করেছিলেন, সেই কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন।
লিজ ট্রাসের পরিবার পরবর্তীতে লিডসে চলে আসে, যেখানে তিনি রাউন্ডহে সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি হন। সেই সময় তিনি শিশুদের ব্যর্থ হওয়া এবং কম প্রত্যাশার কারণে ভেঙে পড়তে দেখেন।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন ট্রাস। বন্ধুরা তাকে অনেক পছন্দ করতেন, যদিও বন্ধুুমহলে তিনি প্রচুর কথা বলতেন বলেও শোনা যায়।
শিক্ষাজীবনে অক্সফোর্ডে অনেক প্রচারণা ও কর্মযজ্ঞের সাথে জড়িত ছিলেন লিজ ট্রাস। তবে রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ ছিল বেশি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি।
১৯৯৪ সালের দলীয় এক সম্মেলনে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত করার পক্ষে নিজের মত দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা সবার জন্য সুযোগের ধারণায় বিশ্বাসী। নির্দিষ্ট কিছু মানুষ কেবল শাসন করার জন্য জন্মেছে, আমরা এটি বিশ্বাস করি না। শুধু তাই নয়, তিনি গাঁজাকে অপরাধমুক্ত করার জন্য প্রচারণাও চালিয়েছিলেন। ২০১৭ সালে লিব ডেমের সহপাঠী অ্যালান রেনউইক বলেছিলেন, ‘লিজ অত্যন্ত উদারপন্থী ধারার কট্টর বিশ্বাসী ছিলেন।
ছাত্র জীবনের শুরুতে লিজ ট্রাস মধ্যপন্থী লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরে ডানপন্থী কনজারভেটিভ পার্টিতে যোগ দেন। ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো দল থেকে এমপি নির্বাচিত হন তিনি।এমপি নির্বাচিত হওয়ার দুই বছর পর ২০১২ সালে তিনি শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এর দুই বছর পর ২০১৪ সালে পদোন্নতি পেয়ে পরিবেশমন্ত্রী হন তিনি।
২০১৬ সাল যুক্তরাজ্যের ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। বহুল আলোচিত ও ঐতিহাসিক সেই ব্রেক্সিট চুক্তির বিপক্ষে ছিলেন ট্রাস। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্তরাজ্যের থেকে যাওয়ার পক্ষে প্রচার চালিয়েছিলেন তিনি। পরে গণভোটে ব্রিটিশরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পক্ষে ভোট দিলে তিনিও এই চুক্তির পক্ষে চলে আসেন।