অর্থনীতিবিশেষ প্রতিবেদন

গুজবকারীরাই ছড়াচ্ছে ব্যাংকে টাকা নেই

মাসরুর আরেফিন : পৃথিবীর অন্য অনেক দেশের মতো আমাদের এখানেও একটা অর্থনৈতিক সংকট চলছে। তেমনই কোনো সন্দেহ নেই, এই সংকটের সময় কিছু মানুষ খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যাংকের টাকা তুলে নেওয়ার বার্তা দিচ্ছে কিংবা হিসাব দিচ্ছে ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে গেলে আপনি আপনার আমানতের কতটুকু খোয়াবেন। আমার এ লেখা দেশের অর্থনৈতিক সংকটকে অস্বীকার করার জন্য নয়। সেই সংকটের সমাধান যদি জানতে চান, তাহলেও এটা পড়ে আপনার লাভ নেই। কিন্তু ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নেওয়ার মতো কোনো যৌক্তিক পরিস্থিতি মোটেই সৃষ্টি হয়েছে কি না, সে বোঝাবুঝিটা যেন আপনি করে নিতে পারেন, সেই কারণেই এই লেখা। ‘দেশ শ্রীলঙ্কা হচ্ছে’ গুজব ছড়িয়ে যাঁরা দেখলেন কোনো কিছুই শ্রীলঙ্কা হয়নি, তাঁরাই এখন ‘ব্যাংকে টাকা নেই, আমানত তুলে নিন’ বলা শুরু করেছেন। দেশের গভর্নর এ অবস্থায় জানিয়ে দিয়েছেন ব্যাংক খাতে তারল্য সংকট নেই, বরং অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে। তিনি আরও বলেছেন, যে ডলার সংকট তৈরি হয়েছে, তা আগামী জানুয়ারি থেকে আর থাকবে না। তারপরও ব্যাংকে নতুন আমানত আসছে না, পুরোনো আমানত বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।

সমস্যা কোথায়? দেশের গভর্নরের দেওয়া তারল্যের হিসাবে মানুষ আশ্বস্ত হতে পারছে না? নাকি ব্যাংকে ডলার নেই কিংবা ব্যাংক এলসি খুলছে না জাতীয় কথার ব্যাখ্যা তারা করেছে যে ব্যাংকে টাকাই নেই? আমার ধারণা, কোনো গুজবের কান এবং চিল দুটোই যখন দৃশ্যমান থাকে না, তখন অসুস্থ আলোচনার মধ্য দিয়ে সাধারণ জনমানসে ছড়ায় শুধু আতঙ্ক। সুস্থ আলোচনায় এ মুহূর্তে প্রশ্নটা আসলে আসা উচিত ছিল এমন যে—এই সংকট কি দীর্ঘমেয়াদি। তার বদলে প্রশ্ন আসছে: দেশের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ, অতএব আমার টাকা কি এখন ব্যাংকে নিরাপদ? ভুল প্রশ্ন নিয়ে আমরা বিচলিত হচ্ছি। প্রশ্নটা ভুল, কারণ এ প্রশ্নের সঙ্গে বর্তমান সংকটের সম্পর্ক অনেক দূরের। আমার এ লেখার তাগিদ সে ভুল ভাঙানোর তাগিদ। দুটো বিষয় যে আসলে সম্পর্কিত নয়, তা আপনাকে জানানোর তাগিদ।

প্রশ্ন হলো, মানুষ ব্যাংকে টাকা কেন রাখে? মোটাদাগে মানুষ কাজটা করে তিন কারণে। এক. ব্যাংকে টাকার নিরাপত্তা মেলে; দুই. চাহিবামাত্র সেই টাকা তোলা যায়; তিন. কিছু মুনাফা বা সুদ পাওয়া যায়। বুঝলাম দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ কমছে, ডলার মার্কেটের তারল্য কমছে, বুঝলাম টাকা দিয়ে ডলার কিনতে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু টাকার তারল্য কি কমেছে? সোজা উত্তর, না। এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংকব্যবস্থায় যে পরিমাণ তারল্য থাকার কথা, তার অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে আরও ১ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার। এই পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য জমা আছে মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে, ব্যাংকে নগদ আকারে। সে বিষয়ে বিস্তারিত বলার আগে জানাই তারল্য বিষয়টা কী?

এ মুহূর্তে দেশের ব্যাংকগুলোতে জমা থাকা মোট আমানত বা ডিপোজিটের পরিমাণ ১৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। আমানতকারীদের ওই টাকা চাহিবামাত্র ফেরত দেওয়ার সক্ষমতা পরিমাপের অন্য নাম—ব্যাংকের তারল্য। আমাদের এই তারল্যের পরিমাণ বর্তমানে ৪ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু হিসাবমতে, আমাদের এই তারল্য থাকা লাগত আড়াই লাখ কোটি টাকার মতো। অন্য কথায়, নিয়মমাফিক দেশের মোট আমানতের ১৭ শতাংশ টাকা নিরাপদে তুলে রাখার জায়গায় আমরা রেখেছি ২৮ শতাংশ টাকা। এ রকম উদ্বৃত্ত তারল্য বিদ্যমান থাকতে আপনি লোকের কথা শুনে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে রাখবেন কোথায়? বাসা কি ব্যাংকের চেয়ে নিরাপদ? সত্য একটা ঘটনা বলি। এই সেদিন আমাদের এক জেলা শহরের শাখা ব্যবস্থাপক জানালেন, তাঁর এক গ্রাহক ১৩ লাখ টাকা বাসায় নিয়ে গেছেন, কারণ তাঁর ইতালিপ্রবাসী ভাই বলেছেন ব্যাংকে টাকা রাখা নিরাপদ না। দুই সপ্তাহ পরে তিনি ব্যাংকে ফিরে এসেছেন ৯ লাখ টাকা নিয়ে। বাকি ৪ লাখ টাকা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না, সেটা চুরি হয়ে গেছে।

ওই শাখা ব্যবস্থাপকের মতো শিকড় পর্যায়ে কাজ করা ব্যাংকারদের থেকেই আমি জানছি, যাঁরা দেশের বাইরে থাকেন, তাঁদের মধ্যে এ উৎকণ্ঠা তুলনামূলক বেশি। প্রবাসীরা দূরে বসে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাংকে টাকা রাখা বা না রাখা নিয়ে ‘জ্ঞানগর্ভ’ আলোচনা শোনেন, আর একসময় দুশ্চিন্তার কাছে হার মেনে দেশে আত্মীয়কে ফোন দেন টাকা তুলে ঘরে রেখে দেওয়ার জন্য। এ পুরো ব্যাপারটা আমাদের অর্থনীতির মৌলিক কাঠামোগত শক্তিটাকে বুঝতে না পারার ব্যাপার। সিকি সত্য বা অপ্রাসঙ্গিক সত্যকে অকাট্য ও প্রাসঙ্গিক সত্য ধরে নিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলার ব্যাপার। সত্য-মিথ্যার এই উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চে যা মঞ্চস্থ হচ্ছে তার ফলাফল যদি হয় বাস্তবতাবর্জিত আতঙ্ক, তাহলে তার চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।

ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনার একটা বড় তত্ত্ব হলো যে সব আমানতকারীর একসঙ্গে সব টাকা নগদ করার কোনো দিন দরকার পড়ে না। এটা চিরন্তন এক সত্য। গ্রাহকদের ব্যাংকে রাখা সঞ্চয় যদি সবার একসঙ্গে দরকার পড়ত, তাহলে পৃথিবীতে ব্যাংকিং বলে কোনো কিছুর আবিষ্কারই হতো না। ব্যাংক আপনার আমানত নিয়ে অন্যকে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ দেয় বলেই মানুষ ঋণ নিয়ে তার ব্যবসার আকার বড় করে বা বাসস্থানের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে গৃহঋণ নেয়। এখন সব আমানতকারী যদি এসে বলেন যে, ‘সব টাকা ফেরত দাও,’ তাহলে ব্যাংকগুলোকে সব ঋণগ্রহীতার কাছে গিয়ে বলতে হবে, আপনার ফ্যাক্টরি বা বাড়ি বিক্রি করে সব টাকা ফেরত দিন। সেটা অবাস্তব। এখন প্রশ্ন আসে, পুরো টাকাটা ব্যাংক থেকে মানুষ একযোগে তুলে নিতে চাইলে কতটা নিতে পারে? ইতিহাস এ ব্যাপারে কী বলে? সামগ্রিক অর্থনীতির সমূহ পতন কিংবা বিশ্বযুদ্ধের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি না হলে এমন কোনো উদাহরণ নেই যে ব্যাংক খাত থেকে মোট আমানতের ১০-১২ ভাগের বেশি টাকা একযোগে বা এক মৌসুমে বেরিয়ে গেছে। সেখানে আমরা এ দেশের গ্রাহকদের মোট আমানতের ১৭ ভাগ টাকা রক্ষিত রাখার বদলে রেখেছি ২৮ ভাগ।

মোদ্দা কথা, পৃথিবীর কোনো দেশই তার ব্যাংকিং ব্যবস্থায় জনগণের রাখা মোট আমানত নিয়ে চিন্তিত থাকে না। আমরাও ১৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার মোট আমানত নিয়ে চিন্তিত নই। আমাদের দেশের ‘রিজার্ভ মানি’-র পরিমাণ ৩ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। এই টাকা থেকেই কিন্তু সৃষ্টি হয়েছে ওই ১৪ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকার আমানত। ১৪ লাখ ৮২ হাজার কোটিকে এখন ৩ লাখ ৪১ হাজার দিয়ে ভাগ দিন, দেখবেন ফল এসেছে ৪ দশমিক ৩৫। এটাই ‘মানি মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট’। অর্থাৎ রিজার্ভ মানির ৪ দশমিক ৩৫ গুণ টাকার আমানত তৈরি হয়েছে এ দেশে। তত্ত্বে বলে, আমাদের আদর্শ মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্ট হওয়া উচিত ৫ দশমিক ৮৮ গুণ। আবার তত্ত্বেই বলে, ৪ দশমিক ৩৫ গুণ যথেষ্ট ভালো এক অঙ্ক। কথা হচ্ছে, অর্থনৈতিক গতিশীলতা যত বাড়বে, তত এটা আদর্শের (৫ দশমিক ৮৮ গুণ) বেশি কাছে যাবে। তার মানে আপনার ১০০ টাকা আপনি ব্যাংকে জমা রাখলেন, ব্যাংক সেখান থেকে ১৭ টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা করে বাকি ৮৩ টাকা ঋণ হিসেবে আপনাকে দিয়ে দিল। আবার আপনাকে দেওয়া ঋণের ওই ৮৩ টাকা ঘুরে ডিপোজিট হিসেবে ব্যাংকেই ফিরে এল; আবার সেখান থেকে ১৭ শতাংশ জমা হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে; আর এ দফায় বাকি ৬৮ দশমিক ৮৯ টাকা গেল নতুন অন্য কোনো ঋণে; আবার…আর এভাবে ৪ দশমিক ৩৫ বার হাত ঘুরে সেই প্রথমবারের কেবল ১০০ টাকা শেষে গিয়ে সৃষ্টি করল ৪৩৫ টাকার আমানত।

এ কথা বললাম এই জন্য যে আমরা মোট আমানতের ১৭ ভাগের বদলে ২৮ ভাগ নিরাপদে তুলে রেখে আপনার টাকাকে ‘বাড়তি ‘নিরাপত্তা দিতে গিয়ে এমনকি অর্থনৈতিক গতিশীলতাও কিছুটা কমিয়ে ফেলেছি। তা-ও আপনার টাকা নিরাপদে থাকুক, সেটাই বড় কথা। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোয় টাকা রাখার নিরাপত্তা নিঃসন্দেহে তাই বৈশ্বিক হিসেবেই শীর্ষ মানের, কারণ তারল্য এতটা বেশি। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ‘লিকুইডিটি কভারেজ রেশিও’ (তারল্য সংরক্ষণ অনুপাত) থাকা লাগে ১০০ শতাংশ, আর সেখানে আমাদের দেশে এ বছর জুনের শেষের এই রেশিও ছিল ১৬৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ।

এবার ‘কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক’ নামের একটা বিষয়ে কিছু কথা বলি। অর্থাৎ ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরের টাকা। আপনি আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ১০০ টাকা তুলে নিলে এই ১০০ টাকাকে বলা হয় ‘কারেন্সি আউটসাইড ব্যাংক’ যে টাকার অর্থনীতিতে গভীর অবদান রাখার ক্ষমতা তুলনামূলক কম। এটাই আপনার দৈনন্দিন লেনদেনের টাকা। এ মুহূর্তে লেনদেনে ব্যবহৃত আমাদের এই টাকার পরিমাণ ২ লাখ ৪১ হাজার কোটি। এবার আপনি ব্যাংক থেকে টাকা অহেতুক তুলে নেবেন, আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন দেখবে এর ফলে দৈনন্দিন লেনদেনে ব্যবহৃত টাকার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে, তখন মুদ্রানীতিতে আগের বলা রিজার্ভ মানির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখতে তাদের মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতেই হবে। আর সেই সঙ্গে কিন্তু বাড়বে মুদ্রাস্ফীতি, যে মুদ্রাস্ফীতির প্রভাব পড়বে আমার-আপনার মতো সাধারণ জনগণের ওপরে। ব্যাংক থেকে অকারণে টাকা তুলে নেওয়ার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার বাড়িটা তাহলে কোথায় গিয়ে পড়ছে? সেটা ঘুরে গিয়ে পড়ছে জনগণেরই ঘাড়ে।

এই কথাটার ওপর এবার অন্যদিক থেকে আরেকটু আলো ফেলি। আগেই দেখিয়েছি এ দেশের ব্যাংকগুলোর তরল সম্পদের পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়েও বেশি আছে। অর্থাৎ ব্যাংক থেকে চাহিবামাত্র টাকা পাওয়ার গ্যারান্টি এখানে বিদ্যমান। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এভাবে আসলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টাটা করতে পারছে, যেহেতু আপনার টাকা আপনি বাসায় না নিয়ে ব্যাংকব্যবস্থায় রাখছেন। এ জন্যই দেখবেন আমেরিকা, ইউরোপ সবখানে ‘ক্যাশলেস সোসাইটি’-এর কথা বলা হয়। আমাদের এখানেও এখন তা হচ্ছে। আপনি ক্রেডিট কার্ডে টাকা খরচ করলে টাকাটা মানি মাল্টিপ্লায়ার ইফেক্টের কাজেই লাগছে, মানে অর্থনৈতিক গতিশীলতায় সেটা ভূমিকা রাখছে। আর আপনি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নগদ টাকা বালিশের নিচে রেখে দিলে কিংবা লেনদেনে ব্যবহার করলে মুদ্রা ব্যবস্থাপনার সর্বোচ্চ উপযোগিতাটার দেখাটা আমাদের মিলছে না। মানি মাল্টিপ্লায়ার যত বেশি, সেই অর্থনীতি তত দক্ষ। ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলে নিয়ে সেই অর্থনৈতিক দক্ষতার ক্ষতি করাটা আমাদের কারোরই উচিত না।

এবার আসি যাঁরা ভুল বার্তা ছড়াচ্ছেন, তাঁদের কিছু উটকো যুক্তি প্রসঙ্গে। প্রথমে বলি বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমাদের রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ২৭১ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এটা গিয়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৬০৩ কোটি ডলারে। এরপর করোনার মধ্যে অবৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ানোয় বৈধ চ্যানেলে বিপুল রেমিট্যান্স আসতে থাকে, আর তা ছাড়া ব্যাংকগুলো অনেক আমদানি ব্যয় পরিশোধকে ‘ডেফার্ড’ বা প্রলম্বিত করায় ২০২০-২১ সময়ে এই রিজার্ভ উঠে যায় ৪ হাজার ৬৩৯ কোটি ডলারে। কিন্তু করোনা শেষে অর্থনীতি স্বাভাবিক হতে থাকলে আমদানি ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসা কমতে শুরু করে এবং একই সঙ্গে ‘ডেফার্ড ‘আমদানি পরিশোধের দায় মেটাতে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়া শুরু হয়। কিন্তু এর অর্থ এই না যে দেশের রিজার্ভ শেষ হয়ে গেছে বা আগামী কয়েক মাস আমদানি ব্যয় ও বিদেশি লোনের কিস্তি মেটানোর মতো ডলার দেশে নেই।

মনে রাখবেন, ২০২১ সালে জার্মানি, কানাডার মতো দেশেরও রিজার্ভ এসে ঠেকেছিল তাদের মাত্র ২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর পর্যায়ে। আসলে অত দূর যাওয়া লাগবে না। ১৯৯১ সালে বাড়ির পাশের ভারতই এর চেয়ে কত তীব্র এক সংকটের মুখে পড়েছিল। সে বছরের জানুয়ারি থেকে জুন, মাত্র ৬ মাসের ব্যবধানে, ভারতের রিজার্ভ প্রায় ৫০ শতাংশ কমে ১০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। সংকট এতটাই প্রকট ছিল যে তখন আমদানি ব্যয় পরিশোধের সামান্য সক্ষমতাটুকুও ভারতের ছিল না। সেবার আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক থেকে প্রায় ২২০ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ভারত সে সংকট কাটিয়ে উঠেছিল খুব চমৎকারভাবেই।উল্লেখ্য, ভারত সেদিন যে ঋণটা পেয়েছিল, তা ছিল স্বর্ণের বিপরীতে পাওয়া ‘সিকিউরড’ ঋণ। আর আমরা আইএমএফ থেকে যে ঋণ পাচ্ছি, সেটা কিন্তু অমন কিছু বন্ধক রেখে পাওয়া কোনো ঋণ না।

রিজার্ভের পর আসি জিডিপির বিপরীতে ঋণের (সরকারের স্থানীয় ও বৈদেশিক মুদ্রায় নেওয়া মোট ঋণের) অনুপাতে, যাকে বলা হয় ‘ডেট টু জিডিপি রেশিও’। এই রেশিও বা অনুপাত দিয়ে মাপা যায় একটা দেশের অর্থনীতি কতটা শক্তিশালী। এ অনুপাত যত কম হবে, তত বেশি কোনো দেশ ঋণ নেওয়া ছাড়াই উন্নতি করতে পারবে। বিশ্বব্যাংকের মতে, জিডিপির তুলনায় ঋণের অনুপাত যদি ৭৭ শতাংশ বা তার চেয়ে কম হয়, তাহলে সে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী বলা যাবে। ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের এই অনুপাত ৩৬ শতাংশের কম। অথচ ২০২১ সালের হিসাবমতে, একই অনুপাত ভারতের বেলায় ৯১ শতাংশ, কানাডার ১১০ শতাংশ আর যুক্তরাষ্ট্রের ১৩৩ শতাংশ। এই পরিমাপক থেকেও বলা যায়, আমরা আইএমএফের ঋণ পরিশোধ করতে এবং একই সঙ্গে বিদেশি গ্রাহকদের কাছে আমাদের পণ্য পৌঁছে দিতে সক্ষম।

এবার বিদেশি ঋণ প্রসঙ্গে। কিছু মানুষ বলতে শুরু করেছেন, দেশ নাকি বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারবে না। আমাদের বিদেশি ঋণ জিডিপির মাত্র ২০ দশমিক ৪ শতাংশ, যেখানে ভারতের ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ দশমিক ২ শতাংশ, জাপানের ৯৭ দশমিক ৯ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরের ৪১৮ দশমিক ৩ শতাংশ। বিশ্বের বহু দেশের তুলনায় আমাদের ঋণের অনুপাত অনেক কম। তবে এটা ঠিক যে গত কয়েক বছরে আমাদের এই ঋণ বেড়ে গেছে।

এখানেও আইএমএফের প্রসঙ্গটা চলে আসে। একজন ব্যাংকার হিসেবে বলতে পারি, ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আপনার না থাকলে আমি আপনাকে ঋণ দেব না। তাহলে আইএমএফ আপনাকে কেন দেবে? আবার আমরা শুধু আইএমএফের ঋণই পাচ্ছি না। বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, জাপান, সবাই আমাদের ঋণ দিতে আসছে। এদের ঋণ অনুমোদন এটাই প্রমাণ করে যে বিদেশিরা বাংলাদেশকে নিয়ে ভয় পাচ্ছে না। আর আপনি কিনা আপনার নিজের দেশের বাড়তি তারল্যসম্পন্ন ব্যাংকব্যবস্থা নিয়ে ভয় পাচ্ছেন?

আমাদের বর্তমান সংকট মূলত একটা স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির সংকট। আইএমএফের ঋণ পাওয়ার মাধ্যমে সেই সংকট কাটিয়ে ওঠার কাজ এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থায় দেশের অর্থনীতি নিয়ে কিছুটা চিন্তিত থাকুন ঠিক আছে, কিন্তু সেই সুস্থ চিন্তার বদলে গুজবে ভর করে দেশের ব্যাংকব্যবস্থার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কোনো কারণ দেখি না। আসলে সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি নিয়ে আশাবাদী হতে আপনি বাধ্য, যেহেতু ক্রমবর্ধমান রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ের পাশাপাশি উৎপাদনশীল খাতে আমাদের আমদানি বৃদ্ধিই পাচ্ছে। আমাদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বেড়ে এটা যে বড় একটা অর্থনীতিতে রূপ নিয়ে ফেলেছে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের যে বিশাল অর্থনীতি আমরা তৈরি করেছি, তা আপনি মনে করেন উধাও হয়ে যাবে? রেমিট্যান্স আয় কিছুটা কমে যাওয়ার কারণে দেশের অন্য সবকিছু বন্ধ হয়ে যাবে? ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হয়ে যাবে? মনে রাখবেন, নতুন লাখো রেমিট্যান্স-যোদ্ধা পুরোদমে বিদেশে যাওয়া শুরু করেছেন। অতএব প্রবাসী আয় সামনের দিনে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার ওপরে ভরসা রাখুন। আর প্রবাসী আয় যেই বাড়বে, ডলার সংকট সেই শেষ। আবার অন্যদিকে সামনে রপ্তানিও বাড়বে, নিশ্চিত।

বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য আমাদের তৈরি পোশাক, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ ভাগ। আমেরিকার বাজারে বাংলাদেশি ডেনিমের প্রবৃদ্ধি চীন বা ভিয়েতনামের চেয়েও বেশি। ইদানীংকালে আমেরিকা-চীন বাণিজ্যিক বিরোধের জের ধরে আমেরিকার বাজারমুখী পণ্যের রপ্তানি আদেশ চীন থেকে সরতে শুরু করেছে। এসব আদেশের পছন্দের তালিকায় এখন প্রথম দেশ হবে বাংলাদেশ। বিশ্ব যেই না বর্তমানের এই অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠবে, সেই দেখবেন বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বেড়ে গেছে। সে কারণেই বিজিএমইএ ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের তৈরি পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে ১০০ বিলিয়ন ডলার।

এখন এ সময়ের খুব বাজার-চলতি একটা প্রসঙ্গে আসি। কারও কারও দাবি এমন যে ব্যাংকগুলোর কাছে বৈদেশিক বাণিজ্যের দায় মেটানোর মতো ডলার নেই। কিন্তু দেখুন, আমদানি, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স—এ তিন সেক্টরেই গত বছর থেকে এই বছর অগ্রগতি বেশি। গত অর্থবছরের জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর—এ তিন মাসে রপ্তানি ছিল ১ হাজার ১০২ কোটি ডলার, আমদানি ১ হাজার ৭৩২ কোটি ডলার ও রেমিট্যান্স আয় ৫৪১ কোটি ডলার, যা এ অর্থবছরের তিন মাসে যথাক্রমে ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলার, ১ হাজার ৯৩৫ কোটি এবং ৫৬৭ কোটি ডলার। কিন্তু সমস্যা আছে একটা। দেশের চলতি হিসাবে ঘাটতি ১০৬ কোটি ডলার বেড়ে গেছে। তার মানে হচ্ছে, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স আয় যে হারে বেড়েছে, আমদানি বেড়েছে তার চেয়ে বেশি। একই জিনিস যা আগে বিদেশ থেকে কিনতাম ধরুন ১০০ ডলারে, সেটাই বৈশ্বিক বাজারে সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন আপনাকে কিনতে হচ্ছে ১৩০-১৪০ ডলারে। মজা করে বললে, এই বাইরে থেকে ‘আমদানি’ হয়ে আসা ঘাটতির কারণেই ব্যাংকগুলো এখন কিছুটা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু টাকা দিয়ে ডলার না কিনতে পারার সংকট, আর দায় মেটানোর ডলার তারল্য না থাকার সংকট এক জিনিস না। বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য এক জিনিস আর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিয়ম আরেক। আমরা ব্যাংকাররা আমদানি দায় মেটাতে দুটো পদ্ধতিরই আশ্রয় নিয়ে থাকি। সে ক্ষেত্রে আমাদের টাকা দিয়ে ডলার কিনতে হয়। আবার তা যদি না পারা যায়, তখন আমরা আমাদের যাঁর যাঁর ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার তারল্য দিয়ে সেই দায় পরিশোধ করি, আবার পরে সুযোগমতো টাকা দিয়ে ডলার কিনে ব্যাপারটার শোধবোধ করি বা ব্যাংকিং পরিভাষায় আমাদের ‘পজিশন স্কয়ার’ করি।

ডলার নেই কথাটা একটা ভুল কথা। আমরা ডলার থাকার সক্ষমতা থেকেই আমাদের আমদানি দায় মেটাচ্ছি এবং এর ফলে কখনো কখনো আমাদের পজিশন ‘শর্ট’ (ঘাটতি) হয়ে যাচ্ছে, সত্য। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রার পজিশন ‘শর্ট’ হওয়া দিয়ে কোনোভাবেই কোনো ব্যাংকের অক্ষমতাকে বোঝায় না। এটা চলমান অর্থনীতির উঠতি-পড়তির এক ধারা। এই যেমন এখন আমদানি শেষমেশ কমতে শুরু করেছে। অন্য কথায়, হুন্ডির ফাঁদ এড়িয়ে আসল দরে বিদেশের সঙ্গে মালের কেনাবেচা শুরু হয়েছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে নিয়মিত ডলার বেচে আমাদের ওই ঘাটতি উপশমের চেষ্টাও করে যাচ্ছে। সামনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া নানা ধরনের পদক্ষেপের ফলে ২-৩ মাসের মধ্যে এই সাময়িক সমস্যার সুরাহা হয়ে যাবে, সেটা দেশের গভর্নরেরই স্পষ্ট আশাবাদ।

এই সার্বিক শক্তিশালী অবস্থায় ব্যাংকের আমানতকারীদের এত চিন্তিত হওয়ার কোনো কারণ দেখছি না। এলসি খোলার বেলায় ব্যাংকগুলো যে সাময়িক কড়াকড়ি করছে, তাতে ব্যাংকের একজন আমানতকারী হিসেবে আপনার উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। এলসি হলো ব্যাংকের বৈদেশিক ব্যবসা, আর আমানতকারীদের টাকা আমরা বিনিয়োগ করেছি মূলত লোন হিসেবে। এলসি খুলতে না পারার কারণে ব্যাংক কখনো দেউলিয়া হয় না। এতে ব্যাংকের মুনাফা কিছুটা কমে, ওই যা।সব মিলে, হঠাৎ দেশের এই সর্বাধিক নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোর মুখ থুবড়ে পড়ার কোনো কারণ নেই। পাশাপাশি এটাও বলে রাখি, এই নভেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিনে এলসি খোলা হয়েছে ১২৬ কোটি মার্কিন ডলারের, যা গত মাসের এ সময়ে ছিল ১২৩ কোটি ডলার। তার মানে প্রয়োজনীয় এলসি যে আমরা খুলছি না, সেটাও আরেক গুজব।

বাংলাদেশ মজবুত এক অর্থনৈতিক কাঠামোর ওপর দাঁড়ানো ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের বড় অর্থনীতির দেশ। সমস্যা যে নেই, তা না। কোনো কোনো ব্যাংকে মন্দ ঋণের সমস্যা আছে, কোথাও সুশাসনের সমস্যা আছে। তাই বলে আপনার টাকা তুলে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরির প্রশ্নই ওঠে না। উঠলে এত দিনে এ দেশে দু-একটা ব্যাংক ধসে যেত। যায়নি, কারণ আপনার সব সমালোচনার পরেও ব্যাংকব্যবস্থায় রয়েছে ওই তারল্য ও উদ্বৃত্ত তারল্যের উপস্থিতি, আর রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত কড়া চোখ। এ সময়ে কিছু স্বল্প স্থায়ী সমস্যাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে আপনার ব্যাংক হিসাবের টাকা যারা অকারণে আপনাকে ব্যাংক থেকে তুলে নিতে বলছে, তারা আপনার ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই করছে না। সে ক্ষতিটার শিকার যাতে আপনি না হন, তাই ওপরের এতগুলো তথ্য-উপাত্ত-অঙ্ক। অঙ্কই কথা বলুক, আর কথা বলুক আমাদের ব্যাংকিং ব্যবস্থার ইতিহাস।লেখক: দি সিটি ব্যাংকের এমডি ও সিইও, অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং কথাসাহিত্যিক

 

 

 

সংশ্লিষ্ট খবর

Leave a Reply

Back to top button