পিলখালা ট্রাজেডি’র ১৪ বছর আজ-কি ঘটেছিল সেদিন..
বিশেষ প্রতিনিধি : পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর সদর দপ্তরের নির্মম ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ১৪ বছর আজ। ২০০৯ সালের এই দিনে শুরু হওয়া গণহত্যায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন নিহত হন। দিবসটি উপলক্ষে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) কোরআনখানি, দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করবে বলে বিজিবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। শনিবার সকাল ৯টায় রাজধানীর বনানীতে সামরিক কবরস্থানে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিনিধিরা।
দিবসটি উপলক্ষে সকল বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) স্থাপনায় বিজিবির পতাকা অর্ধনমিত থাকবে এবং বিজিবি সদস্যরা কালো ব্যাজ ধারণ করবেন। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, তিন বাহিনীর প্রধান- সেনাপ্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ, নৌবাহিনী প্রধান অ্যাডমিরাল এম শাহীন ইকবাল এবং বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল শেখ আবদুল হান্নান-বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. শাফিনুল ইসলাম ও নিহত কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যরাও নিহত সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবেন।
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানা সদর দপ্তরের দরবার হলে তিন দিনব্যাপী বিডিআর সপ্তাহ চলাকালে বাংলাদেশ রাইফেলস (বর্তমানে বিজিবি) বাহিনীর কয়েকশ সদস্য সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু করে। তারা ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করে।তৎকালীন সরকার ও বিডিআর বিদ্রোহীদের মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও গ্রেনেড সমর্পণের মাধ্যমে পরের দিন (২৬ ফেব্রুয়ারি) বিদ্রোহ শেষ হয়।এ ঘটনায় একটি হত্যা ও লুটপাটের এবং বাকিটি বিদ্রোহসহ মোট ৫৮টি মামলা হয়েছে।হত্যা মামলায় ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ৪২৩ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া দেশের সবচেয়ে বড় হত্যা মামলায় ২৭৭ আসামি খালাস পেয়েছেন।
দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ২৬২ জন বিদ্রোহীকে তিন মাস থেকে ১৯ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড এবং প্রয়াত বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টু ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীসহ ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।অন্যদিকে বিদ্রোহের ৫৭টি মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ বিডিআর সদস্যকে চার মাস থেকে সাত বছর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
২৫ ফেব্রুয়ারি যা ঘটেছিল-পিলখানায় দরবার হলে শুরু হয় বার্ষিক দরবার সকাল ৯টায়। সারা দেশ থেকে আসা বিডিআর জওয়ান, জেসিও, এনসিওসহ ২ হাজার ৫৬০ জন সদস্যে তখন পরিপূর্ণ দরবার হল। দরবার মঞ্চে তৎকালীন বিডিআর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান, মামলার অভিযোগপত্র ও সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, জওয়ানদের একটি দল সকাল ৯টার কিছু আগে অস্ত্রাগারে গিয়ে সেখানে দায়িত্বরত এক মেজরকে জিম্মি করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। সেখানে দায়িত্বরত কোনো বিডিআর সদস্য তাতে বাধা দেননি।
দরবারে বিডিআর মহাপরিচালকের বক্তব্য চলাকালে সকাল ৯টা ২৬ মিনিটে মঞ্চের বাঁ দিকের পেছন থেকে সিপাহি মইন ও সিপাহি কাজল অতর্কিতে মঞ্চে প্রবেশ করেন। মইন ছিলেন সশস্ত্র। কাজল পেছনে থাকেন আর মইন অস্ত্র হাতে মঞ্চে উঠে মহাপরিচালক শাকিল আহমেদের দিকে অস্ত্র তাক করেন।
এ সময় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এমএ বারি তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে জুতার ফিতা দিয়ে বেঁধে নিরস্ত্র করেন। সঙ্গে সঙ্গে বিপথগামী বিডিআর জওয়ানদের একটি অংশ দরবার হলে ঢুকে মহাপরিচালকের সামনে তাদের নানা দাবি নিয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু করেন। মহাপরিচালক শাকিল সবাইকে বারবার শান্ত হওয়ার অনুরোধ জানান এবং প্রত্যেক কর্মকর্তাকে নিজ নিজ ইউনিট সামাল দিতে বলেন। তখনই সিপাহিদের মধ্য থেকে ‘জাগো’ স্লোগান আসে।
এরপরই সিপাহি সেলিম রেজার নেতৃত্বে একটি দল সশস্ত্র অবস্থায় দরবার হলে ঢুকে পড়লে সব পরিস্থিতি চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে।দরবার হলের বাইরে শোনা যায় গুলির আওয়াজ। কিছুক্ষণের মধ্যে লাল-সবুজ রঙের কাপড় দিয়ে নাক-মুখ বাঁধা বিদ্রোহী জওয়ানরা দরবার হল ঘিরে গুলি শুরু করেন।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কর্মকর্তাদের দরবার হল থেকে সারিবদ্ধভাবে বের করে আনেন বিদ্রোহীরা। দরবার হলের বাইরে পা রাখামাত্র মহাপরিচালককে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করে। এরপরই হত্যা করা হয় আরও কয়েকজন কর্মকর্তাকে।তারও আগে দরবার হলের বাইরে প্রথমেই হত্যা করা হয় তখনকার ঢাকা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল মুজিবুল হককে।শুরু হয় পিলখানাজুড়ে তাণ্ডব। চলে সেনা কর্মকর্তাসহ তাদের পরিবারকে হত্যা, নির্যাতন, জিম্মি, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা।
খবর পেয়ে সাভার ও ঢাকা সেনানিবাস থেকে সাঁজোয়া যান এবং ভারী অস্ত্র নিয়ে পিলখানার দিকে রওনা হন সেনাসদস্যরা। বেলা ১১টার মধ্যেই তারা ধানমন্ডি ও নীলক্ষেত মোড়ে শান্তিপূর্ণ অবস্থান নেন। বিডিআরের ১ ও ৫ নম্বর গেটের আশপাশসহ বিভিন্ন পয়েন্টে আর্টিলারি গান ও সাঁজোয়া যান স্থাপন করা হয়। বিদ্রোহীরা সদর গেট ও ৩ নম্বর গেট থেকে সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন।দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে বিদ্রোহীদের অস্ত্র সমর্পণের আহ্বান জানিয়ে লিফলেট ছাড়া হলে ওই হেলিকপ্টার লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন বিদ্রোহীরা। তারা মাইকে জানান, আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে পিলখানায় আসতে হবে।
দেড়টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদাপতাকা নিয়ে পিলখানার ৪ নম্বর ফটকের সামনে যান যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানক ও হুইপ মির্জা আজম। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিডিআর প্রতিনিধিদলের দেখা করার ব্যবস্থা করেন।মূলত পিলখানায় কর্মরত ডিএডি তৌহিদ, ডিএডি নাসির উদ্দিন খান, ডিএডি মির্জা হাবিবুর রহমান, ডিএডি আবদুর রহিম, ডিএডি জলিল, সিপাহি সেলিম রেজাসহ কয়েকজন এসব ঘটনার নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন।
ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ১৪ সদস্যের বিডিআর প্রতিনিধিদলকে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন।
সন্ধ্যা ৬টার দিকে নানক সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং অস্ত্র জমা দিয়ে ব্যারাকে ফেরার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সন্ধ্যা ৭টার দিকে প্রধানমন্ত্রীর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণাকে প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের দাবি করেন বিদ্রোহী জওয়ানরা। তারা আগের মতো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ শুরু করেন। সন্ধ্যায় পিলখানার বিদ্যুৎ-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়।
২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেল থেকে পিলখানায় বিডিআরের সংখ্যা কমতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে পোশাক পালটে পিলখানার বিভিন্ন দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে থাকেন বিডিআর জওয়ানরা। একপর্যায়ে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা আবার অস্ত্র সমর্পণের কথা বলেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের কাছে তারা অস্ত্র এবং অস্ত্রাগারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার চাবি বুঝিয়ে দেন।
পরে পুলিশ পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান ঘটে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের। উন্মোচন হয় হত্যাযজ্ঞ’র।২৭ ফেব্রুয়ারি পিলখানার ভেতরে সন্ধান মেলে একাধিক গণকবরের। সেখানে পাওয়া যায় বিডিআরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদ, তার স্ত্রীসহ সেনা কর্মকর্তাদের লাশ। সে বিদ্রোহে প্রাণ হারান ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন। পিলখানা থেকে উদ্ধার হয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্রেনেডসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র।