বিশেষ প্রতিনিধি : স্বাধীনতা দিবসকে কটাক্ষ করায় তুলকালাম অবস্থা। ঘটনার সূত্রপাত দৈনিক প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক এর তোলা ছবি ও ক্যাপশন নিয়ে। জানা গেছে, দৈনিক প্রথম আলোর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের ভাইরাল হওয়া খবরের ছবি ছিলো, ফুল হাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধের ফটকে এক শিশু। নাম জাকির হোসেন। শিশুটির উদ্ধৃতি ছিলো এমন- ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কি করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো’।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগবো- সাত বছরের শিশুর হাতে দশ টাকা দিয়ে দৈনিক প্রথম আলোর ফটো সাংবাদিক ছবি তুলেছেন বলে দাবি ওই শিশু ও তার পরিবারের। এমনকি তার নাম পরিচয়ও ভুল দেয়া হয়েছে। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে এমন খবর প্রচারকে বাসন্তীর জাল পরানো ছবির সাথে তুলনা করেছেন কেউ কেউ। আইনজীবীরা বলছেন, এটি অপরাধ। যদিও দেশের অন্যতম বহুল প্রচারিত জাতীয় দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো এটিকে তেমন বড় ঘটনা হিসাবে দেখছে না।
এনিয়ে ৭১ টিভি একটি প্রতিবেদন করে। যাতে বলা হয়, সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের প্রধান ফটকে গিয়ে ছবিটি দেখাতেই সবাই ছবির শিশুকে চিনতে পারলো। তবে, নাম ভুল ছেপেছে দৈনিক প্রথম আলো। শিশুটির নাম জাকির নয়, সবুজ। তখনও সবুজ স্মৃতিসৌধে আসেনি। কারণ সবাই জানে স্কুল পড়ুয়া সবুজ পড়াশেষে বাড়ি ফিরে গোসল আর খাওয়া দাওয়া সেরে মার সাথে স্মৃতিসৌধে ফুল বেচতে আসে।
তাই কুরগাঁও পাড়ায় সবুজের বাড়িতে কথা হয় তার মা মুন্নী বেগমের সাথে। তিন সন্তানের মধ্যে মেজো সবুজের নাম কিভাবে জাকির হোসেন হলো, আর তার প্রথম শ্রেণীতে পড়ুয়া সন্তানকে কেনো দিনমজুর বলা হলো তাতে তিনি অবাক। জানালেন, রাজমিস্ত্রী বাবা আর তার আয়ে এ বছরই লাগোয়া বাথরুমসহ ঘর ভাড়া নিয়েছেন। ঘরের টিভি বন্ধক রেখেছেন সাত হাজার টাকায়। যেনো ঈদটা ভালোভাবে করা যায়। ভাতের জোগাড় হয়। আর ছোট সবুজ কেমন করে জানবে বাজারের খবর।
লাগোয়া বাথরুম থেকে গোসল সেরে বের হওয়া সবুজকে দেখে বোঝা গেলো বাজার স্বাধীনতা আর চাল ডালের রাজনীতি বোঝার বয়স থেকে সে এখনও বহুদূরে। ছবি আর ছাপানো কথায় তার অপার বিস্ময়। প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী সবুজ আহমেদের কাছেও কোন জবাব নেই।
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ১৭ মিনিট পরেই নিউজটি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হবার বিষয়টি তাদের জানার কথা নয়।
স্বাধীনতা দিবসে এমন খবরকে ১৯৭৪ সালে দৈনিক ইত্তেফাকে জাল পরানো বাসন্তীর ছবির মতোই চক্রান্ত বললেন শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী। যদিও এটিকে এত সরল করে দেখার সুযোগ নেই বলে মনে করেন জেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এখানে যেন কোনো অজুহাত না হয়। এদিকে এই ঘটনার প্রতিকার চেয়েছেন সবুজের প্রতিবেশীরা।
এদিকে, সাভারে দৈনিক প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামান শামসকে ‘সিআইডি পরিচয়ে’ তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার খবর এসেছে।সাভার থানার ওসি দীপক চন্দ্র সাহা বলছেন, এরকম কথা তিনিও ‘শুনেছেন’। তবে সিআইডির ঢাকা বিভাগের ডিআইজি মো. ঈমাম হাসান বলেছেন, এরকম কিছু ঘটেনি।
গত ২৬ মার্চ প্রথম আলোর যে প্রতিবেদনটি নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তার প্রতিবেদক ছিলেন শামসুজ্জামান শামস। ২০১৬ সালে হোলি আর্টিজান বেকারিতে অভিযান চালাতে গিয়ে প্রাণ হারানো পুলিশের সহকারী কমিশনার রবিউল ইসলামের ছোট ভাই তিনি।প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বুধবার বলেন, ভোর ৪টার দিকে আশুলিয়া থানাধীন বাসা থেকে শামসকে তুলে নিয়ে গেছে সিআইডি পরিচয়ধারীরা। এর প্রতিকার পাওয়ার জন্য আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে আমবাগান এলাকায় একটি বাসা নিয়ে থাকেন শামস। মঙ্গলবার রাতে শামসের সঙ্গে তার বাসায় ছিলেন একটি সংবাদমাধ্যমের সাভার প্রতিনিধি। তিনি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী।
তিনি বলেন, শামসও এক সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। সেই সূত্রে ওই বাসায় তার যাতায়াত আছে। মঙ্গলবার রাতে শামসের ফোন পেয়েই তিনি ওই বাসায় যান। পরে রাতে সেখানেই থেকে যান।আমরা দুইজন দুই রুমে ঘুমিয়েছিলাম। ভোর ৪টার দিকে উনি আমাকে ডেকে তোলেন, বলেন, ‘ওঠ, পুলিশ আসছে’। উঠে দেখি ঘরের ভেতর পাঁচজন। একজন শামস ভাইয়ের রুমে ঢুকেছেন। তার ফোন, ল্যাপটপ, একটা পোর্টবল হার্ডডিস্ক ততোক্ষণে তারা হাতে নিয়েছে।ওয়ারড্রব থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে তাতে সেগুলো ঢোকায় তারা। এরপর বলে যে ‘উনাকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি, একটু পরে কথাবার্তা বলে দিয়ে যাব’।
ওদিকে সাভারে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে তার বাসা থেকে তুলে নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, ‘কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হয়ে বিচার চায়, সংক্ষুব্ধ হয়ে থানায় মামলা রুজু করে সেই অনুযায়ী পুলিশ কিন্তু ব্যবস্থা নিতেই পারে। আমি যতটুকু জানি, একটা মামলা রুজু হয়েছে।বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে সাংবাদিকেরা শামসুজ্জামানকে তুলে নেওয়ার বিষয়টি জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আইন কিন্তু নিজস্ব গতিতে চলে। আইন অনুযায়ী, সব কিছু চলে, রাষ্ট্র বলেন, সবকিছুই চলে। কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হয়ে বিচার চায়, সংক্ষুব্ধ হয়ে থানায় মামলা রুজু করে সেই অনুযায়ী পুলিশ কিন্তু ব্যবস্থা নিতেই পারে। আমি যতটুকু জানি, একটা মামলা রুজু হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রথম আলোর সাংবাদিকসহ যিনি উদ্ধৃতিটা করেছেন সেটি সঠিক ছিল না, যেটা নাকি একাত্তর টিভির মাধ্যমে আপনারাই প্রচার করেছেন। আপনারাই সাংবাদিক ভাইয়েরা আপনারাই সংক্ষুব্ধ হয়ে একাত্তর টিভির মাধ্যমে এই সংবাদটা যে ভিত্তিহীন এবং মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে এটা একাত্তর টিভিতে এটা সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমরা মনে করি স্বাধীনতা দিবসে আমরা এত দূর এগোনোর পরে এই ধরনের একটা ভুয়া নিউজ যদি কেউ দেয় তাহলে যে কেউ সংক্ষুব্ধ হবে। আপনাদেরও নিশ্চয়ই এই নিউজটা ভালো লাগেনি।
এদিকে স্বাধীনতা দিবসে মিথ্যা ও বানোয়াট তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশের অভিযোগ এনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে রাজধানীর তেজগাঁও থানায় মামলা হয়েছে প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে। অজ্ঞাত আরও অনেকের কথা বলা হলেও একমাত্র তার নামই উল্লেখ করা হয়েছে মামলার এজাহারে। মামলার বাদী হয়েছেন রাজধানীর কল্যাণপুরের বাসিন্দা সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া।
এজাহারে বলা হয়, দৈনিক প্রথম আলো অনলাইন পত্রিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে মিথ্যা এবং বানোয়াট তথ্য ও ছবিযুক্ত সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে মানহানিকর তথ্য প্রচার ও প্রকাশ করে দেশের স্বাভাবিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি ও সহায়তা করে অপরাধ করা হয়েছে। এই অভিযোগে ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫(২), ২৬(২), ২৯(১), ৩১(২) ও ৩৫(২) ধারায় এ মামলা দায়ের করা হয়।