লুটপাটের তান্ডব চালাচ্ছে তাকসিম-
ওয়াসা এমডির সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ চেয়ারম্যানের
বিশেষ প্রতিনিধি : ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ তুলেছেন সংস্থাটির বোর্ড চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা। বুধবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব ও মন্ত্রীর কাছে দেওয়া এক চিঠিতে এসব অভিযোগ করেন তিনি। চার পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে বোর্ড চেয়ারম্যান আরও বলেন, ঢাকা ওয়াসার অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে সত্য কথা বলায় এমডি তার অনুগতদের দিয়ে চেয়ারম্যানকে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই নেওয়ার চেষ্টাও করেছেন। এমডি বর্তমানে আউট সোর্সিংয়ের নামে লঙ্কাকাণ্ড চালাচ্ছেন। এমডির আশপাশের লোকেরা লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে জনবল সংগ্রহ করে কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে পোস্টিং দিচ্ছে। এসব লুটপাট কমানো গেলে ঘন ঘন পানির দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না। এসব নিয়ে বোর্ডে আলোচনা করতেও এমডি আগ্রহী হন না। বোর্ডের বৈঠক করতেও তিনি বাধা সৃষ্টি করেন।
বোর্ড চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা বলেন, প্রথম যখন তাকসিম এমডি হন, তখন তাকেই আমি নিয়োগ দিয়েছিলাম। তখন যদি জানতাম তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক তাহলে আমি তাকে নিয়োগ দিতাম না। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বের বিষয়টি গোপন করে তিনি এমডি পদে নিয়োগ পেয়েছেন। বর্তমানে তার ঔদ্ধত্যের সীমা ছাড়িয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি দুই মাসে অন্তত একটি বোর্ড মিটিং হওয়ার কথা। এমডির অসহযোগিতার কারণে সেটা করা সম্ভব হয়নি। এই দায় এখন কে নেবে? এ প্রসঙ্গে অনেক চেষ্টা করেও এমডি তাকসিম এ খানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
এ সম্পর্কে প্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা মোস্তফা তারেক বলেন, এ বিষয়ে মন্তব্য করার এখতিয়ার তার নেই। মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে দেওয়া অভিযোগপত্রে গোলাম মোস্তফা বলেন, ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের ওয়াসা বোর্ডের সঙ্গে অসহযোগিতা, ওয়াসা আইন ভঙ্গ করে ব্যক্তিগত সম্পদের মতো স্বৈরাচারী কায়দায় ওয়াসা প্রশাসন পরিচালনা, ঢাকা ওয়াসাকে অনিয়ম, অপচয় আর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা ও ওয়াসা বোর্ডকে অবমাননা করার বিষয়টি দীর্ঘদিন থেকে চলে আসলেও বর্তমানে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বোর্ডের করণীয় সম্পর্কে আপনার দিকনির্দেশনা প্রত্যাশা করছি।
তিনি বলেন, ৩০২তম বোর্ডসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল গত ১৫ মার্চ। গত ১৬ এপ্রিল এমডির অনুরোধে তার এজেন্ডা অনুযায়ী ৩০৩তম বোর্ডসভা আহ্বান করেছিলাম। কিন্তু ওই দিন সভার একটু আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার সাক্ষাতের সূচি আছে বলে তিনি বোর্ডসভা স্থগিতের অনুরোধ জানান। ফলে সভা করা সম্ভব হয়নি। এরপর তিনি জার্মানি চলে যান।
যাওয়ার আগে আমাকে ফোন করে তিনি ১৪ থেকে ১৮ মে’র মধ্যে সুবিধামতো যেকোনো দিনে সভা করতে বলেন।ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেন, এমডির বিদেশে অবস্থানকালীন ঢাকা ওয়াসার পরিস্থিতি নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল খোলামেলা বক্তব্য রাখি। সেখানে আমি যা বলেছি সব সত্য বলেছি এবং ঢাকা ওয়াসাকে বাঁচাতে এসব কথা বলার প্রয়োজন আছে।
এরপর এমডি বিদেশে অবস্থান করে ওয়াসার বিভিন্ন কর্মকর্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে আমার বিরুদ্ধে মানববন্ধন, জোরপূর্বক পদত্যাগপত্রে সই নেওয়া ইত্যাদি করতে ব্যর্থ হয়ে সর্বশেষ মেয়াদোত্তীর্ণ (এমডি কর্তৃক মনোনীত) বিভিন্ন সমিতিকে দিয়ে মন্ত্রণালয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করান। দেশে ফেরার পর তিনি আর বোর্ডসভার কথা বললেন না। এদিকে ওয়াসা আইন ১৯৯৬ এর ধারা ১১(১) মতো প্রতি দুই মাসে অন্তত একবার বোর্ড সভা করার বাধ্যবাধকতার কারণে ১৫ মে তারিখের আগেই বোর্ডসভা করার প্রয়োজন দেখা দেয়।
এ অবস্থায় আমি বোর্ড সভা আহ্বান করি। এ জন্য এমডি ও সচিবকে সশরীরে উপস্থিত থেকে সভার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে বলি। এরপর এমডি বা সচিব আমার দেওয়া নোটিশ পড়েও সভা আয়োজনের কোনো ব্যবস্থা করেননি, যা বোর্ডকে অবমাননা এবং অসদাচরণের শামিল এবং এর মাধ্যমে তারা দুজনেই ওয়াসা আইন উপেক্ষা করেছেন।
প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেন, বোর্ড সচিব নামে ওয়াসার অর্গানোগ্রামে কোনো পদ নেই। তাকসিম নিজের আজ্ঞাবহ একজন প্রকৌশলীকে এ পদে অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। ওই সচিবকে তিনি অনেক দায়িত্ব দিয়ে রেখেছেন। বলা যায় তিনিই প্রশাসনের প্রধান। অথচ ওয়াসায় একজন যোগ্যতাসম্পন্ন ডিএমডি (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) আছেন। তিনি স্ব উদ্যোগে অনেক কাজ শুরু করায় এবং বেশকিছু অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেওয়ায় এমডি তাকে সাইডলাইনে রেখে দিয়েছেন, তাকে বরখাস্ত করার চেষ্টাও করেছেন ভুয়া অভিযোগ তুলে।
তিনি আরও বলেন, বোর্ড সচিব এমডির পার্সোনাল কর্মকর্তার মতো কাজ করেন। এমডি অফিস না থাকলে তিনিও অফিসে থাকেন না। আমি বারবার বোর্ডের জন্য দুজন নিজস্ব কর্মকর্তা নিয়োগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছি এমডির তালবাহানার কারণে। এভাবেই তাকসিম নিজের অবৈধ ক্ষমতার দাপট দেখাতে বোর্ডকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিজের সুবিধামতো প্রশাসন তৈরি করে রেখেছেন। তার অনিয়ম-অপশাসনের ফিরিস্তি বড় লম্বা যা এখানে লেখা সম্ভব না। বিদেশে ছুটিতে থাকাকালীন তিনি বোর্ডসভা করতে বাধা দিয়েছেন। তার চাহিদা এজেন্ডা ছাড়া বোর্ডসভা হবে না- এমন দাবির মুখে বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে অনেক বাগবিতণ্ডা হয়েছে। তারপরও তিনি এখনও সেই পথেই হাঁটেন।
গোলাম মোস্তফা বলেন, ঢাকা ওয়াসার বাজেটে এমডি কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন আইটেমে লুকিয়ে রাখেন এবং ইচ্ছামতো বাজেট বহির্ভূত খরচ করেন। বোর্ড কোনো আইটেমের কথা জানতে চাইলে তিনি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তার একমাত্র উদ্দেশ্য বোর্ডকে বাইপাস করে ঢাকা ওয়াসাকে নিজের ইচ্ছামতো পরিচালনা করা। ঢাকা ওয়াসার ভেতরের অবস্থা খুবই খারাপ। যে-ই তার বিরুদ্ধে কথা বলে তাকেই তিনি চাকরি থেকে অপসারণ করেন। অতীতে এ ধরনের ঘটনা শত শত।
‘চাকরি হারানোর ভয়ে তাই কেউ মুখ খোলে না। একটা সরকারি সংস্থা এভাবে চলতে পারে না। বারবার বলা সত্ত্বেও জনবল আউটসোর্সিংয়ের বিষয়টি বোর্ডসভায় উপস্থাপন করা হয় না। এত সমস্যার মধ্যে ওয়াসা চাইলেও বোর্ডের যেন কিছুই করণীয় নেই। ঢাকা ওয়াসাকে সুষ্ঠু পরিচালনার স্বার্থে বোর্ড কর্তৃক গঠিত কমিটিগুলোকে কাজে অসহযোগিতা ও বাধা সৃষ্টি করে এমডি তাকসিম তাদের কাজ করতে দিচ্ছে না।অভিযোগপত্রে সর্বশেষে তিনি বলেন, বোর্ড সদস্যরা তাকসিম এ খানের অনুপস্থিতিতে আপনার সঙ্গে আলোচনায় বসতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন। আপনি তাদের মুখেই ঢাকা ওয়াসার বর্তমান অবস্থা জানতে পারবেন। আপনি চাইলে আমার অনুপস্থিতিতেও এ বৈঠক হতে পারে।
গত ১১ মে ঢাকা ওয়াসার কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষ থেকে একটি অভিযোগপত্র স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে দেওয়া হয়। সেখানে অভিযোগ করা হয়, বোর্ড চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফার কারণে ওয়াসার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে দেওয়া এ অভিযোগ দায়েরের পেছনে এমডি তাকসিম এ খানের হাত রয়েছে বলে দাবি করেন গোলাম মোস্তফা।