আমুর চালে রাজনীতির সমঝোতা!
আমুর চালে
রাজনীতির
সমঝোতা!
লাবণ্য চৌধুরী : আমুর বক্তব্যের পর রাজনীতির পালে নয়া হাওয়া বইছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, যেভাবে কূটনৈতিকরা নড়াচড়া করছেন তাতে নতুন কিছু ঘটতে পারে। তাছাড়া নির্বাচন যতো ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ততোই বদলাচ্ছে।
ওদিকে বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি- সবকিছুতেই যে নয়া কিছু ঘটছে তার আলামত দেখা যাচ্ছে। তবে আকস্মিকভাবে সামনে আসছে রাজনৈতিক আলোচনায় বসার নানা ইঙ্গিত।
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। আর সে কারণেই আলোচনার কেন্দ্রে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ।
দুই শীর্ষ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা বুধবার সারাদিনই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সংলাপ নিয়ে কথা বলেছেন। সংলাপ আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কিনা তা নিয়ে এখনো গঠনতান্ত্রিক কোনো রূপ দেখা না গেলেও, আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আলোচনার সূত্রপাতকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা হচ্ছে।একইসঙ্গে আমির হোসেন আমুর ‘জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা’র মন্তব্য দলীয়, নাকি তার ব্যক্তিগত, তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা।
মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বৈঠক করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং প্রধানমন্ত্রীর শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের সঙ্গে। এরপর পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক হয় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরেরও। বিকলে পর্যন্ত এই দুই বৈঠক নিয়েই আলোচনা চলছিল। কিন্তু সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু।
এক সমাবেশে তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রকে অব্যাহত রাখার স্বার্থে আমরা আপনাদের (বিএনপি) সঙ্গে বসতে রাজি আছি। শেখ হাসিনা বলেছেন, আলোচনার দ্বার খোলা। আমরা বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে আলোচনা করে দেখতে চাই। কোথায় ফারাক? সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচনে বাধা কোথায়? কীভাবে সেটা নিরসন করা যায়।’
১৪ দলের সমন্বয়ক আমু বলেন, আমরা বলতে চাই, বিগত সময়ে জাতিসংঘ যেভাবে তারানকো সাহেবকে পাঠিয়েছিলেন। আমাদের দুই দলকে নিয়ে এক সঙ্গে বসে মিটিং করেছিলেন। আজকেও প্রয়োজনে এই ধরনের দলাদলি না করে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি আসুক। পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ ও সাবেক এই মন্ত্রীর কথা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়। মঙ্গলবার রাতেই টেলিভিশনের টকশোগুলো এবং মানুষের মধ্যে সংলাপ নিয়ে আলোচনা ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু সকাল হতেই আমির হোসেন আমুর ওই বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার কোনো সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ এখনও নেয়নি।
আমুর বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া দেখান তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদও। প্রয়োজনে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হবে- আমির হোসেন আমুর এই বক্তব্য ১৪ দলের নয় বলে মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হাছান মাহমুদ।
তথ্যমন্ত্রীর অভিমত, ২০১৩ সালের বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের লক্ষ্যে ঢাকা সফররত জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছিলেন।
কিন্তু বুধবার সংলাপের আলোচনা এই দুই নেতার বক্তব্যেই থেমে থাকেনি। দুপুরের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংলাপের কোন বিকল্প নেই। আওয়ামী লীগ সংলাপে বিশ্বাসী। কাজেই আলোচনার মাধ্যমে সবকিছুর সমাধান হতে পারে। আমরা মনে করি, সব কিছুই সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। সংলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাদের বক্তব্যের মধ্যে বিএনপির নেতারা যেসব মন্তব্য করেছেন, তা তাদের সতর্ক অবস্থান বলেই মনে করা হচ্ছে। তারা সংলাপের বিষয় নাকচ করছেন না, আবার সরাসরি কিছু বলছেন না।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার ভিন্ন কথার প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সংলাপের বিষয়ে আওয়ামী লীগের আসল বিষয়টি বুঝতে পারছেন? ধরে নেন এটাই তাদের আসল চরিত্র।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ’সংলাপ নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা এলোমেলো বকছে।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘আমির হোসেন আমু সাহেব যে কথা বলেছেন, সেটা তার নিজের ব্যক্তিগত বক্তব্য নাকি দলের বক্তব্য, তাতো আমরা এখনো জানি না। কোন আলোচনা করতে হলে সুনির্দিষ্ট এবং আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব ছাড়া আমি এরকম বিষয়ে মন্তব্য করতে চাই না।’
তবে বিএনপির মহাসচিবের কথার জবাব আমির হোসেন আমুই দিয়েছেন। মঙ্গলবারের পর বুধবারও সংলাপ নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। আমু বলেন, ‘কাউকে দাওয়াত দিয়ে সংলাপে ডাকা হবে না৷ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনো সংলাপও আহ্বান করা হয় নি৷ সংবিধান অনুযায়ীই নির্বাচন হবে৷ সব দলকে তা মেনেই নির্বাচনে আসতে হবে।’
২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে সংলাপে বসে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। বিএনপি নেতারাও সংলাপে অংশ নিয়েছিলেন। ভোটের আগে অক্টোবরের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ওই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ২১-সদস্যের প্রতিনিধি দল গণভবনে যান। তার সাথে সংলাপে যোগ দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির কিছু সদস্য ও শীর্ষস্থানীয় নেতা।
সে সময়ও বিএনপি নেতারা বলে আসছিলেন যে, নির্দলীয় তত্ববধায়ক সরকার ছাড়া তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু সংলাপ চলার মধ্যেই ভোটের শিডিউল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপিও নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শেষ মূহুর্তে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েও বিএনপির পায় সাত আসন। ড. কামালের গণফ্রন্ট পেয়েছিল এক আসন। আওয়ামী নেতৃত্বাধীন জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে একটানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে।
এর আগে ২০১৪ সালেও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের দাবিকে অটল ছিল। সেই অচলাবস্থা কাটাতে এক বছরের মধ্যে তিন দফা ঢাকা সফর করেছিলেন জাতিসংঘের তখনকার সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো।
ওইসব সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামের প্রতিনিধি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, বিভিন্নমন্ত্রী, রাজনৈতিক প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের একটি অংশ এবং ঢাকায় কর্মরত কূটনীতিকদের সাথে অন্তত ২৫টি বৈঠক করেন তারানকো।
রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসার জন্য তিনি বাংলাদেশে সফর করছেন বলে সে সময় সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের ওই প্রতিনিধি। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তারানকোর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
কিন্তু সফল হতে পারেননি অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। ২০১৪-এর ভোট বর্জন করে নির্বাচন প্রতিহতের নামে বিএনপি-জামায়াত জোট ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।