আমদানির নিম্নমানের গমের ভুসি বাজারে
► ক্ষতিগ্রস্ত দেশীয় উৎপাদনকারীরা ► আমদানিকৃত ভুসি নামি কোম্পানির মোড়কে বাজারজাত ► ভুসি বিক্রি করতে না পারায় বন্ধ ৫০% আটা-ময়দার মিল ► আমদানি বন্ধ না করলে দেশে আটা-ময়দার সংকট দেখা দেবে, বাড়বে দাম ► ভেজাল গো-খাদ্য পশুর জন্য হুমকি ► আমদানি বন্ধ হলে সাশ্রয় হবে বৈদেশিক মুদ্রা ► পশুখাদ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের ► ভুসি আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোর দাবি দেশীয় উৎপাদকদের
বিশেষ প্রতিনিধি : আমদানিকরা নিম্নমানের গমের ভুসি অবাধেবাজারে বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা পূরণের সক্ষমতা থাকার পরও ভুসি আমদানিকরায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশীয় উৎপাদকরা। এরই মধ্যে বন্ধহয়ে গেছে ৫০ শতাংশআটা-ময়দার মিল। উৎপাদন বন্ধথাকলে সংকট দেখা দেওয়ারপাশাপাশি দাম বাড়বে আটা-ময়দার। পশুর জন্য হুমকিভেজাল গমের ভুসি বিক্রিহচ্ছে নামি কোম্পানির মোড়কে।নিরাপদ পশুখাদ্য নিশ্চিত করার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে ভুসির আমদানি শুল্ক বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
সংশ্লিষ্টসূত্র জানায়, দেশে বছরে গমেরভুসির চাহিদা ২১ লাখ ৯০হাজার টন। সারা দেশেছোট-বড় ১ হাজার১০০-এর বেশি আটা-ময়দার মিলে উৎপাদন হয়২২ লাখ ৫০ হাজার মেট্রিক টন। চাহিদার চেয়েবেশি উৎপাদন হলেও বিপুল পরিমাণবৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় করে গমেরভুসি আমদানি করা হচ্ছে। এতেদেশি কোম্পানিগুলোর বিপুল পরিমাণ ভুসি অবিক্রীত থাকায়আটা-ময়দা উৎপাদন বন্ধরাখতে বাধ্য হচ্ছেন। একই সমস্যায় ইতোমধ্যেবন্ধ হয়ে গেছে মোটআটা-ময়দার মিলের প্রায় অর্ধেকই। পশু-প্রাণীর জন্যহুমকি ভেজাল গো-খাদ্য আমদানিনিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি দেশীয়শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে গমের ভুসি আমদানিশুল্ক বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
এবিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ আটা-ময়দা মিলমালিক সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিন মৃধাবলেন, আমদানিকৃত ভুসি খুবই নিম্নমানের।তাই এসব ভুসি কিছুটাকম দামে বিক্রি হচ্ছে।ফলে আমাদের দেশের মিল মালিকদের উৎপাদিতভুসি বিক্রি হচ্ছে না। গমের ভুসিআমদানিতে আটা-ময়দা আমদানিরসমান শুল্ক আরোপ করা হলেআমরা টিকে থাকতে পারব।
বর্তমানেআটা-ময়দার আমদানি শুল্ক ৩৮ শতাংশ হলেওগমের ভুসি আমদানির শুল্কমাত্র ৫ শতাংশ। আবারখামারিরা সরাসরি আমদানি করতে পারছেন কোনোশুল্ক ছাড়াই। এই সুযোগ নিয়েএক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দেশে নিম্নমানের ভুসিআমদানি ও নামি কোম্পানিরমোড়কে (ব্যাগ) বাজারজাত করছে। এতে দেশি কোম্পানিগুলোরসুনাম নষ্ট হওয়ার পাশাপাশিনিম্নমানের গমের ভুসি বিক্রিকরছে একটি অসাধু চক্র।ভেজাল গো-খাদ্য বিক্রিবন্ধের পাশাপাশি নিরাপদ গমের ভুসি বাজারজাতকরার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এবিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের উপপরিচালক ডা. মো. নাজমুলহক বলেন, আমরা ভেজাল গো-খাদ্যের (ভুসি) বিষয়ে কঠোর অবস্থানে। বিশেষকরে আমদানিকৃত ভুসিতে ভেজাল পেলে কাউকে ছাড়দেওয়া হবে না। পশুরজন্য ক্ষতিকর এসব ভুসি আমদানিতেআমাদের নজরদারি রয়েছে। ভেজাল গমের ভুসি নাকেনার জন্য খামারিদের পরামর্শদিয়েছেন তিনি।
জাতীয়রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানায়, এক বছরের ব্যবধানেভুসি আমদানি বেড়েছে ৮৮ শতাংশের বেশি।চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারি-জুন) ৪ লাখ৩৯ হাজার ৫৩ মেট্রিক টনগমের ভুসি আমদানি করাহয়েছে। ২০২২ সালের প্রথমছয় মাসে আমদানি করাহয়েছিল ২ লাখ ৩৩হাজার ৪১৬ মেট্রিক টন।চলমান ডলার সংকটে খাদ্যপণ্যও জ্বালানি আমদানি ব্যাহত হলেও ভুসি আমদানিবেড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জরুরিপণ্যে এলসি উন্মুক্ত রাখারনির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছেনা। গত বছরের ৬নভেম্বর সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে খাদ্যপণ্য, সার ও জ্বালানিআমদানির এলসি খোলা নিশ্চিতকরতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারপ্রধানেরনির্দেশনা উপেক্ষা করে একটি চক্রদেশীয় শিল্পকে ধ্বংস করতে নিম্নমানের গমেরভুসি আমদানি করছেন।
এবিষয়ে বসুন্ধরা ফুডের বিভাগীয় প্রধান (বিক্রয় ও বিতরণ) রেদোয়ানুররহমান বলেন, ‘বর্তমানে দেশের যে ভুসির চাহিদাআছে তার চেয়ে বেশিভুসি দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। সাধারণত গম থেকে ৩০শতাংশ ভুসি উৎপাদন হয়।কারখানাগুলোতে উৎপাদিত ভুসি সর্বোচ্চ ৪-৫ দিনের বেশিমজুদ করে রাখা যায়না। মজুদ ভুসি বিক্রিকরতে না পারলে নতুনকরে উৎপাদনে যেতে পারে নাকারখানাগুলো। ফলে বাধ্য হয়েঅনেক কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে।এভাবে চলতে থাকলে বাজারেআটা-ময়দার সরবরাহ সংকট তৈরি হয়েদাম বেড়ে যেতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানিকৃতনিম্নমানের ভুসিতে বাজার সয়লাব। তাদের নিতে হয় নাকোনো বিএসটিআই সনদ, লাগে নাকোনো মান পরীক্ষা। এসবনিম্নমানের ভুসির কারণে একদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশীয় কোম্পানিগুলো। প্রাণিসম্পদ খাত হুমকির মুখেপড়ছে। দেশের আটা-ময়দার মিলগুলোতেপর্যাপ্ত থাকার পরও ভুসি আমদানিরফলে দেশের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় হচ্ছে। অন্যদিকেডলার সংকটের কারণে জ্বালানি ও জরুরি খাদ্যপণ্যআমদানি ব্যাহত হচ্ছে।’ রেদোয়ানুর রহমান আরও বলেন, বর্তমানেআমদানিকৃত আটা-ময়দায় ৩৮শতাংশ শুল্ক আরোপ রয়েছে, কিন্তুএর উপজাত (বাই প্রোডাক্ট) ভুসিতেমাত্র ৫ শতাংশ শুল্কআরোপ আছে।
যদিও পশুখাদ্যউৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো বিনা শুল্কে ভুসিআমদানি করতে পারছে। এসবনিম্নমানের ভুসি দেশের নামিদামিকোম্পানির বস্তা নকল করে বাজারজাতকরছে। এতে মানসম্পন্ন পশুখাদ্যপাচ্ছেন না খামারিরা। জানতেচাইলে এসিআই কনজ্যুমার ব্র্যান্ডসের ইনস্টিটিউশন সেলসের মহাব্যবস্থাপক অবন্তি কুমার সরকার বলেন, নিম্নমানের আমদানিকৃত ভুসিতে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। আমাদেরউৎপাদিত ভুসি বিক্রি করতেপারছি না। আমদানিকৃত ভুসিদেশে নামিদামি কোম্পানিগুলোর মোড়কে (ব্যাগ) মানুষকে ফাঁকি দিয়ে বিক্রি করছে।এতে আমাদের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। অনেকমিল বন্ধ হয়ে গেছে।আমাদেরটাও বন্ধের পথে। ভুসি বিক্রিকরতে না পারায় আটা-ময়াদার উৎপাদন বন্ধ রাখা হচ্ছে।এভাবে চলতে থাকলে দেশেআটা-ময়দার দাম আরও বেড়েযাবে।
আমদানিকৃতনিম্নমানের গমের ভুসি দেশেরনামিদামি কোম্পানির মোড়কে (ব্যাগ) বিক্রি করে দেশি কোম্পানিগুলোরসুনাম নষ্ট করা হচ্ছে।চলতি বছরের ৬ মার্চ কিশোরগঞ্জেরহোসেনপুরে বসুন্ধরা ভুসির মোড়কে (ব্যাগ) ভেজাল ভুসি বিক্রি করায়দুই ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।এ সময় তাদের কাছথেকে ২১ বস্তা ভেজালগমের ভুসি জব্দ করাহয়।