মেডিকেল রিপোর্টার : রাজধানীর মিরপুরে বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা যাওয়া শিশু লিমার (৮) মরদেহের মুখ ও ঘাড়ের বিভিন্ন অংশ বিড়ালে খেয়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে মিরপুর–২ নম্বর এলাকার হাজিপাড়া বস্তি এলাকায় মায়ের সঙ্গে নানির বাড়ি থেকে ফেরার পথে বাবা–মার সঙ্গে শিশুটিও প্রাণ হারায়।
এ সময় তাদের উদ্ধারে এগিয়ে আসা তরুণ অনিকও মারা গেছেন। রাতে স্থানীয়রা নিহতদের মরদেহ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। চিকিৎসকেরা চারজনকে মৃত ঘোষণা করার পর লাশ নেওয়া হয় হাসপাতালের জরুরি বিভাগের লাশঘরে। সেখানে রাতেই সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি শেষে লাশ রেখে যায় থানা–পুলিশ।
শুক্রবার দুপুরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগের লাশঘরের সামনে লিমার নানা লিটনসহ স্বজনেরা অভিযোগ করেন, লিমার নাক, মুখ, চোখ বিড়াল খেয়ে ফেলেছে। বৃহস্পতিবার রাতে বৃষ্টির পানিতে তার ছিঁড়ে পড়ে বিদ্যুতায়িত হয়ে চারজন নিহত হওয়ার ঘটনায় শুক্রবার দুপুরে মামলা হয়েছে। এরপর সুরতহাল প্রতিবেদনসহ মরদেহ যায় হাসপাতালের মর্গে।
হাসপাতালে লাশ নিতে আসা স্বজনেরা বলেন, বৃহস্পতিবার রাতেই তাঁরা লাশ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশ লাশ দেয়নি। শুক্রবার দুপুরে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের লাশঘর থেকে মর্গে নেওয়ার আগে তাঁরা দেখতে পান, শিশু লিমার মুখ ও ঘাড়ের বিভিন্ন অংশে গভীর ক্ষত, নাক নেই, রক্তাক্ত। তখন বিষয়টি লাশঘরের লোকজনকে জানানো হয়।
লিমার নানা মো. লিটন লাশ বুঝে নেওয়ার পর বলেন, আমার নাতনির লাশটাও ভালোভাবে পেলাম না। মেয়েটার নাকটাই বিড়ালে খেয়ে ফেলেছে। চোখ রক্তাক্ত ছিল। এখন লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি।
হাসপাতালের জরুরি বিভাগের লাশ রাখার স্থানে গিয়ে দেখা যায়, লাশ রাখার নির্দিষ্ট কক্ষের বাইরে একটি অন্ধকার কক্ষে লিমা ও তার বাবা মিজানুরের লাশ রাখা। কক্ষটি ময়লা আবর্জনায় পূর্ণ। একটা বড় বাক্স রাখা। স্ট্রেচারে কাপড়ে ঢাকা দুটি লাশ। মেঝেতে ছোপ ছোপ রক্ত। সেই বাক্সের নিচে বেশ কয়েকটি বিড়াল।
নির্দিষ্ট কক্ষে না রেখে অন্য কক্ষে লাশ রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে লাশঘরের দায়িত্বে থাকা টুনটুন দাস বলেন, আমাদের ফ্রিজে জায়গা নেই। সেখানে অন্য লাশ আছে। তাই এই রুমে রাখা হয়েছে।তিনি আরও বলেন, গতকাল আমি ছিলাম না। আমার সহকারী কবির ছিল। সে বলতে পারবে এখানে কেন রেখেছে। আমি আজ ছুটি থেকে এসেছি। লাশের ঘরে বিড়াল কেন—সে প্রশ্নের কোনো জবাব টুটুন দিতে পারেননি।
হাসপাতালের মর্গ সূত্রে জানা গেছে, সুরতহাল প্রতিবেদনসহ অন্যান্য আইনি আনুষ্ঠানিকতা শেষে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মর্গে লিমার লাশ এলে মুখে ও ঘাড়ে ক্ষতের বিষয়টি তাঁদের নজরে পড়ে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানানো হয়। লিমার নানাকেও ডেকে দেখানো হয়।
এ বিষয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে মর্গের ইনচার্জ যতিন দাস বলেন, আমাদের কাছে লাশ আসার পরে বিষয়টা দেখতে পারি। একটা মরদেহের নাক নেই, এটি আবার সুরতহাল প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই। তাই বিষয়টি ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসককে জানানো হয়। পাশাপাশি মরদেহ নিতে আসা স্বজনদের ডেকে দেখানো হয়। ময়নাতদন্তের আগে লিখিতভাবে তাঁদের জানানো হয়। এটাতে তাঁদের স্বাক্ষরও রাখা হয়।
জরুরি বিভাগের লাশঘরে মরদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিড়ালে খাওয়ার বিষয় জানতে চাইলে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক খলিলুর রহমান বলেন, জরুরি বিভাগের লাশ ঘরে ফ্রিজে মরদেহ সংরক্ষণ করা হয়। লাশ বিড়ালে খাওয়ার কথা না। এরপরও এ বিষয় আমি খোঁজ নিচ্ছি।
সংশ্লিষ্ট একাধিক জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি মরদেহ হাসপাতালে আসার পরে লাশঘরে সংরক্ষণ করা হয়। এই দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। আইনগত প্রক্রিয়া শেষে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে লাশ নেওয়া হলে সেখানে মরদেহ সংরক্ষণ ও দেখভালের দায়িত্ব মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষের। তবে মিরপুরে নিহত চারজনের লাশই নির্দিষ্ট কক্ষের বাইরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এমনকি লাশ আটকে টাকা আদায়ের অভিযোগও উঠেছে। তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন লাশঘরের দায়িত্বপ্রাপ্ত টুটুন দাস। তিনি বলেন, আমি কোনো টাকা নিইনি। সব দাবি ছেড়ে দিয়েছি।
হাসপাতালে আসা লাশে আপনার দাবি কিসের—এমন প্রশ্নের জবাবে টুটুন বলেন, আমরা দেখাশোনা করি। সুরতহাল করতে সহযোগিতা করি। পাশাপাশি লাশ সরিয়ে মর্গে দিয়ে আসি। এ জন্য কিছু বকশিশ দেয় মানুষ। আর যারা লাশ সরাতে হেল্প করে তাদের সালামি দিতে হয়।তবে এমন টাকা আদায় করার নিয়ম নেই। জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক।
বৃহস্পতিবার রাতে মিরপুর ২ নম্বর এলাকায় ঝিলপাড় বস্তি এলাকায় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পানিতে পড়ে। বিদ্যুতায়িত হয়ে ঘটনাস্থলে মারা যান মিজানুর রহমান, তাঁর স্ত্রী মুক্তা আক্তার ও মুক্তার সন্তান লিমা (৮)। তাঁদের বাঁচাতে গিয়ে মারা যান অনিক (২০) নামের এক তরুণ। স্থানীয়রা লাশ উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নেন। এ ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলা হয়েছে। লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে। ময়নাতদন্ত করেছেন ডাক্তার মাইনুউদ্দিন।