চট্টগ্রাম প্রতিনিধি : ব্যাংকের টাকা মেরে বিদেশ পালিয়েছে চট্টগ্রামের অর্ধশত ব্যবসায়ী। বিদেশে পলাতক এসব ব্যবসায়ীরা মেরে দিয়েছেন ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এতথ্য চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের। তিনি কোম্পানী খুলেছেন আর ঋন নিয়েছেন। প্রোফিটও দেখিয়েছেন আর সেটা দেখিয়েছেন পুনরায় ঋন নিবেন এই আশায়।
একের পর এক কোম্পানী খুলেছেন আর বেতন হাকিয়েছেন। ইনভেষ্টরদের উচ্চলাভ দেখিয়েছেন আবার প্রোফিটও দিয়েছেন কিন্তু মুল টাকা পাচার করেছেন দুবাইয়ে ব্যবসার নামে। আর এরপর পরিবার নিয়ে সটকেও পড়েছেন। এযেন চিরচেনা কাহিনী। অবশেষে, ১৫০০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করে দুবাই পালিয়ে যাওয়ার দায়ে ইমাম গ্রুপের এমডি ও তার স্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের যুগ্ম জেলা জজ মুজাহিদুর রহমান।
দুবাই থেকে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তায় সোনালী ব্যাংক পিএলসির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। অভিযুক্ত ব্যবসায়ী হলেন চট্টগ্রামের ইমাম গ্রুপের এমডি মোহাম্মদ আলী ও তার স্ত্রী জেবুন্নেছা। তাদের বিরুদ্ধে একাধিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত এক দশকে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করে বিদেশ পালিয়েছেন চট্টগ্রামের অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী। এদের বেশির ভাগ ঋণ খেলাপি। ব্যাংকের টাকা মেরে বেশ কিছুদিন আত্মগোপনে থেকে সব দিক ম্যানেজ করে বিদেশ পালিয়েছেন। কেউ কেউ উত্তরসূরিদের দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে বা কৌশলে ব্যবসা পরিচালনা করছেন।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ভোগ্যপণ্য, ইস্পাত, জাহাজ ভাঙা, সিমেন্ট, গার্মেন্টসহ বিভিন্ন ব্যবসায় পথপ্রদর্শক এখানকার অনেক ব্যবসায়ী। ব্যবসাও সামলিয়েছেন সুনামের সঙ্গেই। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে তাই ঋণ মিলেছে সহজেই। কিন্তু ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করেই এরা একসময় বিদেশ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
পলাতক ব্যবসায়ীরা অনেকেই ইউরোপ, আমেরিকা এবং মালয়েশিয়া, দুবাই, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে স্থায়ী আবাস গড়ে নতুন ব্যবসা শুরু করেছেন। চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের অধিকাংশ মামলায় ঋণখেলাপিদের দেশে ফেরত আনা, দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা কিংবা পাসপোর্ট জব্দের আদেশ দেয়ার পরও কাজ হচ্ছে। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যর্থতা ও উদাসীনতায় ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের শোকজের ঘটনাও বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি।
ব্যাংক ও অর্থঋণ আদালত ও থানা সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এর মধ্যে গত এক দশকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ২০-২২ হাজার কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ না করেই দেশ ত্যাগ করেছেন অন্তত ২২ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক। অর্থঋণ আদালত ও নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট (এনআই) অ্যাক্টে তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা। এর মধ্যে ১১ ব্যবসায়ী বর্তমানে কানাডা, সাতজন যুক্তরাজ্য, চারজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তিনজন মালয়েশিয়া, দুজন তুরস্ক, একজন আরব আমিরাত, একজন অস্ট্রেলিয়া, একজন মন্টেনিগ্রো ও একজন সিঙ্গাপুরে আবাস গড়েছেন বলে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের দৈনন্দিন কাজের এক-তৃতীয়াংশই পাসপোর্ট জব্দ, পলায়নরত অবস্থায় বিদেশ থেকে ফেরত আনা কিংবা বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত। ব্যবসায়ীদের বিদেশযাত্রা ঠেকাতে আদালতের এসব কাজ ঋণ আদায়কে বিলম্বিত করছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
আইনজীবীরা বলেছেন, ‘ঋণখেলাপির আধিক্যের অন্যতম কারণ হচ্ছে ঋণের বিপরীতে পর্যাপ্ত মর্টগেজ না থাকা। তাছাড়া ব্যাংকগুলোর ঢালাওভাবে ঋণ দেয়ার প্রবণতায়ও খেলাপির পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়েছে। আবার সক্ষমতা থাকলেও অনেকে আইনের মারপ্যাঁচে ঋণ পরিশোধে অনীহা দেখিয়ে বিদেশে পালিয়ে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামে একসময় অর্থঋণ আদালত ছিল তিনটি। বর্তমানে একটি আদালত দিয়ে খেলাপি গ্রাহকদের এভাবে পালিয়ে যাওয়া রোধ করতে বেগ পেতে হচ্ছে।
চলতি বছরের মার্চে গ্রেফতারি পরোয়ানা ঠেকাতে আলোচিত ঋণখেলাপি এসএ গ্রুপের সাহাবুদ্দিন আলম ও তার স্ত্রী আদালতের দেয়া আদেশের ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ে ব্যাংকে অর্থ পরিশোধ করেছেন। পাশাপাশি আদালতে জমা দিয়েছেন পাসপোর্ট। বিদেশ যেতে নিষেধাজ্ঞাসহ পাসপোর্ট জব্দের একাধিক আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কয়েকটি বড় শিল্প গ্রুপের মালিকরাও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেছেন। যদিও নিষেধাজ্ঞার পরদিনই বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার নজিরও রয়েছে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
ট্রাস্ট ব্যাংকের ১৮৮ কোটি টাকা খেলাপি ঋণের মামলায় গত ১৬ জুলাই রতনপুর গ্রুপের (আরএসআরএম) মালিক মাকসুদুর রহমান এবং তার দুই ছেলে মিজানুর রহমান ও মারজানুর রহমানের বিরুদ্ধে দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। পাশাপাশি যথাসময়ে মামলা না করায় ব্যাংক ম্যানেজারকে শোকজ করেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত। এর আগে ওয়ান ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ মে ২৩৪ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আদায়ে শীতলপুর স্টিলের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজিম উদ্দিন, নির্বাহী পরিচালক জানে আলম, পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন ও মাহবুব আলমের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত।
সপরিবারে কানাডা পাড়ি জমানো চট্টগ্রামভিত্তিক বাদশা গ্রুপের কর্ণধার ইসা বাদশাকে (মহসিন) ঋণখেলাপি মামলায় বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। কানাডার টরন্টোর লেকশোর এলাকায় বাস করা ইসা বাদশার দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বাড়ি ও নামে-বেনামে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে ব্যাংকসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। তার প্রতিষ্ঠানটির কাছে ওয়ান ব্যাংক, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংকসহ আট ব্যাংকের ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ আটকে আছে। চলতি বছরের এপ্রিলে আদালতের আদেশে ৫ কোটি টাকা জমা দিয়ে বিদেশ যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা এড়িয়েছেন মোস্তফা গ্রুপের একাধিক পরিচালক। চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির কাছে সাউথইস্ট ব্যাংকের পাওনা প্রায় ১১৩ কোটি ৭৬ হাজার ১১৭ দশমিক ৯০ টাকা।
অভিযোগ রয়েছে, ব্যাংকের চেষ্টা সত্ত্বেও চট্টগ্রামের ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীদের একটি বড় অংশ দায় পরিশোধ না করে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করছেন। এক্ষেত্রে ব্যাংকেরও দায় রয়েছে বলে মনে করছেন আদালতসহ খাতসংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ ৩ অক্টোবর ৩২ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ আদায়ে রায় পেলেও বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে না তুলে আদালতের কাছে চার দফা সময় প্রার্থনা করে সোনালী ব্যাংক করপোরেট শাখা। রায় পেলেও বন্ধকি সম্পত্তি নিলামে বিক্রির মাধ্যমে ঋণ আদায়ে বিলম্বের কারণে ব্যাংকটির উপমহাব্যবস্থাপককে শোকজ করেছেন চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত। একইভাবে ঋণের দায় পরিশোধ না করে বিদেশ পালানো ইমাম গ্রুপের সম্পত্তি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নেয়ার রায় ঘোষণার পরও ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অনীহায় তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে একাধিক ঋণখেলাপির বন্ধকি সম্পত্তিতে নিরপেক্ষ রিসিভার নিয়োগের পর ঋণ পরিশোধের হার বাড়লেও ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে উদাসীন। আদালত সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত এক বছরে চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালত প্রায় ২০টি রিসিভার নিয়োগের আদেশ দিয়েছেন। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপির পাসপোর্ট জব্দ, বিদেশ যেতে নিষেধাজ্ঞাসহ বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ঋণখেলাপিকে ফেরত আনার আবেদন করছে। চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় ঋণখেলাপিরা ব্যাংকের দায় পরিশোধ না করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় ঋণ আদায় অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় এসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, বিদেশে পালিয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীরা প্রথমে পরিবারের সদস্যদের বিদেশে স্থায়ী করেন। তারপর সুযোগ বুঝে নিজেরাও পাড়ি জমান। তাদের কেউ কেউ এখন বিদেশে পাঁচ তারকা হোটেল, মানি এক্সচেঞ্জ, হুন্ডি, আবাসন, সুপার মার্কেট, পেট্রল পাম্পসহ বিভিন্ন ব্যবসা করছেন। অথচ দেশে ভোগ্যপণ্য, শিপ ব্রেকিং, গার্মেন্টস, আবাসন, কৃষি ও পরিবহন খাতে ব্যবসার জন্য সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের ঋণ দিয়েছিল। বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন কিন্তু পলাতক তাদের অনেকেই নিজের পরিবারকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
পাওনাদার ব্যাংক ও চট্টগ্রাম অর্থঋণ আদালতের তথ্যমতে, ব্যবসায়ীদের মধ্যে সর্বশেষ দেশ ত্যাগ করেছেন শিপ ব্রেকিং ব্যবসায়ী আশিকুর রহমান লস্কর (মাহিন)। খেলাপি মামলায় আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরদিন গত ৬ মার্চ সপরিবারে দুবাই হয়ে লন্ডনে পাড়ি জমান এ ব্যবসায়ী। তার কাছে ১০ ব্যাংকের পাওনা প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। যদিও ৫ মার্চ শীর্ষ এ খেলাপি ব্যবসায়ীর দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন আদালত। এছাড়া চট্টগ্রামের বনেদি শিল্প পরিবার হাবিব গ্রুপের পাঁচ পরিচালক এবং নূরজাহান গ্রুপ, ক্রিস্টাল গ্রুপ, মিসম্যাক গ্রুপ, ম্যাক ইন্টারন্যাশনাল, ইয়াসির এন্টারপ্রাইজ, জাহিদ এন্টারপ্রাইজ, সিঅ্যান্ডএ গ্রুপ, ইফ্ফাত ইন্টারন্যাশনালসহ আরো অন্তত ১০টি শিল্প গ্রুপের ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের দায় পরিশোধ না করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। ব্যাংকের আবেদনে একাধিক আদেশ দেয়া হলেও তাদেরকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
অর্থঋণ আদালতের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, ‘চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাংকের দায় পরিশোধে মামলা পরিচালনার পরিবর্তে দেশ ছেড়ে পালানোর প্রবণতা বেশি। আদালত থেকে নিষেধাজ্ঞা দিয়েও ঋণখেলাপিদের বিদেশে পলায়ন ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। অনেকে নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কায় আগেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, আবার কেউ কেউ নিষেধাজ্ঞা আসার পরদিনই দেশ ছেড়েছেন। এক্ষেত্রে আদালতের রায় দ্রুত বাস্তবায়নে ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় জরুরি।’