বিশেষ প্রতিবেদন

বিস্ময়কর ছায়ামানব-যার আতংকে কাঁপছে ইসরাইল

আন্তজার্তিক ডেস্ক : ফিলিস্তিনে তাকে বলা ছায়া মানব! গাজার অধিবাসীরা তাকে বলেন, তিনি অধরা। ফিলিস্তিনি মায়েরা শিশু সন্তানকে এই ছায়ামানব দেইফের বিরোচিত গল্পের কথা শোনাতে শোনাতে ঘুম পাড়ান। ফিলিস্তিনের লোকগাথাঁয় ঢুকে পড়েছে দেইফের নাম। দেইফের বর্তমান হদিস কেউ জানে না। অনুমান মাটির নিচে কোনো সুড়ঙ্গের মধ্যে তিনি বহাল তবিয়তে রয়েছেন। সেখান থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। ইসরাইল ও তার দোসরা দেইফকে যা কিছু আখ্যায়িত করুক না কেন তিনি ফিলিস্তিনিদের কাছে মহা-বীর।

ইসারাইলের মাটিতে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলাকে দেশটির সেনা অধিকর্তারা তুলনা করছেন আমেরিকার মাটিতে নাইন ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে। হামলা পরিচালনাকারী ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে এখন লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি সেনারা।

হামাসের এমন বিষ্ময়কার ও আকস্মিক হামলা নকশা কে একেঁছেন, তা নিয়ে শুরু থেকেই নানা ধরনের খবর আসছিলো। ইসরাইলি গোয়েন্দাদের ধারণা, এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ফিলিস্তিনি নাগরিক ও হামাসের শীর্ষ সমর নেতা মোহাম্মদ দেইফ, যিনি অনেক দিন থেকেই তেল আবিবের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায়।

গেলো শনিবার স্থানীয় সময় অতি ভোরে, গাজা উপত্যকা থেকে হামাস হাজার হাজার রকেট ছুঁড়তে থাকে ইসরাইলের বিভিন্ন এলাকা লক্ষ্য করে। এ সময়ের একটি অডিও টেপ ইসরাইলি গোয়েন্দাদের হাতে এসেছে। সেখানে বলা হচ্ছিলো, আল আকসা বন্যা। ধারণা করা হচ্ছে, কণ্ঠটি ছিলো দেইফের।

তিনি আল আকসা ফ্লাড বা বন্যার মাধ্যমে হামলা শুরুর নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে মনে করছে ইসরাইলি গোয়েন্দারা। শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়েছিল জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে ইসরাইলি হামলার প্রতিশোধ নেয়ার জন্য পরিকল্পিত হামলা শুরুর ইঙ্গিত হিসাবে।

২০২১ সালের মে মাসের কথা। ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান আল আকসা মসজিদে ইসরাইলের একটি বর্বোরচিত হামলায় ঘটনা আরব এবং মুসলিম বিশ্বকে ক্ষুব্ধ করে। ঠিক সময়েই মোহাম্মদ দেইফ প্রতিজ্ঞা করেন সেই হামলার প্রতিশোধ নেয়ার। শুরু করেন ‘আল আকসা ফ্লাড’ অপরারেশনের পরিকল্পনা।

গাজার একটি সূত্র জানাচ্ছেন, রমজানে আল আকসা মসজিদে ইসরাইলের হামলা, ইমামদের মারধর, তাদের ওপর হামলা, বয়স্ক ও যুবকদের মসজিদ থেকে টেনে বের করার দৃশ্য এবং ফুটেজ গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পরার পর থেকেই এমন প্রতিশোধের পরিকল্পনা। হামলাটি হামাসের ক্রোধকে প্রতিশোধের স্পৃহায় পরিণত করে।

আল আকসা প্রাঙ্গণে ইসরাইলি হামলার বিষয়টিকে জেরুজালেমের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতি হুমকি হিসাবে বর্ণণা করে হামাস। শুরু হয় লড়াই। টানা ১১ দিন ইসরাইলি সেনাদের সঙ্গে লড়াই করে গেছে হামাসের যোদ্ধারা। পরে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যস্থায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়।

সেই ঘটনার দুই বছরেরও বেশি সময় পর, শনিবারের হামলা ছিলো ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল সংঘাতের পর ইসরাইলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সবচেয়ে বড় আঘাত। ফলে ইসরাইলের সরকার যুদ্ধ ঘোষণা করে গাজায় হামলা চালিয়ে শত শত মানুষকে হত্যা করে। অবরুদ্ধ করা হয়েছে গাজা উপত্যকা।

হামাসের হামলার মূল কারিগর মোহাম্মদ দেইফকে ইসরাইল বহুবার হত্যা করার চেষ্টা করেছে। সাতটি হামলা থেকে তিনি নিজেকে রক্ষা করতে সমর্থ্য হন। সবশেষ হত্যা চেষ্টা হয়েছিলো ২০২১ সালে। সেটি ব্যর্থ হবার পর থেকে দেইফকে আর জনসমক্ষে দেখা যায়নি। ধরণা করা হয়, তিনি পুরোপুরি আত্মগোপনে আছেন।

শনিবার হামলার আগে হামাস নিয়ন্ত্রিত একটি টিভি চ্যানেল ঘোষণা করেছিলো, মোহাম্মদ দেইফ ফিলিস্তিন নাগরিকদের উদ্দেশ্য বক্তৃতা করবেন। তখনই ফিলিস্তিনিরা বুঝতে পারেন দারুণ কিছু একটি ঘটতে যাচ্ছে। অন্যদিকে বিষয়টি জানলেও ইসরাইলি গোয়েন্দারা বিষয়টিতে হালকাভাবে নিয়েছিলেন।

পরে এক অডিও বার্তায় দেইফ বলেন, আজ আল আকসায় ইসরাইলি হামলার প্রতিশোধ হিসাবে আমাদের জনগণ ও জাতির ক্রোধ বিস্ফোরিত হচ্ছে। আমাদের মুজাহেদিনরা আজ দিন সেই সব অপরাধীকে বার্তা দিচ্ছে। তাদের বোঝানোর সময় শেষ হয়েছে।

এই অডিও টেপ সম্প্রচারের সময় দেইফের মাত্র তিনটি ছবি ব্যবহার করা হয়। ২০ বছর বয়সের সময় তোলা একটি ছবি, মুখোশে পরা একটি ছবি আর তার ছায়ার একটি ছবি। বলা বাহুল্য, মোবাইল ফোনের এই যুগে দেইফের এই তিনটি ছবি ছাড়া, আর কোনো ছবি দেখেনি ফিলিস্তিনি নাগরিকরা।

হামাসের সামরিক বিভাগ- আল কাসাম ব্রিগেডের প্রধান মোহাম্মদ দেইফ ঠিক এমনই। স্মার্ট ফোনের মতো কোনো আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করেন না তিনি। কথা বলেন খুবই কম, জনসমক্ষে কখনও দেখা যায় না। আসলে জমসমক্ষের আড়ালে থাকাটা দেইফের জন্য জীবন-মরণের বিষয়।

হামলার পরিকল্পনা-দুই বছর ধরে-
গত দুই বছর ধরে একটু একটু করে এগিয়েছে হামাস। তবে, হামলার চূড়ান্ত পরিকল্পনার কথা জানতেন হামাস প্রধান, হামাসের গাজা ভূখণ্ডের নেতা ইয়াহা সিনওয়ারের মতো হাতে গোনা দুই-তিন জন। তবে, এই হামলার স্থপতি যদি কাউকে বলতে হয়, মাস্টারমাইন্ড যদি কাউকে বলতে হয়, তিনি হলেন মোহাম্মদ দেইফ।

শুধু হামাসের দুই মাথা আর সেনা বিভাগের প্রধান দেইফ ছাড়া হামলার বিষয়টি কারো জানা ছিলো না। শুধু তাই নয়, হামাসকে সহায়তা দেয়া ইরানসহ আরব মিত্রদের কাছে হামলার পরিকল্পনা গোপন রাখা হয়েছিল। হামাসের অর্থ ও রসদ যোগানদাতারা শুধু জানতেন, একটা কিছু হবে, কিন্তু কবে, সেটি ছিলো অজানা।

একটি সূত্র বলছে, তেহরান হামাসের হামলার পরিকল্পনা জানলেও বিষয়টি কোনো পক্ষের সঙ্গে ভাগাভাগি করেনি। হামাস, ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব, ইরান-সমর্থিত লেবানিজ গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ এবং ইরানের সঙ্গে জড়িত কোনো যৌথ অপারেশন রুমে এটি নিয়ে আলোচনা করা হয়নি।

দেইফের পরিকল্পনা ছিলো নিখুঁত। বিশেষ করে ইসরাইলের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ফাঁকি দেয়ার জন্য যা করা দরকার ঠিক তেমন করেই এগিয়েছেন তিনি। ইসরাইলের বিশ্বাস ছিলো, হামাস এখন আর তাদের সঙ্গে কোন ধরনের সামরিক বিরোধে জড়াবে না, বরং গাজার অর্থনৈতিক উন্নয়নে নজর দেবে বেশি।

এমন বিশ্বাস থেকে গাজা উপত্যকায় বসবাসরত নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিতে শুরু করে তেল আবিব। ঠিক তখনই ইসরাইলি সেনা বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে হামাসের যোদ্ধার হামলার জন্য প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। বেশ কিছু মহড়ারও আয়োজন করে হামাস।হামাসের পররাষ্ট্রবিষয়ক মুখপাত্র আলি বারাকা বলেছেন, আমরা এ যুদ্ধের জন্য দুই বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছি। তিনি বাকি যেটা বলেননি, সেটি হলো এই যুদ্ধের পুরো পরিকল্পনা এসেছে দেইফের মাথা থেকে। আর এ ধরনের হামলার জন্য মোহাম্মদ দেইফের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে।

তার হদিস অজানা, যদিও তিনি সম্ভবত গাজায় ছিটমহলের নিচে সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধায় নিজেকে লুকিয়ে রাখেন। ইসরাইলের একটি নিরাপত্তা সূত্র জানায়, দেইফ হামলার পরিকল্পনা ও পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলো। এ ব্যাপারে তাদের কাছে তথ্য-প্রমাণও রয়েছে।
ফিলিস্তিনি সূত্র জানায়, হামাসের হামলার পর ইসরাইল গাজায় যে বিমান হামলা চালায়, সেটির একটি লক্ষ্য ছিলো দেইফের বাবার বাড়ি। সূত্র মতে, বিমান হামলায় দেইফের ভাই এবং পরিবারের অন্য দুই সদস্য নিহত হয়েছেন। তবে বাবার পরিণতি কি, তা এখনও জানা যায়নি।

কে এই মোহাম্মদ দেইফ-
১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর, গাজার খান ইউনিস জেলায় এক ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু শিবিরে তৈরি করা হয়েছিলও। ১৯৬৫ সালে সেই উদ্বাস্তু শিবিরেই জন্ম হয়েছিল দেইফের। তবে, বাবা-মা তার নাম দিয়েছিলেন মোহাম্মদ মাসরি। পরে তিনি দেইফ নামেই পরিচিতি পান।

১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদা বা প্যালেস্টাইনি বিদ্রোহের সময় তিনি হামাসে যোগ দেন। সেই সময় থেকেই তার নাম হয়, মোহাম্মদ দেইফ। ১৯৮৯ সালে তাকে গ্রেপ্তার করে ইসরাইল। ১৬ মাস জেলে ছিলেন তিনি। পরে ফিলিস্তিনের মুক্তির আন্দোলনে যোগ দেয়ার পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যান তিনি।

গাজার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন মোহাম্মদ দেইফ। শিল্পকলার প্রতিও তার অনুরাগ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদন কমিটির প্রধান ছিলেন তিনি। মঞ্চ নাটকে অভিনয়ও করতেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর, দেইফ পুরোপুরি হামাসের আন্দোলনে নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন।

একেবারে নিচু স্তর থেকে পুরোপুরি নিজের দক্ষতা ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে হামাস গোষ্ঠীর বড় নেতা হয়ে ওঠেন দেইফ। ২০০২ সালে তিনি প্রথম আল কাসাম ব্রিগেডের প্রদাধ পদে বসেন। তারপর থেকে তিনি ওই পদেই আছেন। তার উদ্যোগেই টানেল নেটওয়ার্ক এবং বোমা তৈরির ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে হামাস।

আত্মঘাতী বোমা হামলায় বেশ কয়েকজন ইসরাইলি নাগরিকের মৃত্যুর জন্য দেইফকে এককভাবে দায়ি করে আসছে ইসরাইল। গত কয়েক দশক ধরে ইসরাইলে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকার শীর্ষে রয়েছে তার নাম। ইসরাইলি হামলায় তার একটা চোখ নষ্ট হয়ে গেছে।

পায়ে গুরুতর আঘাত পেয়েছেন, যার জন্য তাকে হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হয়। ২০১৪ সালে ইসরাইলি বিমান হামলায় তার স্ত্রী, সাত মাস বয়সী এক ছেলে এবং তিন বছরের মেয়ের মৃত্যু হয়েছিলো। বুধবার (১১ অক্টোবর, ২০২৩) একইভাবে মৃত্যু হয়েছে তাঁর বাবা-ভাইয়ের।

 

সংশ্লিষ্ট খবর

Back to top button