চট্টগ্রাম থেকে স্পোর্টস রিপোর্টার : একেই বলে কপাল তানজিদ তামিমের।তিন বার জীবন পেয়ে শেষবার ম্যাচ জিতিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলেন তিনি। টি টোয়েন্টিতে আজই অভিষেক হয়েছে তাঁর, সে ম্যাচে জিম্বাবুয়ের ফিল্ডাররা তিনবার তাঁর ক্যাচ ফেলেছেন – এর মধ্যে চতুর্থ ওভারে চার বলের মধ্যেই দুবার! তিনবার বেঁচে যাওয়া তামিম দারুণ ফিফটিতে অভিষেক রাঙিয়ে দিলেন।
আর তাঁর সঙ্গে ৪৭ বলে ৬৭ রানের সঙ্গে চারে নেমে তাওহীদ হৃদয়ের ১৮ বলে ৩৩ রানের ইনিংসে হেসেখেলেই জিম্বাবুয়েকে হারিয়ে দিল বাংলাদেশ। চট্টগ্রামে বারেবারে বৃষ্টিতে বাধাপ্রাপ্ত প্রথম টি-টোয়েন্টিতে আগে ব্যাট করে জিম্বাবুয়ে করতে পেরেছে মাত্র ১২৪ রান, বাংলাদেশ তা পেরিয়ে গেছে ৮ উইকেট আর ২৮ বল হাতে রেখে।
আইপিএলে যেখানে ২০০-২৫০ রান দেখা যাচ্ছে নিয়মিত, সেখানে জিম্বাবুয়ে আগে ব্যাটিং পেয়ে বাংলাদেশকে লক্ষ্যই দিতে পেরেছে মাত্র ১২৫ রান। বাংলাদেশের তো হেসেখেলেই জেতার কথা! একটাই দুশ্চিন্তা ছিল, বৃষ্টি এসে না খেলা পন্ড করে দেয়!
বৃষ্টি এল, দুবার হানা দিল বাংলাদেশের ইনিংসের সময়ে। দ্বিতীয় দফায় বৃষ্টিটা পাঁচ ওভারের পরে আসায় একটু শঙ্কায়ই পড়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ – ডাকওয়ার্থ লুইস পদ্ধতির হিসাবে না আবার পিছিয়ে পড়েন শান্তরা!
শঙ্কার কারণও ছিল। তিন ওভারের পর প্রথম দফায় বৃষ্টির আগে লিটন দাসের উইকেট হারানো বাংলাদেশের শুরুটা ধীরগতিতে হয়েছিল। অষ্টম ওভারের দুই বল হওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় বৃষ্টি আসার সময়ে বাংলাদেশের রান ছিল ১ উইকেটে ৪৪। বৃষ্টিআইনের হিসাব অনুযায়ী দ্বিতীয় ইনিংসে পাঁচ ওভার খেলা হয়ে গেলেই তো হলো, এরপর আর একটা বলও মাঠে না গড়ালেও ম্যাচ ফল দেখবে।
সে কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের শঙ্কা ছিল, বৃষ্টি আইনে এগিয়ে তো বাংলাদেশ? কিছু সংশয়ের পর আইসিসির হিসাবনিকাশ এসে তা দূর করে দিল – বৃষ্টি আইনে তখন ১ রানে এগিয়ে ছিল বাংলাদেশ।তবে সেসব শঙ্কা-টঙ্কা সরে গেল চট্টগ্রামের আকাশ থেকে মেঘ সরে যাওয়ায়। খেলা আবার শুরু হলো, বাকিটা তো তামিমের গল্প।
দ্বিতীয় দফায় বৃষ্টির সময়ও যে বাংলাদেশ একটুর জন্য এগিয়ে ছিল, সেটাও তামিমেরই অবদান বলতে পারেন। লিটন দাস আরেকবার ব্যর্থতার স্বাদ নিয়ে ফিরেছেন দ্বিতীয় ওভারে। মুজারাবানির ইনসুইংয়ে বিভ্রান্ত হয়ে বোল্ড হয়ে লিটন ফিরলেন ১ রান করে। প্রথম দফার বৃষ্টির সময়ে বাংলাদেশের রান ছিল ৩ ওভারে ১ উইকেটে ১০। সেবার বৃষ্টি থেমে খেলা শুরু হতে না হতেই তামিমের ক্যাচ নিয়ে নাটক আর তামিমের মার!
চতুর্থ ওভারের তৃতীয় বলে মুজারাবানিকে পুল করতে গিয়েই বল আকাশে তুলে দিয়েছিলেন তামিম। কিন্তু সোজা উঠে যাওয়া বলটা ধরতে বোলার মুজারাবানি আর জিম্বাবুয়ের উইকেটকিপার গাম্বি দুজনই দৌড়ে যান। শেষ পর্যন্ত ক্যাচ ধরতে গিয়ে দুজনের সংঘর্ষ, বল মুজারাবানির হাত ফসকে মাটিতে। তামিমের রান তখন ১০ বলে ৩!
ওভারের শেষ বলে আবার ক্যাচ দিয়েও বেঁচে গেলেন তামিম। এবারে অত নাটক হয়নি, অফ স্টাম্পের বাইরের বলে ড্রাইভ করতে এক্সট্রা কাভারে ক্যাচ দিয়েছিলেন, কিন্তু জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক সিকান্দার রাজা ক্যাচ ধরার আগে বলের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়ার মাশুল গুনলেন। তামিমের রান তখন ১২ বলে ৪!
দুবার জীবন পাওয়া তামিম এরপর খোলস ছেড়ে বেরোলেন। পঞ্চম ওভারে রাজাকেই মিড উইকেটে চার মেরে শুরু করলেন, তাঁর এবং বাংলাদেশের ইনিংসের প্রথম চার সেটি। পাওয়ার প্লে-র শেষ ওভারে, অর্থাৎ ষষ্ঠ ওভারে মুজারাবানির ওপর ছড়ি ঘোরালেন। প্রথম বলে দারুণ কাভার ড্রাইভে চার, পরের বলে স্কয়ার লেগে ছক্কা। এক বল পর পুল করে আবার বিশাল ছক্কা! ১৬ রান আসে সেই ওভারে। ওই ওভারটা না হলে দ্বিতীয় দফায় বৃষ্টির সময়ে পিছিয়েই থাকত বাংলাদেশ!
অবশ্য বৃষ্টি থেমে আবার খেলা শুরু হয়ে যাওয়ায় সে সময়ের হিসেব-নিকেশ নিয়ে আর মাথা ঘামাতেই হয়নি। এরপর যা মাথা চুলকাতে হয়েছে জিম্বাবুয়ের বোলার-ফিল্ডারদেরই।অষ্টম ওভারে চোখজুড়ানো কাভার ড্রাইভে চার মারা শান্তর ওয়ানডে গতির ইনিংস শেষ হয়ে গেল দশম ওভারে। জঙ্গুয়ের করা ওভারের দ্বিতীয় বলে শরীর থেকে দূরে রেখে ব্যাট চালিয়ে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন শান্ত (২৪ বলে ২১), বাংলাদেশের রান তখন ৫৭।
তবে শান্ত ফেরার পর টি-টোয়েন্টির স্বাদ চট্টগ্রামের দর্শককে উপহার দিয়েছেন তামিম ও হৃদয়। দশম ওভারেই পরপর দুই চার মারেন তামিম, পরের ওভারে রাজাকে পরপর দুই চারের পর এক সিঙ্গেলে পৌঁছে গেলেন ফিফটিতে (৩৬ বলে ৬ চার ২ ছক্কায়)।
১২তম ওভারে এনগারাভাকে একটি করে চার মেরেছেন দুজন, পরের ওভারে এন্দলভুর ওপর চড়াও হয়েছেন হৃদয়। ওভারের শেষ তিন বলে দুই চারের মাঝে মেরেছেন ছক্কা! বাংলাদেশের জয় তখন একেবারে হাতের নাগালে।
১৫তম ওভারে মুজারাবানিকে হৃদয়ের দুই চার সেটিকে একেবারে এক বাউন্ডারির দূরত্বে নিয়ে আসে। জঙ্গুয়ের করা ১৬তম ওভারের দ্বিতীয় বলে কাভার ড্রাইভে হিসেবনিকেশ শেষ করে দিলেন তামিম।
১ রানে আউট লিটন
দুই বাঁহাতি ক্রিজে থাকায় জিম্বাবুয়ে অধিনায়ক সিকান্দার রাজা নিজেই বোলিং এসেছেন, আরেক প্রান্ত থেকে বল তুলে দিয়েছেন বেনেটের হাতে। তবে রানরেটের চাপ না থাকায় ব্যাটের প্রতাপ দেখানোর দরকার ছিল না। দুজনই খেলছিলেন স্বচ্ছন্দে। দশম ওভারে এসে ভুলটা করেন নাজমুল। লুক জঙ্গুয়ের প্রথম ওভারে মিড উইকেট দিয়ে ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হয়ে যান। ২৪ বলে এক বাউন্ডারিতে ২১ রানে থামে নাজমুলের ইনিংস। বাংলাদেশের রান তখন ৯.২ ওভারে ২ উইকেটে ৫৭ রান। যদিও জয়ের জন্য ৬৪ বলে ৬৮ রান দূরের লক্ষ্য মনে হচ্ছিল না। ক্রিজে টিকে থাকলেই জয় নিশ্চিত।
তানজিদ অবশ্য শুধু টিকে থাকলেন না, ঝড়ের বেগে বাকি কাজটা শেষ করেছেন। ৩৬ বলে অর্ধশত করে অভিষেক টি-টোয়েন্টি ম্যাচটা স্মরণীয় করে রাখলেন এই বাঁহাতি। এই কীর্তিতে তিনি জুনায়েদ সিদ্দিকীর পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় ব্যাটসম্যান। বিশ্বকাপের বিকল্প ওপেনারের অডিশনেও ইতিবাচক ছাপ রেখে গেলেন।
ম্যাচসেরা তাসকিন-
শেষ পর্যন্ত ৪৭ বলে ৮টি চার ও ২টি ছক্কায় ৬৭ রানে অপরাজিত, স্ট্রাইক রেট ১৪২। তাওহিদ হৃদয় এসে তানজিদের কাজটা আরেকটু সহজ করেছেন। ১৮ বলে করেছেন অপরাজিত ৩৩ রান, ৫টি চার ও ১টি ছক্কায় ১৮৩ স্ট্রাইক রেট। দুজনের সৌজন্যে খেলাটা শেষ হয়ে যায় ২৮ বল আগেই। প্রশ্নাতীত আধিপত্য একেই বলে!