বেহাল দশা ক্যান্সার হাসপাতালের
মেডিকেল রিপোর্টার : বেহাল দশা ক্যান্সার হাসপাতালের। ভুক্তভোগীরা দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলছেন রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালটি নিজেই যেন ক্যানসারে আক্রান্ত। এখানে প্রতিদিন কমপক্ষে দেড় হাজার রোগী আসেন সেবা নিতে। যাদের কখনও না কখনও দরকার হয় রেডিও থেরাপির।কিন্তু রহস্যজনক কারণে অকার্যকর থাকছে রেডিও থেরাপি মেশিন।
জানা যায়, ২০০৬-০৭ সালের দিকে পাঁচটি থেরাপি মেশিন স্থাপনের পর সবশেষ ২০১৪ সালে বসে ছয়টি। তবে কয়েক বছরের মাথায় ৪টি মেশিন পুরোপুরি অকার্যকর ঘোষণা হয়। এখন দুটি মেশিনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কাজ চললেও, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে।
সরেজমিনে মহাখালীর ক্যানসার গবেষণা হাসপাতালে গিযে একাধিক রোগী ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান নিদরুন কষ্টের কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শফিকুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, গত তিন মাস ধরে এই হাসপাতালে ঘুরছেন মায়ের রেডিও থেরাপির সিরিয়াল পেতে।
এর আগে, সার্জারি-কেমোথেরাপিসহ নানা চিকিৎসা করিয়ে নিঃস্ব প্রায় পরিবারটির পক্ষে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার সামর্থ নেই। ঢাবির এই শিক্ষার্থী বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে দুই লাখ টাকার বেশি লাগে এ থেরাপি দিতে। সেটি আমার পরিবারের জন্য এই মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না, ফলে সরকারি হাসপাতালের উপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।
এদিন চার মাস পর রেডিও থেরাপি পেয়েছেন মাগুরার মফিজ শেখ। হেড-নেক ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে গত দেড় বছরে নিস্তেজ হয়ে পড়েছে শরীর, কথা বলা শক্তিও নেই তার। তিনি জানান, ছয় মাসে ধরে হাসপাতালটিতে বিভিন্ন বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন। গেল মাসের শেষ দিকে তার রেডিও থেরাপি শুরু হয়।প্রতিদিন প্রায় ৪শ’র বেশি রেডিও থেরাপির আবেদন জমা পড়ে হাসপাতালটিতে। বর্তমান অক্ষত দুটি মেশিনে দুই’শ রোগীকে এ সেবা দেওয়া গেলেও মাঝেমাঝেই মেশিন নষ্ট হয়ে পড়ে। তখন চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়।
এদিন রোগীরা বলেন, বৃহস্পতিবারও (২ মে) দুপুর পর্যন্ত মেশিন নষ্ট ছিল। ফলে সকাল ৯টা থেকে অপেক্ষা করেও দুপুর ২টার দিকে থেরাপি শুরু হয়।দেশে প্রতি বছর দুই লাখের মতো মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত হয়। এই বিপুল সংখ্যক রোগীর জন্য একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতালটিতে প্রতিদিন চিকিৎসা নিতে আসে দেড় হাজারের বেশি রোগী। যাদের প্রত্যেকের জন্য কোনো না কোনা সময় রেডিও থেরাপির দরকার হয়।
জাতীয় এ প্রতিষ্ঠানটিতে রেডিও থেরাপির জন্য কোবল্ট ও লিনিয়ার মিলে ৫টি মেশিন স্থাপন হয় ২০০৭ সালের দিকে। সবশেষ লিনিয়ার মেশিনটি স্থাপন হয় ২০১৪ সালে। এরই মধ্যে চারটি মেশিন স্থায়ীভাব বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।সচল দুটি মেশিনে দুই’শ মানুষকে সেবা দিতে পারলেও অপেক্ষা করতে হয় ৪ মাস। সময় মতো থেরাপি না দেওয়ায় রোগী শরীরে ক্যানসার ছড়িয়ে পড়ে, ফলে মৃত্যুর মুখে পড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিওলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রকিব উদ্দীন আহমেদ বলেন, চিকিৎসা যখন দরকার তখন না দিলে, রোগ যে বাড়ছে না সেটি তো বলার সুযোগ নেই। আমাদের দুটি মেশিনে দুই’শর মতো রোগীকে সেবা দেই, কিন্তু আমাদের কাছে চাহিদা তো জমা পড়ে দুই হাজারের বেশি। আমরা সবাইকে সেবা দিতে পারি না।
তিনি আরও বলেন, অনেক রোগ আছে যেগুলো শুরুতে চিকিৎসা দিলে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। কিন্তু সেটি বিলম্ব হলে তো আর তা সম্ভব হয় না, ফলে রোগী মৃত্যুর দিকে আরও এগিয়ে যায়। এই মুহূর্তে সারাদেশে অন্তত ২০টি রেডিও থেরাপি মেশিন দরকার। তাহলে সাধারণ মানুষ কিছুটা সহজে এই সেবা পাবে।
জানা যায়, গত দুই বছর ধরে একটি মেশিন আনার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। গেল মাসে ক্রয় চূড়ান্ত হলেও এখনও পড়ে আছে বিমানবন্দরে। এ বিষয়ে হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপাক ডা. এম নিজামুল হক বলেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে আমরা চেষ্টা করে একটি মেশিন ক্রয় করতে সক্ষম হয়েছি, সেটি বিমানবন্দরে এসেছে। আরেকটি মেশিন ক্রয় প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, এরপরও আমাদের হাসপাতালে তিনটি বাঙ্কার খালি থাকবে। দ্রুত সেগুলোতে মেশিন স্থাপন করতে পারলে মানুষের ভোগান্তি কিছুটা কমে আসবে।গেল দশ বছরে ২০ লাখের মতো মানুষ ক্যানসার আক্রান্ত হলেও দেশের স্বাস্থ্য খাতে যুক্ত হয়নি কোনো রেডিও থেরাপি মেশিন। উল্টো কার্যাকারিতা হারিয়েছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহীসহ আট হাসপাতালের মেশিনও। এসব হাসপাতালে রেডিও থেরাপির জন্য বিশেষ বাঙ্কার থাকলেও গেল দশ বছরে নতুন কোনো মেশিন কেনা হয়নি।
প্রসঙ্গত, জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮২ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিনশেড ভবনে। চার বছরের মধ্যেই অর্থাৎ, ১৯৮৬ সালে হাসপাতালটিকে মহাখালীর বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত করা হয়।২০১৫ সালের এপ্রিলে সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি) এর সহায়তায় জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ৩শ’তে উন্নীত করা হয়।
হাসপাতালটি বর্তমানে দেশের সবচেয়ে উন্নতমানের ক্যানসার গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এই গবেষণা কেন্দ্রে রেডিয়েশন অনকোলজি, মেডিকেল অনকোলজি, সার্জিক্যাল অনকোলজি, গাইনোকোলজিক্যাল অনকোলজি, পেডিয়াট্রিক হেমাটোলজি এবং অনকোলজিসহ মোট ২৪টি বিভাগ রয়েছে।