খুনীদের মধুকুঞ্জ ট্রাপ-ডাব্লু ডাব্লু জি বাণিজ্য-
শফিক রহমান : খুনীদের মধুকুঞ্জ ট্রাপে পড়েছিল ঘাতকদের হাতে কলকাতায় নিহত এমপি আনোয়ারুর আজিম আনার। গোয়েন্দারা বলেছে, আজীমকে জিম্মি করে তাঁর আপত্তিকর ছবি তুলে দু’দিন আটকে রেখে হুন্ডির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা আদায়ের পরিকল্পনা ছিল কিরার আখতারুজ্জামান শাহীনের।
পরিকল্পনা মত সে আজীম কে তার কলকাতার ভাড়া করা ফ্ল্যাটে নেয় মডেল শিলাস্তির ছবি দেখিয়ে।
ফ্লাটে ঢোকার পর ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে ক্লোরোফর্ম প্রয়োগ করে তাঁকে সংজ্ঞাহীন করা হয়। এসময় আজীমের সঙ্গে শিলাস্তির আপত্তিকর ছবি তুলে কিলার শাহীনরা। কিন্তু অতিরিক্ত চেতনানাশক প্রয়োগে আজীমের জ্ঞান না ফিরলে তাঁকে খুন করা হয়। পরে লাশ টুকরো টুকরো করে খুনিরা। তারা এমপির মোবাইল ফোন নিয়ে বিভিন্ন স্থানে গিয়ে বার্তা পাঠিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। পুলিশ বলছে, দুটি গ্রুপ হত্যাকাণ্ডে জড়িত। একটি গ্রুপ মদদ দিয়েছে, আরেকটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। কিলার আখতারুজ্জামান শাহীনের কলকাতার মধুকুঞ্জ ছাড়াও ছিল আরো বেশ কয়েক নারী নিয়ে ফূর্তির মধুকুঞ্জ আস্তানা।
এরমধ্যে রাজধানীর বারিধারায় একটি মধুকুঞ্জ মিলেছে কিলার আখতারুজ্জামান শাহীনের। পুলিশ এটি ঘিরে রেখেছে। পুলিশ বলেছে, এটি প্রায় তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাট। এখানে দামি আসবাবে সাজানো। বাসার ভেতর নানা ব্র্যান্ডের মদের বোতল ও কাচের জার। এই জারে মদ বানিয়ে বিদেশি লেবেল সাঁটিয়ে বিক্রি করা হয়। সব মিলিয়ে ফ্ল্যাটের মধ্যেই মদ তৈরির আস্ত কারখানা। মাঝেমধ্যে সেখানে বসে নাচ-গানের আসর বসত বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।
এমপি হত্যায় পরিকল্পনাকারী হিসেবে কিলার আকতারুজ্জামান শাহীনের নাম এসেছে। গোয়েন্দারা বলছেন, বন্ধু আজীমকে হত্যার ছক চূড়ান্ত করে গত ১০ মে কলকাতা থেকে দেশে ফিরে বারিধারার ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন শাহীন। এরপর ২০ মে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যায় কিলার শাহীন। শাহীনের বারিধারার এ ফ্ল্যাটে অনেক ‘রাঘববোয়ালের’ যাতায়াত ছিল বলে জানা গেছে। ফ্ল্যাটটি এরই মধ্যে সিলগালা করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। শিগগির সেখানে অভিযান চালানো হতে পারে। এ ছাড়া বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় শাহীনের আরেকটি বাসা সিলগালা করা হয়েছে।
ডাব্লু ডাব্লু জি বাণিজ্য-
গোয়েন্দা সূত্রে মিলেছে ডাব্লু ডাব্লু জি বাণিজ্যে’র দ্বন্দ্বে খুন হয়েছে এমপি আনার। খুনীদের কোড সংকেত হচ্ছে ডাব্লু। এইে ডাব্লু হচ্ছে ওয়াইন (মেদ ), আরেক ডাব্লু হচ্ছে ওমেন (নারী) এবং জি হচ্ছে গোল্ড। কিলার শাহীন এই সুত্রে কাজ করত। ওমেন ডাব্লু দিয়ে শিকার ধরে মদ খাইয়ে মাতাল করে আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যামমেইল করত। আর সর্বশেষ জি দিয়ে গোল্ড পাচার করাত। যে গোর্ড পাচারে সমস্যা সৃষ্টি করাত তাকে ডাব্লু দিয়ে ফাঁসিয়ে কুপোকাত করা হতো। এজন্য কিলার শাহীন তার মধুকুঞ্জের বাড়ির সংখ্যা বাড়িয়েছিল।
আজীম হত্যার মূল অভিযুক্ত কিলার শাহীন একেক সময় একেক বান্ধবীকে নিয়ে চলতে পছন্দ করত। আজীম হত্যার ঘটনায় ঢাকায় গ্রেপ্তার শিলাস্তি রহমান ছাড়াও শাহীনের ২০-২৫ জন বান্ধবীর খোঁজ মিলেছে। বারিধারার বাসায় পার্টিতে তাদের যাতায়াত ছিল। ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের এলাঙ্গী গ্রামে বাংলোবাড়িতেও শাহীন তাদের নিয়ে যেতেন। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সমাজের উঁচু শ্রেণির লোকজনের সঙ্গে শাহীনের ওঠাবসা। দেশে তাঁর কয়েকশ কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ চলছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক তথ্য বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি আখতারুজ্জামান শাহীন দীর্ঘদিন ধরে স্বর্ণ চোরাচালান ও অবৈধ কারবারে জড়িত। বহু বছর দেশের বাইরে থাকায় অনেক দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক তৈরি হয়। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, বিভিন্ন উপায়ে কূটনীতিকদের ম্যানেজ করে তাদের লাগেজে এবং নানা কৌশলে চোরাই স্বর্ণ দেশে আনার কারবার করতেন শাহীন। সেই স্বর্ণের চালান সীমান্ত দিয়ে দেশের বাইরে পাচারে সহায়তা করতেন এমপি আজীমের লোকজন। এমন ঘটনায় জড়িত সন্দেহে একটি পশ্চিমা দেশের কয়েক কূটনীতিকের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া অন্য একটি প্রতারণায় শাহীন জড়িত বলে তথ্য পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে মাঝেমধ্যে বড় ধরনের লটারির আয়োজন হয়। ওই লটারিতে জয়ীরা মোটা অঙ্কের অর্থ পান। সেই লটারির টিকিটের আদলে নকল টিকিট বানাতেন শাহীন। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে সেগুলো বিক্রি করেন। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, গোপন জায়গায় লটারির টিকিট তৈরিতে আজীমকে অংশীদার করেছিলেন শাহীন। পরে স্বর্ণের চোরাচালানের টাকা ও লটারির টিকিটের অর্থ নিয়ে দু’জনের মধ্যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল। এ কারণে আজীমকে হত্যা করা হতে পারে বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দারা।
কোটচাঁদপুরের বাসিন্দা শাহীন একসময় সিঙ্গাপুরের একটি শিপিং কোম্পানিতে চাকরি করতেন। তার আগে মেরিন একাডেমিতে পড়াশোনার পর বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে ঢোকেন। এরপর সিঙ্গাপুর গিয়ে চাকরি নেন। চাকরিতে থাকাকালে ‘ওপি-১’ লটারি পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তবে কয়েক বছর ধরে শাহীন অধিকাংশ সময় বাংলাদেশে অবস্থান করেন। বছরে দু-একবার যুক্তরাষ্ট্রে পরিবারের সদস্যদের কাছে যান। পরিচিতরা জানান, অবৈধ কারবার করে শাহীন কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন।
এদিকে এমপি আজীমকে হত্যার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, ‘যে কোনো হত্যার পেছনে অবশ্যই কারণ থাকে। পূর্বশত্রুতা, টাকা-পয়সার লেনদেন, রাজনৈতিক বিষয় থাকতে পারে।’ ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে এই হত্যা কিনা– উত্তরে তিনি বলেন, ‘হত্যার কারণ সুনির্দিষ্টভাবে আমরা এখনই বলতে পারছি না। কিন্তু সাপোর্টিং অনেক বিষয় জেনেছি। টাকা-পয়সা ছাড়াও ওই এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের একটা বিষয় ছিল। যেহেতু একই সীমান্ত এলাকায় তাদের বাড়ি।’ স্বর্ণ চোরাচালান নিয়ে বিরোধের ব্যাপারে হারুন অর রশীদ বলেন, ‘সব বিষয়ই আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করব। আমরা ভারতে যাই, সেখানে আরও তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।’
ওদিকে হত্যায় জড়িতদের অন্তত চারজন চরমপন্থি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বলে জানিয়েছে পুলিশ। তারা হলো শিমুল ভূঁইয়া, জিহাদ, সিয়াম ও মুস্তাফিজ। তাদের দলনেতা শিমুল ভূঁইয়া। আজীম হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশ ও ভারতে পৃথক মামলা হয়েছে। কলকাতায় মামলাটির তদন্ত করছে সেখানকার সিআইডি। এরই মধ্যে ভারতীয় পুলিশের চার সদস্যের একটি দল বাংলাদেশে এসে গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। আজ রবিবার ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি দল ভারতে গেছেন।