রংপুরের দুঃখ শ্যামাসুন্দরী
স্টাফ রিপোর্টার, রংপুর : একসময়কার ‘শ্যামাসুন্দরী খাল’ ছিল রংপুরের গর্ব এখন হয়ে গেছে দুঃখ। রংপুর মহানগরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া প্রায় ১২২ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী শ্যামাসুন্দরী খাল। ১৮৯০ সালে তৎকালীন ডিমলার দানশীল রাজা জানকী বল্লভ সেন তাঁর মা ‘শ্যামাসুন্দরী’র স্মরণে এ খাল খনন করেছিলেন। শ্যামাসুন্দরীর মতো একটি খাল কেবল রংপুরই নয়, বাংলাদেশেই বিরল। ১৬ কিমি দীর্ঘ এবং স্থানভেদে ৪০ থেকে ১২০ ফুট প্রশস্ত এই খাল পৌর এলাকার উত্তর পশ্চিমে কেল্লাবন্দস্থ ঘাঘট নদী থেকে শুরু হয়ে নগরীর সব পাড়া-মহল্লার বুক চিরে ধাপ পাশারি পাড়া, কেরানী পাড়া, মুন্সী পাড়া, ইঞ্জিনিয়ার পাড়া, গোমস্তা পাড়া, সেন পাড়া, মুলাটোল, তেতুলতলা, নূরপুর, বৈরাগিপাড়া হয়ে মাহীগঞ্জের কেডি ক্যানেল স্পর্শ করে মিশেছে খোকসা ঘাঘট নদীতে।
.
জানা যায়, সে সময় এ অঞ্চল জুড়ে পয় নিষ্কাশনের তেমন ব্যবস্থা না থাকায় জলাবদ্ধতার কারণে ম্যালেরিয়াবাহী মশার উপদ্রব ছিল খুব বেশি। সেই মশার কামড়ে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েই সে সময় মৃত্যুবরণ করেছিলেন রাজমাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী। পরে মাতৃ শোকে বিহ্বল রাজা জানকী বল্লভ এই মরণব্যাধীর হাত থেকে এ অঞ্চলের মানুষকে রক্ষা করতে জলাবদ্ধতা আর ম্যালেরিয়া দূর করার জন্যই মায়ের স্মরণে এ খাল খননের উদ্যোগ নেন। খালের নামকরণ করা হয় ‘শ্যামাসুন্দরী খাল’। খাল খননের জন্য রংপুর পৌরসভা ও জেলা বোর্ডের যৌথ প্রচেষ্টায় ফ্রান্সিস হেনরি স্ক্রাইন সাহেবকে সভাপতি করে গঠিত হয় খাল খনন কমিটি।
এ কমিটিতে ছিলেন : সভাপতি : ফ্রান্সিস হেনরি স্ক্রাইন,সদস্য : ১) রাজা জানকী বল্লভ সেন ২) সৈয়দ আবুল হায়াত ৩) প্রসন্ন নাথ চৌধুরী ৪) অক্ষয়কুমার মুখার্জী ৫) অন্নদাপ্রসাদ সেন ৬) শ্যাম মোহন চক্রবর্তী ৭) পণ্ডিত যাদবেশ্বর তর্করত্ন ৮) কামাখ্যা চরণ মুখার্জী ও ৯) আশুতোষ লাহিড়ী (রংপুর জেলার প্রথম ইঞ্জিনিয়ার)।
.খনন শেষে ১৮৯০ সালে অবিভক্ত বাংলার তদানীন্তন লেঃ গভর্নর অনারেবল স্যার স্টুয়ার্ট কেলভিন বেইলী শ্যামা সুন্দরী খালের উদ্বোধন করেন। কেরামতিয়া মসজিদ ও জজকোর্ট সংলগ্ন এলাকায় সে সময় গড়ে তোলা এ খালের স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। স্মৃতিস্তম্ভে লেখা রয়েছে –
.
‘‘পীড়ার আঁকর ভূমি এই রঙ্গপুর
প্রণালী কাটিয়া তাহা করিবারে দূর
মাতা শ্যামাসুন্দরীর স্মরণের তরে
জানকী বল্লভ সুত এই কীর্তি করে।’’
.
কিন্তু যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে আজ থেকে ১২২ বছর আগে খালটি খনন করেছিলেন রাজা জানকী বল্লভ সেন, কালের বিবর্তন আর জনসংখ্যার আধিক্যে জলাবদ্ধতা দূরীকরণের পরিবর্তে খালটি এখন পরিণত হয়েছে মানুষের মল মূত্র আর বাসাবাড়ির আবর্জনার এক ভাগাড়ে। দখলকারীদের কবলে পড়ে সামান্য এক ড্রেনে পরিণত হয়েছে। খালের অনেক অংশই সংলগ্ন মানুষজন তাদের দখলে কোথাও কোথাও অট্টালিকাও গড়ে তুলেছে। ঐতিহ্যবাহী এ খালকে পুনঃ খনন এবং সংস্কারের দাবিতে বহু আগে থেকেই আন্দোলন-সংগ্রাম করে আসছে জেলা বাসী।
বর্তমানে ঘাঘটের উৎসমুখ তিস্তা নদী থেকে শ্যামাসুন্দরীকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ফলে শ্যামাসুন্দরী স্রোত হারিয়েছে। নদীটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা এখন জরুরি। এজন্য শ্যামাসুন্দরী বাঁচাতে ঘাঘটের উৎসমুখ খুলে দেওয়া, শ্যামাসুন্দরী থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা দরকার বলে বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২৪ উপলক্ষ্যে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) রিভারাইন পিপল ক্লাব এবং গ্রিন ইকো ‘শ্যামাসুন্দরীর কান্না’ শীর্ষক কর্মসূচি পালন করেছে। হাতে হাতে আর্ট পেপারে প্রতিবাদী কথা লিখে বুধবার (৫ জুন) দুপুর ১টায় রংপুর নগরীর আদালত সংলগ্ন শ্যামাসুন্দরীর পাড়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়।
এরপর পদযাত্রা করে রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের দেয়ালে ‘শ্যামাসুন্দরীর কান্না’ লেখা পোস্টার সেঁটে দেওয়া হয়। অবস্থান কর্মসূচিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেন রংপুরের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ। অবস্থান কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদ, লেখক-গবেষক মোস্তফা তোফায়েল, সংস্কৃতি কর্মী সফুরা খাতুন এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিভারাইন পিপল ক্লাবের আহ্বায়ক ছাওমুন পাটোয়ারি সুপ্ত।
বক্তাগণ শ্যামাসুন্দরীর কান্না শোনার দাবি জানান। ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, নদী রক্ষকরা শ্যামাসুন্দরীর কান্না দেখেও না দেখার ভান করে। তাদের সামনে শ্যামাসুন্দরী দখল হচ্ছে, দূষিত হচ্ছে। মাত্র চার কোটি টাকা হলে তিন মাসের মধ্যে শ্যামাসুন্দরীর দখল উচ্ছেদপূর্বক এর দূষণ দূর করা সম্ভব। প্রথমে চাই নদীর সুরক্ষা তারপর এর সৌন্দর্যবর্ধন।মোস্তফা তোফায়েল হোসেন বলেন, শ্যামাসুন্দরীর পাশে এত অসহ্য দুর্গন্ধ যে এর পাশে মানুষ বাস করতে পারছে না। এসেবর জন্য সংশ্লিষ্ট সবার জবাবদিহিতা থাকা প্রয়োজন। সফুরা খাতুন বলেন- ‘ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে থাকা শ্যামাসুন্দরীকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।’
ছাওমুন পাটোয়ারী সুপ্ত বলেন, অযত্নে শ্যামাসুন্দরী মরছে। উৎসমুখ বন্ধ করে শ্যামাসুন্দরীকে বাঁচানো যাবে না।রংপুর সিটি করপোরেশন ও বিভাগ হওয়ার পর থেকে নগরীতে জনসংখ্যা বেড়েছে। শ্যামাসুন্দরী খাল ঘেঁষে তৈরি হয়েছে বড় বড় অট্টালিকা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, রেস্তোরাঁ ও আবাসিক ভবন। এসবের প্রতিদিনের বর্জ্য ফেলা হচ্ছে শ্যামাসুন্দরী খালে। এতে খাল ভরাট হয়ে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।রংপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মেরিনা লাভলী বলেন, ঘাঘটের উৎসমুখ তিস্তা নদী থেকে শ্যামাসুন্দরীকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। ফলে শ্যামাসুন্দরী স্রোত হারিয়েছে। নদীটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা এখন জরুরি। এজন্য শ্যামাসুন্দরী বাঁচাতে ঘাঘটের উৎসমুখ খুলে দেওয়া, শ্যামাসুন্দরী থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করা, দূষণ বন্ধ করা ও বিজ্ঞানসম্মতভাবে খনন করার দাবি জানান তিনি।