অপরাধবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

দুর্নীতিবাজদের ফেসবুকাঘাত

 

 

ছাগল-কাণ্ড তুলে ধরা সাইয়েদের ‘অ্যাকাউন্ট’ স্থগিত-

 

 

লাবণ্য চৌধুরী : এবার ছাগলকান্ডের নায়কের ফেসবুক স্থগিত করা হয়েছে। একেই বলে দুর্নীতিবাজদের ফেসবুকাঘাত! বলা হচ্ছে, তাঁর কর্মকাণ্ড ফেসবুকের নীতিমালার সঙ্গে মেলে না। এ কারণেই অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা হয়েছে।সারা দেশে আলোড়নতোলা সেই ছাগল-কাণ্ড সামনে আনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সাইয়েদ আবদুল্লাহ বলছেন, তাঁর মানবাধিকার লংঘন করেছে ফেসবুক। তাঁর অ্যাকাউন্ট স্থগিত করে ফেসবুক দুর্নীতিবাজদের সুযোগ তৈরী করে দিচ্ছে।

অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল বা অন্যায়ভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনার আধেয়ও সরিয়ে ফেলছে ফেসবুক। কিন্তু নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে শিশুদের জন্য ক্ষতিকর আধেয়, অনলাইন জুয়া, মিথ্যা তথ্য, জাতি ও শ্রেণি বিদ্বেষমূলক প্রচারণা, যৌন উত্তেজনামূলক বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন ইত্যাদি সরিয়ে ফেলছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তাঁর অ্যাকাউন্ট স্থগিতের কারণ ফেসবুকের নীতিমালা বা কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড লঙ্ঘন। অথচ পবিত্র ঈদুল আজহার আগে ১২ লাখ টাকার ছাগলের বায়না করা তরুণ মুশফিকুর রহমান ইফাতের কর্মকাণ্ড, তাঁর পরিচয় এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য (পরে অপসারিত) মো. মতিউর রহমানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে একাধিক পোস্ট দিয়েছিলেন সাইয়েদ আবদুল্লাহ।

পরে মতিউর গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, মুশফিকুর তাঁর ছেলে নন। কিন্তু সাইয়েদ আবদুল্লাহর অনুসন্ধান ও গণমাধ্যমের খবরে বেরিয়ে আসে মুশফিকুর এনবিআরের কর্মকর্তা মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর সন্তান। গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে মতিউর পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য উঠে আসছে।
সরকার গত রোববার মতিউরকে এনবিআরের পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আজ সোমবার তাঁকে সরানো হয়েছে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকেও। এদিকে আদালত মতিউর এবং তাঁর স্ত্রী লায়লা কানিজ ও ছেলে আহমদ তৌফিকুর রহমানের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন।

অ্যাকটিভিস্ট (অধিকারকর্মী) পরিচয় দেওয়া সাইয়েদ আবদুল্লাহ দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, ১৯ জুন পরিবারের ছবি দিয়ে মুশফিকুর ও মতিউরের সম্পর্কের বিষয়টি ফেসবুকে প্রকাশ করার পর রাতে তিনি নোটিফিকেশন পান যে তাঁর অ্যাকাউন্টে কেউ অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছে। তখন দুই ঘণ্টার জন্য ফেসবুক বন্ধ রাখা হয়। এরপর তা পুনরায় চালু হয়। কিন্তু ২২ জুন সকালে তিনি দেখতে পান তাঁর অ্যাকাউন্ট ‘সাসপেন্ড’ বা স্থগিত করা হয়েছে।

সাইয়েদ আবদুল্লাহ বলেন, অ্যাকাউন্ট স্থগিত করার ক্ষেত্রে ফেসবুক তাঁকে নির্দিষ্ট কোনো কারণ বলেনি। তবে জানানো হয়েছে, তাঁর কর্মকাণ্ড ফেসবুকের নীতিমালার সঙ্গে মেলে না। এ কারণেই অ্যাকাউন্ট স্থগিত করা হয়েছে। সাইয়েদের অ্যাকাউন্ট স্থগিত করার ক্ষেত্রে ফেসবুক বলেছে, তারা তিনটি বিষয় অনুমোদন দেয় না-১. এমন কোনো অ্যাকাউন্ট তৈরি করা যা অন্য কারও। ২. প্রতারণার জন্য অন্য কারও ছবি ব্যবহার করা এবং ৩. কোনো পেজ তৈরি করা, যা অন্যের হয়ে কথা বলে। এর মধ্যে কোনটি সাইয়েদ আবদুল্লাহর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা বলা হয়নি।

সাইয়েদ আবদুল্লাহর ধারণা, তাঁর অ্যাকাউন্টের বিরুদ্ধে ফেসবুকের কাছে একাধিক রিপোর্ট (অভিযোগ জানানো) করা হয়েছে। তিনি বলেন, ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে মানুষের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে ফেসবুকের বিরুদ্ধে। তারা নাগরিক সাংবাদিকতাকে উৎসাহিত করছে না; যারা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কথা বলছে, তাদের সুরক্ষা দিতে পারছে না। উল্টো কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ না জানিয়ে অ্যাকাউন্ট স্থগিত করেছে। ফেসবুকের এ আচরণ দুর্নীতিবাজদের উৎসাহিত করবে।

সাইয়েদ আবদুল্লাহর অ্যাকাউন্ট কেন স্থগিত করা হয়েছে, তা জানতে গতকাল রোববার বাংলাদেশে নিয়োগকৃত জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার কাছে ই-মেইল করা হয়। সোমবার ওই জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, ফেসবুক এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

সাম্প্রতিক কালে মেটার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বিষয় ও গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের রিচ (মানুষের সামনে নিয়ে যাওয়া) কমিয়ে দেওয়া, অ্যাকটিভিস্টদের পোস্টের রিচ কমিয়ে দেওয়া এবং ‘শ্যাডো ব্যানিংয়ের (ছায়া নিষেধাজ্ঞা) অভিযোগ উঠেছে। বলা হচ্ছে, ‘অস্বচ্ছ ও জবাবদিহিহীন ‘শ্যাডো ব্যানিং’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নানাভাবে প্রভাবিত ও ব্যাহত করছে।

এ সম্পর্কে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক মো. সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলোর নিজস্ব ব্যবসায়িক নীতিমালা ও সম্পাদকীয় নীতি আছে। সে কারণে অহরহ অনেকের আধেয় বা কনটেন্ট নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে সরিয়ে ফেলা হয় ও অ্যাকাউন্ট সাসপেন্ড করা হয়। তবে ইদানীং কোনো কোনো প্ল্যাটফর্মের সম্পাদকীয় নীতিমালা ও কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। তিনি বলেন, ভুল বা অন্যায়ভাবে সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক বিষয়ে গঠনমূলক সমালোচনার আধেয়ও সরিয়ে ফেলার অভিযোগ আছে। কিন্তু নিজেদের ব্যবসায়িক স্বার্থে শিশুদের জন্য ক্ষতিকর আধেয়, অনলাইন জুয়া, মিথ্যা তথ্য, জাতি ও শ্রেণি বিদ্বেষমূলক প্রচারণা, যৌন উত্তেজনামূলক বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপন ইত্যাদি সরিয়ে ফেলছে না।

চলতি বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইট লিমিটেড (ডিআরএল) ‘নীতি লঙ্ঘন: বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে মেটার প্ল্যাটফর্মে হাজার হাজার জুয়ার বিজ্ঞাপন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশে জুয়া নিষিদ্ধ থাকলেও মেটার ফেসবুক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে প্রচুর জুয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। যেখানে মেটা নিজেই লাভবান হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট খবর

Back to top button