হাসানুর রহমান : এবার রুবেল রব্বানি চক্রে এনসিটিবিতে সিন্ডিকেট টেন্ডার হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। চক্রটি নিজেরা সমঝোতা করে তিনশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার চেষ্ঠা-তদবির অব্যাহত রেখেছে। ভুক্তভোগী নিরীহ প্রেস মালিকরা দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানিয়েছেন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে (এনসিটিবি) বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপাতে এবার সিন্ডিকেটে তিনশ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার তৎপরতা চলছে। এর আগে গত তিন বছর বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপাতে সরকারের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হলেও এবার তা ভেস্তে যাচ্ছে সিন্ডিকেটের কারণে। চলতি বছর সমঝোতার ভিত্তিতে দরপত্রে অংশ নিচ্ছে প্রেস মালিকরা। এতে সরকারের বাড়তি ব্যয় হবে ৩০০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানিয়েছেন, ২০২৫ সালে শিক্ষার্থীদের হাতে ৩৫ কোটি পাঠ্যবই বিনামূল্যে তুলে দেওয়ার হবে। সেই লক্ষ্যে বই ছাপানোর দরপত্র আহ্বান করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। অভিযোগ উঠেছে, বই ছাপানোর কাজ ভাগিয়ে নিতে সমঝোতার ভিত্তিতে দরপত্র দিচ্ছেন মুদ্রাকররা। তাদের এ সমঝোতায় সরকারের গচ্চা যাবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা।
মুদ্রাকররা বলছেন, দরপত্রে গত বছরের চেয়ে এবার কাগজে ৫ শতাংশ বেশি ব্রাইটনেস (উজ্জ্বলতা) ধরা হয়েছে। ফলে কাগজের দাম বাড়বে। এতেই তাদের ৩০০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় হবে। জানা যায়, গত তিন বছর বই ছাপার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র হওয়ায় সরকারের প্রায় ৫০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছিল। কাজ পেতে নির্ধারিত দরের চেয়ে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কমে দরপত্রে অংশ নেয় প্রতিষ্ঠানগুলো। তবে, এবার দর দেওয়া হয়েছে প্রাক্কলিত ব্যয়ের কাছাকাছি। ফলে গতবারের চেয়ে দর বেশি হওয়ায় এবার বই ছাপাতে সরকারের বেশি অর্থ ব্যয় হবে।
এনসিটিবি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আগামী বছর (২০২৫ সাল) প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপাতে ১৬৬০ কোটি টাকার প্রাক্কলন ধরে ৮১৪ লটে ভাগ করে দরপত্র দেওয়ার হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রাথমিকে ৯৮ এবং মাধ্যমিকে ২০০ লটের দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়েছে। দুই দরপত্রেই গত বছরের চেয়ে ১০০ কোটি টাকা বেশি হাঁকানো হয়েছে।
জানা গেছে, গত ২৫ জুন ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির জন্য সাড়ে পাঁচ কোটি বইয়ের জন্য নির্ধারিত ২০০ লট এবং ২৬ জুন প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির সাড়ে চার কোটি বই ছাপানোর জন্য ৯৮ লটের দরপত্র খোলা হয়। দরপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এখানে অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকা বেশি দরে দরপত্র জমা দিয়েছেন মুদ্রাকররা।দরপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চলতি বছরে প্রাথমিকের প্রায় ১০ কোটি বই ছাপা হবে। প্রাথমিকের বই দুই স্তরে দরপত্র আহ্বান করা হয়।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি জন্য ৯৮ লটে সাড়ে চার কোটি বই এবং বাকি তিন শ্রেণি- তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির জন্য ৯৮ লটে বই ছাপা হবে। এর মধ্যে প্রথম স্তরের দরপত্র উন্মুক্ত হয়েছে। এ স্তরের প্রতি ফর্মাবাবদ গত বছর ব্যয় হয়েছিল ১ টাকা ৯০ পয়সা। চলতি বছর সেই ব্যয় ধরা হয়েছে ২ টাকা ৬৫ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ফর্মায় ৭৫ পয়সা ব্যয় বেশি ধরা হয়েছে। এতে সাড়ে ৯৮ লটের বই ছাপাতে সরকারের বাড়তি ব্যয় হবে ৪৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। একইভাবে অন্য ৯৮ লটের জন্য একই ব্যয় ধরা হয় তাহলে সেখানে অতিরিক্ত ৪৬ কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। অর্থাৎ শুধু প্রাথমিক স্তরে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে ৯৪ কোটি টাকা।
একইভাবে মাধ্যমিকে স্তরের ২০০ লট হিসেবে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সাড়ে পাঁচ কোটি বইয়ের দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়েছে। সেখানে গত বছর ফর্মাবাবদ এক টাকা ৫১ পয়সা ব্য়য় ধরা হলেও চলতি বছর তা দুই টাকা ৮০ পয়সা ধরা হয়েছে। অর্থাৎ প্রতি ফর্মায় এক টাকা ২৯ পয়সা বেশি ব্যয় দেখিয়ে কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন মুদ্রাকররা। ফলে এ লটে সরকারের গচ্চা যাচ্ছে প্রায় ৫৫ কোটি টাকা। একইভাবে অষ্টম ও নবম শ্রেণির বইয়ের জন্য ১৫০ ও ১১২ লটের দরপত্র এখনও উন্মুক্ত হয়নি। এ তিন শ্রেণির বইয়ের আকার বড় হওয়ায় সেখানে ফর্মা ও লটের সংখ্যা বেশি। এ স্তরেও একইভাবে সিন্ডিকেট করে দরপত্র জমা দিয়েছেন মুদ্রাকররা। এখানেও ১০০ কোটি টাকা বেশি ব্যয় হবে।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক মশিউর রহমান বলেন, গত বছর প্রাক্কলনের চেয়ে কম দামে বই দিয়েছিলেন মুদ্রাকররা। কিন্তু বই ছিল খুবই নিম্নমানের। চলতি বছর সরকারের পলিসি হলো বইয়ের মানে কোনো আপস হবে না। তাই ৫ শতাংশ ব্রাইটনেস বাড়ানো হয়েছে। এতে কাগজের ‘রিসাইকেলড’(ব্যবহৃত) পাল্প মিশাতে পারবে না। কাগজের পুরুত্ব (জিএসএম) ঠিক থাকবে। এখন ৫ শতাংশ ব্রাইটনেস বাড়তি হওয়ায় বেশি দামে দরপত্র পড়ছে, এটা সত্য। সেজন্য যদি ৩০০ কোটি টাকা বেশি লাগে আমাদের কিছু করার নেই। তবে, চলতি বছর বইয়ের মানে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
গত ৩০ জুন রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এক অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, এ ধরনের বড় কেনাকাটায় যদি সার্ভিস প্রোভাইডাররা নিজেদের মধ্যে সমঝোতা বা বোঝাপড়া করে নেন, তাহলে সরকারের পক্ষে এটা ঠেকানো কঠিন। তবে, চলতি বছর বইয়ের মান রক্ষায় মনিটরিং কঠিন ও জোরদার করার নির্দেশনা রয়েছে। শিশুদের হাতে যারা নিম্নমানের বই তুলে দেওয়ার মতো অপবিত্র কাজ করার চেষ্টা করবেন, তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এবার মান নিয়ে কোনো আপস নয়।বইয়ের মান রক্ষায় আমরা সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) কাছে একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছি। সেই প্রস্তাবের মতামত এখনও আসেনি। চলতি বছর হয়তো সম্ভব হবে না। তবে, আগামী বছর (২০২৬ সাল) থেকে বইয়ের দরপত্রে ভিন্নতা আসবে।’
গত বছর সবচেয়ে নিম্নমানের বই সরবরাহ করেছেন মুদ্রাককরা। নির্বাচনী বছর এবং একটি প্রিন্টিং প্রেসের কাছে সবাই জিম্মি হওয়ায় বইয়ের মান রক্ষায় এনসিটিবি তেমন কিছুই করতে পারেনি। প্রাথমিক স্তরে বইয়ের মান ছিল সবচেয়ে খারাপ। এ স্তরের বেশিরভাগ কাজ পায় অগ্রণী প্রিন্টার্স। এ প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে ছিল মান রক্ষার জন্য নিয়োজিত ইন্সপেকশন এজেন্সি।
তাদের নিম্নমানের বইয়ের তথ্য বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে সরকারপ্রধান ও নীতিনির্ধারকদের কাছে যাওয়ার পর চলতি বছর সব মুদ্রাকরকে ডাকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সেখানে ঢাকা-৮ আসনের সংসদ সদস্য ও সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সদস্য বাহাউদ্দিন নাসিমের কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণের পর সব মুদ্রাকর বৈঠকে বসেন। সিদ্ধান্ত হয় আগামী বছর বইয়ে মান রক্ষা করতে হবে। তাই নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া করে দরপত্র দেয় তারা। সেই বোঝাপড়ায় সরকারের গচ্ছা যাচ্ছে ৩০০ কোটি টাকা।
বই ছাপার বিষয়ে গেল বছর দুটি পক্ষ সক্রিয় ছিল। একটি পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন অগ্রণী প্রিন্টার্সের মালিক কাউসার উজ্জামান রুবেল। অন্য পক্ষে ছিলেন বর্তমান মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি রব্বানী জব্বাব ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম। গত বছর অগ্রণী প্রিন্টার্সের বিরুদ্ধে বিধিবহির্ভূত কাজ দেওয়ার অভিযোগ উঠলেও এবার দুই পক্ষ সমঝোতা করে এক হয়ে দরপত্র দিচ্ছে।
সমঝোতার অংশ হিসেবে গত বছর যেখানে একেকটি লটে ১৫-১৮টি দরপত্র পড়ছিল, সেখানে চলতি বছর কোনোটিতে একটি, কোনোটিতে দুটি আবার কোনোটিতে তিনটি দরপত্র জমা পড়েছে। যে লটে তিনটি দরপত্র পড়েছে, সেগুলোও একই মালিকের তিন প্রতিষ্ঠানের। অভিযোগ উঠেছে, এনসিটিবির এক সদস্য ও সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান এ চক্রের হয়ে কাজ করছেন।
সমঝোতার বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো পক্ষই বিস্তারিত কথা বলতে রাজি হয়নি। তাদের বক্তব্য, ‘সমঝোতা নয়, যে যার মতো দরপত্র দাখিল করছেন।’ তবে, মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘হয়তো এ খাতকে বাঁচানোর জন্য সমঝোতা হয়েছে।’ এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত তিন অর্থবছরে প্রতিযোগিতামূলক বই ছাপা নিশ্চিত করায় সরকারের সাশ্রয় হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২১ সালে সাশ্রয় হয় ৩০০ কোটি টাকা। ২০২২ ও ২০২৩ সালে ১০০ কোটি টাকা করে সাশ্রয় হয়।