নিষিদ্ধ জামায়াত-শিবির
জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাতে ওবায়দুল কাদের দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে এ তথ্য জানান।
শফিক রহমান : ১৪ দলের নেতাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈঠকে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সোমবার গণভবনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ১৪ দলের বৈঠক হয়। বৈঠকের পর রাতে ওবায়দুল কাদের দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে এ তথ্য জানান। তিনি সত্যকথা কে জানান, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।কাদের বলেন, বিএনপি-জামায়াত নৈরাজ্যের মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। জাতীয় স্বার্থে দেশবিরোধী অপশক্তি নির্মূল করার জন্য ১৪ দলের বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন হারানো যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কোনো আইনি অধিকার নেই।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনে নির্বাচন কমিশন। সে সময় ৩৮টি দলের সঙ্গে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী জামায়াতে ইসলামীও নিবন্ধিত হয়।২০০৯ সালের জানুয়ারিতে জামায়াতকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে তরীকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন একটি রিট করেন।
ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাই কোর্ট একটি রুল জারি করে। রাজনৈতিক দল হিসাবে নির্বাচন কমিশনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে।এরই মধ্যে নিবন্ধন বাঁচাতে দলীয় গঠনতন্ত্রে ব্যাপক সংশোধন আনে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াত। গঠনতন্ত্র থেকে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বাদ দিয়ে ‘গণতান্ত্রিক’ রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলা হয়।
রুলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১ অগাস্ট বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হকের বেঞ্চ সংবিধানের সঙ্গে গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক হওয়ায় জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করা হয় ওই রায়ে। ফলে বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র এই ধর্মভিত্তিক দলটির নির্বাচন করার পথ বন্ধ হয়ে যায়।
ওই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন ওই বছরের ৫ অগাস্ট খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। পরে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে। গত বছরের ১৯ নভেম্বর তাও খারিজ করে দেন আদালত। হয়ে গেল।
হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর ২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। তার আগেই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০১৭ সালের মার্চে জামায়াতের জন্য বরাদ্দ মার্কা দাঁড়িপাল্লা প্রতীকের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে গেজেট জারি করে ইসি।আদালতে নিবন্ধন অবৈধ ঘোষিত হওয়ায় জামায়াত দশম এবং একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার যোগ্য বিবেচিত হয়নি। পাশাপাশি স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনেও দলীয়ভাবে অংশ নিতে পারেননি জামায়াত নেতারা। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জামায়াত নেতারা বিভিন্ন নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন।
কারা এই জামায়াতে ইসলামী-
জামায়াতে ইসলামীর সূচনা হয় বিতর্কিত ধর্মীয় রাজনীতিক আবুল আলা মওদুদীর নেতৃত্বে ১৯৪১ সালের ২৬ অগাস্ট, তখন এর নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ।পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর মুসলিম পারিবারিক আইনের বিরোধিতা করায় ১৯৬৪ সালে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হলেও পরে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের বিরোধিতা করে জামায়াত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করতে রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ নামে বিভিন্ন দল গঠন করে জামায়াত ও তার তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ। সে সময় তারা সারা দেশে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাটের মতো যুদ্ধাপরাধ ঘটায়। আদালতে ঘোষিত যুদ্ধাপরাধ মামলার বিভিন্ন রায়ে বিষয়গুলো উঠে আসে।
একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা, উসকানি, হত্যাকাণ্ডে সায় ও সহযোগিতা দেয়ার দায়ে জামায়াতে ইসলামীর তখনকার আমির গোলাম আযমকে টানা ৯০ বছর অথবা আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া যুদ্ধাপরাধের দায়ে দলটির পাঁচ শীর্ষ নেতার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।একাত্তরের ভূমিকার জন্য জামায়াতে ইসলামীকে ‘ক্রিমিনাল দল’ আখ্যায়িত করে একটি রায়ে বলা হয়, দেশের কোনো সংস্থার শীর্ষ পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের থাকা উচিত নয়।
১৯৭১ সালের পর স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় জামায়াতও এর আওতায় পড়ে। বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের সরকার আবার জামায়াতকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ করে দেয়। সেই সুযোগে গোলাম আযম ১৯৭৯ সালে দেশে ফিরে দলের আমিরের দায়িত্ব নেন।
সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত ১৮টি আসন পায় এবং সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দেয়। এরপর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আসন কমে তিনটি হলেও ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াত পায় ১৭ আসন। চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রিসভাতেও জায়গা পান জামায়াতের শীর্ষ দুই নেতা।
একাত্তরে দেশ বিরোধী ন্যক্কারজনক ভূমিকার পরও খালেদা জিয়ার চার দলীয় জোট সরকারের সময়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেওয়াকে লাখো শহীদের প্রতি ‘চপেটাঘাত’ হিসেবে বর্ণনা করা হয় যুদ্ধাপরাধের এক মামলার রায়ে।সর্বশেষ ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে দুটি আসন পায় জামায়াতে ইসলামী। এরপর তারা আর ভোট করতে পারেনি।