শফিক রহমান : রুপগঞ্জের সন্ত্রাস গাজী-দাদা’র এখন দর্পচূর্ণ! নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জের অপরাধজগৎ এর মুকুটহীন সম্রাট ছিল সাবেক বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। এই সেই গাজী এখন পুলিশের কব্জায়। তাকে ৬ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। ধুরন্ধর এই সাবেক মন্ত্রী সুযোগ বুঝে কোপ মারতেন। তার সকল অপকের্মর সহযোগী ছিল এপিএস এমদাদুল হক ওরফে দাদা এমদাদ। এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন গোটা উপজেলাজুড়ে। তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে থানায় অসংখ্য মামলা রয়েছে। অনুসন্ধান বলছে, চিহ্নিত এই সন্ত্রাসীদের নিয়ে গাজী জিম্মি করে রেখেছিলেন রূপগঞ্জকে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানায় করা হত্যা মামলায় সাবেক মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর ছয়দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।রোববার (২৫ আগস্ট) বিকেলে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আদালতে নেওয়া হলে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাজী মোহাম্মদ মোহসেন শুনানি শেষে ছয়দিনের মঞ্জুর করেন।কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক আব্দুর রশিদ বিষয়টি নিশ্চিত করে দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে শুনানি শেষে আদালত ছয়দিনের মঞ্জুর করেছেন।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাবেক মন্ত্রী ও এমপি গোলাম দস্তগীর গাজীকে কিশোর রোমান মিয়া হত্যা মামলায় ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়েছিল। আদালত উভয়পক্ষের শুনানি শেষে ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।এর আগে গত শনিবার রাতে গোলাম দস্তগীর গাজীকে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ডিবির একটি দল শান্তিনগরে এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে রূপগঞ্জের নবকিশলয় হাইস্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী রোমান মিয়া হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। গত ২১ আগস্ট নিহতের খালা রিনা বাদি হয়ে মামলাটি করেন।
গাজী-দাদার অপরাধজগত-
নারায়ণগঞ্জ রূপগঞ্জের অপরাধজগৎ এর মুকুটহীন সম্রাট ছিলেন বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। ধুরন্ধর এই মন্ত্রী সুযোগ বুঝে কোপ মারতেন। তার সকল অপকের্মর সহযোগী ছিল এপিএস এমদাদুল হক ওরফে দাদা এমদাদ। এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের নিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন গোটা উপজেলাজুড়ে। তাঁর সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রায় প্রত্যেকের বিরুদ্ধে থানায় অসংখ্য মামলা রয়েছে। অনুসন্ধান বলছে, চিহ্নিত এই সন্ত্রাসীদের নিয়ে গাজী জিম্মি করে রেখেছিলেন রূপগঞ্জকে।
নিরীহ মানুষের জমি দখল, খুন, গুম, ধর্ষণসহ গুরুতর সব অপরাধ করে বেড়াচ্ছিল গাজী বাহিনী। রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ কেউ আইনের আশ্রয় নিলেও বিভিন্ন মামলার দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি। প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে সন্ত্রাসীরা। উল্টো মামলা করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের রোষানলে পড়তে হয় এলাকাবাসীকে।
গাজীবাহিনী অন্যতম দুধর্ষ ক্যাডার ছিল রূপগঞ্জের চনপাড়া পুনর্বাসন কেন্দ্র এলাকার হাসমত দয়ার ছেলে শমসের আলী খান ওরফে ডাকু শমসের। এর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কাঁপত পুরো এলাকা।কায়েতপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য শমসেরের বিরুদ্ধে হত্যা, চাঁদাবাজি ও মাদকের একাধিক মামলা রয়েছে। নির্বাচনের আগেই রূপগঞ্জ থানায় হওয়া ১৩টি মামলার আসামি ছিলেন। ইউপি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এলাকায় প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি, গুম, খুন, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তাঁর হাতে। চনপাড়ার বাসিন্দাদের মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসাসহ নানা অপকর্মে যুক্ত হতে বাধ্য করেন।সম্প্রতি আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা সুমাইয়া আক্তারের (২০) ওপর অমানবিক নির্যাতন চালান শমসের। প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ত্র হাতে মহড়া দিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টির মাধ্যমে আলোচিত চনপাড়া বস্তিতে ডনগিরি করছেন শমসের।
গাজীবাহিনীর আরেক ক্যাডার মাছিমপুর এলাকার আফসার উদ্দিনের ছেলে তাওলাদ মেম্বার। এলাকায় নানা অপরাধকর্মকাণ্ড করে ত্রাস সৃষ্টি করেছেন। মন্ত্রীর এপিএস ‘এমদাদের লোক’ পরিচয়ে দেদার অপকর্ম করে বেড়াচ্ছেন। রূপগঞ্জ থানায় তাঁর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ডাকাতি, হত্যার উদ্দেশ্যে মারধর, অবৈধ অস্ত্র বহন এবং মাদকের দুটি মামলা রয়েছে (নম্বর ১১(১০)২২ ও ২২(৮)২৩)। সোনারগাঁ থানায় আছে আরো একটি মামলা এবং সাধারণ ডায়েরি (জিডি)।
একই এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে শেখ ফরিদ মাসুমও নানা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। এলাকায় মাদক ব্যবসায়ী ও অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন সময় সরকারি ও সাধারণ মানুষের সম্পদ লুটপাটের বিস্তর অভিযোগ তাঁর বিরুদ্ধে। এসব অপরাধের পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও হত্যার হুমকির দায়ে রূপগঞ্জ থানায় রয়েছে চারটি মামলা (নম্বর ৯৯(৫)১৮, ২৭(৬)১৬, ৪১(২)০৩ ও ৩৫(১০)০৬)। বর্তমানে তিনি উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল এই সন্ত্রাসীরা।
পূর্ব কালাদী গ্রামের সুরুজ মিয়া মুন্সীর ছেলে মো. আলী হোসেন ওরফে আলী বান্দা মন্ত্রীর এপিএস এমদাদের ছত্রছায়ায় নানা অপকর্ম করে এখন আঙ্গুল ফুলে বটগাছ। তাঁর বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় একটি মামলা রয়েছে (নম্বর ৩৮(১২)২২)। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এলাকার একাধিক মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ভূমি দখল, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ করেন। জানা গেছে, কাঞ্চন পৌরসভা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম রসুল কলির শিষ্য তিনি। তবে এরা গাজীর প্রত্যক্ষ আস্কারায় অপকর্ম করে বেড়ান এমদাদের ছত্রছায়ায়।
গাজী বাহিনীর আরেক ক্যাডার রূপগঞ্জ উপজেলার মুড়াপাড়া ইউনিয়নে তোফায়েল আহমেদ আলমাছ। তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক হত্যা, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগে মামলা রয়েছে। সর্বশেষ মুড়াপাড়ার ব্রাহ্মণগাঁও গ্রামের তারা মিয়ার ছেলে যুবলীগ কর্মী সুমন মিয়া। তাঁকে দিনের বেলা প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় দায়ের মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে তোফায়েল আহমেদ আলমাছকে। এর আগেও এক ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে এবং এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তাঁকে প্রধান আসামি করে মামলা হয়েছে।
মুড়াপাড়ার শিল্পপতি রাসেল পার্কের স্বত্বাধিকারী রাসেল ভুঁইয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তাঁর ফাঁসির আদেশ হয়। ফাঁসির আসামি হয়েও জেল থেকে ছাড়া পান তিনি। গাজীর সান্নিধ্য ও তদবির কাজে লাগিয়ে ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বনে যান তিনি। চেয়ারম্যান হওয়ার পর তাঁর চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আরো বেড়ে যায়। রূপগঞ্জ থানায় তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কিছু মামলা রয়েছে।
গাজী বাহিনীর আরেক সন্ত্রাস মাছিমপুরের মাদক ব্যবসায়ী, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী, লুটপাট, চাঁদাবাজি, হত্যার হুমকি, ইয়াবা ব্যবসায়ী মো. মামুন মিয়া। তাঁর বিরুদ্ধেও রূপগঞ্জ থানায় আছে বেশ কিছু মামলা। উল্লেখযোগ্য মামলার নম্বরগুলো হলো ৫৮(১)২৩, ১১(১০)২২, ১২(১০)২১ ও ১২(৮)২৩। রূপগঞ্জের চনপাড়ার আমেরিকান সিটির উত্তর পাশের ত্রাস খ্যাত আব্দুল মতিন। মন্ত্রীর এপিএস এমদাদের একান্ত সহযোগী হিসেবেও পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে আছে একাধিক মামলা। থানা সূত্র বলছে, সব মামলায় জামিনে আছেন তিনি। রূপগঞ্জ থানার এফআইআর নম্বর ২, পহেলা জুলাই, ২০২১ তারিখে করা অস্ত্র আইনে এজাহারভুক্ত আসামিও তিনি।
গাজী বাহিনীর আরেক ত্রাস মাছিমপুরের মাদক ব্যবসায়ী, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী, লুটপাট, চাঁদাবাজি, হত্যার হুমকিদাতা ও ইয়াবা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রনি মিয়া। রূপগঞ্জ থানার এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। রূপগঞ্জ থানার মিরকুটিরছেও এলাকার বাসিন্দা মো. রাশেদুল থানায় করা অভিযোগে উল্লেখ করেন, চলতি বছর ৫ আগস্ট তারিখে তিনি মিরকুটিরছেও চৌরাস্তায় যাওয়ার পথে মো. রনির নেতৃত্বে পাঁচ থেকে ছয়জন জোটবদ্ধ হয়ে শানদা, রামদা, সুইচ গিয়ার, চায়নিজ কুড়াল, লোহার রড দিয়ে তাঁর গতিরোধ করে। তাঁকে খুন করার উদ্দেশ্যে ঘাড়ের ওপর পোঁচ দেয়। এতে তিনি জখম হয়ে রক্তাক্ত হন। এভাবে ত্রাস সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে মাঝেমধ্যেই রনি বিভিন্ন মানুষের ওপর হামলে পড়ে বলে অভিযোগ রয়েছে। কালাদী গ্রামের আনিসুর রহমান খোকন তাঁর শিষ্য বলে জানা গেছে। খোকনের বিরুদ্ধে রূপগঞ্জ থানায় বেশ কিছু মামলা রয়েছে। কেন্দুয়া গ্রামের আব্দুল লতিফের ছেলে মতিউর রহমান। উঠতি বয়স থেকেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন।
রূপগঞ্জের কাঞ্চন গ্রামের বাসিন্দা শফিকুর রহমান মোল্লার স্ত্রী উম্মে কুলসুম ২০২২ সালের মার্চে রূপগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেন। সেখানে কুলসুম অভিযোগ করেন, একই বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে মতিউরের নেতৃত্বে ৮-১০ জন জোটবদ্ধ হয়ে ধারালো অস্ত্র, রামদা, চাপাতি, লোহার রড, স্টিলের এসএস পাইপ, লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে তাঁর স্বামীর গতিরোধ করে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। এতে শফিকুর রহমান মোল্লার শরীরে জখম হয়। খুন করার উদ্দেশ্যে গলা চেপে ধরে ওই মামলার এক নম্বর আসামি গোলাম রসুল ধারালো রামদা দিয়ে খুন করার উদ্দেশ্যে সজোরে তাঁর স্বামীর মাথায় কোপ দেন। এতে ব্যাপক ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এলাকাবাসী বলছে, এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করাই তাঁদের উদ্দেশ্য।
গাজী বাহিনীর আরেক সন্ত্রাস মাছিমপুরের ত্রাস আব্দুল হামিদ। চলতি বছর জুন মাসের ৪ তারিখে তাঁর কাছ থেকে পুলিশ অবৈধ অস্ত্র ও গুলি, চায়নিজ কুড়াল ও লোহার পাইপ জব্দ করে। রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া বাজার এলাকায় ডালিম মেম্বারের অফিসের পাশে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এ সময় একজন গুলিবিদ্ধ হয়, সেই ঘটনার খবর পেয়ে রূপগঞ্জ থানার সাব ইন্সপেক্টর শায়খ মাহমুদ রিয়াদের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে আব্দুল হামিদকে। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে অপরাধ বাড়িয়ে দেন। মাছিমপুরের সামসুল হকের ছেলে রাকিব ওরফে গুই, নসুর উল্লাহর ছেলে নোমান, কালাদী গ্রামের হাজী মোজাম্মেলের ছেলে লোহা শাহীনসহ বড় একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে রূপগঞ্জের আন্ডারওয়ার্ল্ড বলে অনুসন্ধানে উঠে আছে।