বনখেকো একেআজাদের তেলেসমাতি
স্টাফ রিপোর্টার : গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নে শালবনের বুক চিড়ে বিস্তৃত এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে হা-মীম ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক। বনের জমি জবরদখল করে গড়ে তোলা হা-মীমের এ সাম্রাজ্যকে কেন্দ্র করে গ্রুপটির মালিক এ কে আজাদের সঙ্গে বন বিভাগের দ্বন্দ্ব চলছে প্রায় দুই দশক ধরে। বনখেকো এ কে আজাদের অর্থ, পেশিশক্তি আর রাজনৈতিক প্রভাব ও দাপটের কাছে সব সময়ই বন বিভাগসহ স্থানীয় প্রশাসন অসহায়ত্ব স্বীকার করে এসেছে। হা-মীম গ্রুপের বেদখল করে নেওয়া বনের জমি উদ্ধার তো হয়ইনি বরং আরও নতুন জমি জবরদখল করা হয়েছে।
বন বিভাগ বলছে, এ শিল্প পার্কটি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি অবজ্ঞা করা হয়েছে। হা-মীমের শিল্পপার্ক গড়ে উঠেছে বনের ভেতরে। এর বেশির ভাগই নিচু জমি, যা স্থানীয় ভাষায় ‘বাইদ’ নামে পরিচিত। বাইদ ভরাট করে গড়ে তোলা শিল্প-কারখানার বর্জ্য ও বিষাক্ত (টক্সিক) রাসায়নিক পদার্থের উৎকট দুর্গন্ধ স্থানীয় জনস্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। হা-মীমের ওই শিল্পপার্কটি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকাব্যাপী বিস্তৃত। একপাশে দাঁড়িয়ে তাকালে অপর পাশ দেখা বা অনুমান করার উপায় নেই। শিল্পপার্কের অভ্যন্তরে যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করতে হয় সাইকেল, মোটরবাইক বা গাড়ি। এখানে প্রতিষ্ঠিত কারখানাগুলো হলো হা-মীম ডেনিমস লিমিটেড, হা-মীম স্পিনিং লিমিটেড এবং হা-মীম টেক্সটাইল লিমিটেড।
জানা যায়, বন বিভাগ হা-মীম গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রথম মামলাটি দায়ের করে ২০০৭ সালে। সে মামলা আজ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি। এরপর দফায় দফায় বন বিভাগের আরও জমি দখলে নিলে ২০১৮ সালে আরেকটি মামলা করা হয়। অন্যদিকে বন বিভাগকে ঠেকাতে চারটি মামলা দিয়ে রেখেছে হা-মীম গ্রুপ।
বন বিভাগের দ্বিতীয় মামলাটির প্রেক্ষাপট ছিল হা-মীম গ্রুপের পুনরায় বনের জমি জবরদখল। এ সময় বন বিভাগের শ্রীপুর রেঞ্জের তত্ত্বাবধানে শিমলাপাড়া বিটের কর্মকর্তা ও বনরক্ষীরা মিলে প্রায় আট একর জমি হা-মীমের জবরদখল থেকে উদ্ধার করে নতুন বাগান সৃজন করেন। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে হা-মীম গ্রুপের মালিক এ কে আজাদ বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। হা-মীম গ্রুপের পত্রিকা সমকাল-এর তৎকালীন সম্পাদক গোলাম সারওয়ারকে সঙ্গে নিয়ে এ কে আজাদ এক রিপোর্টারের সহযোগিতায় দেখা করেন তৎকালীন বন ও পরিবেশ উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবের সঙ্গে।
উপমন্ত্রী জ্যাকবের সমর্থন নিয়ে বনের জমি বেশি করে জবরদখল করা হয়। এর অসৎ উদ্দেশ্যটি ছিল কোনো কারণে যদি বনের জমি ছাড়তে হয় তাহলে যেন আগের দখল করা অংশটুকু থেকে যায়। একদিকে তৎকালীন বন ও পরিবেশ উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকবকে দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করে বন বিভাগের লোকজনকে বাড়াবাড়ি না করে চুপ রাখা হয়। অন্যদিকে ওই একই সময়ে শিমলাপাড়া বিটে সশস্ত্র মহড়া দেয় হা-মীম গ্রুপের স্বত্বাধিকারী এ কে আজাদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসী সাইফুল ইসলাম ও তার সহযোগীরা। প্রায় ২০ জনের সেই দলের প্রত্যেকে অস্ত্রশস্ত্র উঁচিয়ে শাসিয়ে যায় শিমলাপাড়া বিটের সবাইকে।
একজন বন কর্মকর্তা জানান, ওই সময় শিমলাপাড়া বিট থেকে একজনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সাইফুল ও তার সহযোগীরা। বন বিভাগ স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে আপসরফা করে অপহৃত ওই বনকর্মীকে ১৫ দিন পর উদ্ধার করে আনে। ওই ঘটনায় একটি মামলা করার চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু বনের তৎকালীন কর্মকর্তারা পরবর্তী নিরাপত্তার স্বার্থে তা আর করেননি।
ওই বন কর্মকর্তা বলেন, ওই ঘটনার পর থেকে বন বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিট এবং রেঞ্জ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সব সময় আতঙ্কে থাকেন। ভয়ে কেউ হা-মীম গ্রুপের কাউকে কিছু বলতে যান না। কয়েক মাস আগে বনের জমি উদ্ধারে বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নতুন করে মামলা দায়েরের নির্দেশ দিলেও তা পালন করতে ভয় পান সংশ্লিষ্ট বনকর্মীরা।
এক বন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি বা আমাদের কেউ এখন হা-মীমের আশপাশেও যাই না। ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী বন বিভাগের মোট ১৬ একর (প্রায় ৫২ বিঘা) জমি হা-মীম গ্রুপ কর্তৃক জবরদখল করা আছে। ঠিকমতো রেকর্ড পরিমাপ করলে দেখা যাবে, জবরদখল করা জমির পরিমাণ আরও অনেক বেশি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হয় প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমীর হোসাইন চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এ কে আজাদের সঙ্গে বন বিভাগের দ্বন্দ্ব দীর্ঘ সময় ধরে চলে আসছে। বিভিন্ন সময়ে আমরা আইনগত পরিধি অনুযায়ী এগিয়ে যেতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তা কাজে আসেনি।’
গত জুলাইয়ে সাক্ষাৎ করে এ ব্যাপারে মন্তব্য চাইলে গাজীপুর জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব ও এলএ) সৈয়দ ফয়েজুল ইসলাম দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, ‘জবরদখলকারীর বিরুদ্ধে নিয়মানুযায়ী বন বিভাগ থেকে একটা উচ্ছেদ প্রস্তাব জেলা প্রশাসনের এই দপ্তরে পাঠানো হয়। সেটি হাতে পেলে আমরা উচ্ছেদের ব্যবস্থা নিয়ে থাকি। হা-মীম গ্রুপের বিরুদ্ধে কোনো উচ্ছেদ নোটিশ আমরা পাইনি।’ এ ব্যাপারে ঢাকা কেন্দ্রীয় বন বিভাগের বন সংরক্ষক হোসাইন মুহাম্মদ নিশাদ বলেন, নিয়মানুযায়ী মামলা বিচারাধীন থাকলে তা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত উচ্ছেদ প্রস্তাব পাঠানো যায় না।
এদিকে বনের অভ্যন্তরে হা-মীম গ্রুপের বিস্তৃত জমির সঙ্গে লাগোয়া ব্যক্তিমালিকানার জমি পেলেই তা কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেন এ কে আজাদ। জমি কিনতে এলাকাভেদে তার একাধিক এজেন্ট কমিশন বা কন্ট্রাক্ট ভিত্তিতে লোক নিয়োজিত আছে। এমনই একজন স্থানীয় মুলাইদ গ্রামের নাজমুল। ব্যক্তিমালিকানার জমির সঙ্গে যুক্ত বন বিভাগের জমি বা খাস জমি শনাক্তকরণ করে কিনতে সহযোগিতা করেন ওই নাজমুল। এরপর ওই জমি কেনার লোভনীয় দরের প্রস্তাব দিয়ে ফাঁদে ফেলা হয় জমির মালিককে।
অভিযোগ আছে স্থানীয় জমির মালিকদের প্রথমে লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে বায়নাপত্র করা হয়। তারপর জমি দখলে নিয়ে আর অবশিষ্ট অর্থ পরিশোধ করা হয় না।
এ রকমই একজন স্থানীয় তেলিহাটি ইউনিয়নের ধনুয়া মৌজার ফরিদপুর গ্রামের ইব্রাহিম মোল্লা। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার জমি জবরদখল করে নিয়েছে হা-মীম গ্রুপ। বায়নাপত্র করার পর আর আমাকে পাত্তা দিচ্ছে না ওই গ্রুপের লোকজন। আমি জমি ও অর্থ দুটিই হারিয়েছি। আমি তাদের গেট পর্যন্ত যেতে পারি। ভেতরে যেতে পারি না।’ এ সংশ্লিষ্ট যাবতীয় দলিলাদিও দেখান তিনি।
বুধবার (২৮ আগস্ট) মন্তব্য জানতে হা-মীম গ্রুপের কর্ণধার এ কে আজাদের একাধিক ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বরে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে আন্দোলনকারীদের দাবি অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন।
পরিবেশবিষয়ক বেসরকারি সংগঠন পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী হিসেবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সব সময় পরিবেশ সুরক্ষায় অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। অতীতে পরিবেশ সুরক্ষায় আপসহীন জোরালো ভূমিকার কারণে তাকে রাজনৈতিক ও বিত্তবান প্রভাবশালীদের বিরূপ আচরণ ও হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। বর্তমানে উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ায় দেশ ও জনগনের বৃহত্তর স্বার্থে তার সর্বোচ্চ আইনগত বিধিবিধান প্রয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে লিগ্যাল প্রসেস বা আইনগত প্রক্রিয়াটাই আমরা অনুসরণ করব। এত বছর ধরে যে বনের ভেতরে কারখানাগুলো চলছে, তার জন্য হয় রাজনৈতিক প্রভাব আছে, নয়তো বন বিভাগের লোকজনের যোগসাজশ আছে। আমাকে বুঝতে হবে যে ভূমির রেকর্ড টেম্পারিং হয়েছে কি না। যদি তা হয়ে থাকে এবং দেখা যায় যে দখলকারীর কোনো ভূমি রেকর্ড নাই বা যেটা আছে সেটা সঠিক নয়, তাহলে তো বনের জমি উদ্ধারে পদক্ষেপটা সহজ হয়ে যাবে। মূলত আইনগত দিকটাতেই জোর দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, ‘অনেক সময় বন বিভাগের পক্ষে জমি দখল সম্পর্কিত অনেক মামলা আমি দেখেছি। প্রতিটি লিগ্যাল স্টেপেই বন বিভাগ হেরে যায়। যদিও গেজেট অনুযায়ী ভূমির রেকর্ড ও বাউন্ডারি লাইন করার ক্ষমতা বন বিভাগেরই রয়েছে। তারপরও বন বিভাগ হেরে যায়। প্রচলিত আইন অনুযায়ী যদি দেখি বন বিভাগের লিগ্যাল অবস্থান শক্ত আছে, তাহলে আমি অবশ্যই সে জমি রক্ষায় আমার আইনগত সব শক্তি প্রয়োগ করব।’ সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা আইন মেনে সংস্কার করব। আইনি ধারায় সংস্কার করব। বন ও ভূমিসংক্রান্ত বিদ্যমান আইন যতক্ষণ পর্যন্ত না সংস্কার করা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আমি বিদ্যমান আইনেই কথা বলব।’