শফিক রহমান : কোটা সংস্কারের প্রেক্ষাপটে আন্দোলন বেগবান হলে এটি গণআন্দোলনে রুপ নেয়। যার প্রেক্ষাপটে মহা পরাক্রমশালী ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন ঘটে মাত্র ৩৬ দিনে। এরপর বেশ কিছুদিন এ আন্দোলনের কৃতিত্ব বা মাষ্টারমাইন্ড নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি। নিউইয়র্কে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস ছাত্রদের বিশ্বমঞ্চে পরিচয় করে দেওয়ার পর বিষয়টি নতুনভাবে সামনে এসেছে। প্রধান উপদেষ্টা পরিচয় করিয়ে দেন মাষ্টারমাইন্ড মাহফুজ আলমের সঙ্গে। নিউইয়র্কের আলোচনায় ড. ইউনূসও বলেন, সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক ছিল। সেক্ষেত্রে তাঁর কথার সূত্রে তিনিও একজন মাষ্টারমাইন্ড। এরপরই শুরু হয় মূলত আলোচনা।
দেখা গেছে, যেকোনো বড় ধরনের ঘটনার ব্যাখ্যায় তাদের সব সময় সুপারম্যান প্রয়োজন হয়, মাস্টারমাইন্ড প্রয়োজন হয়। বিদেশী ষড়যন্ত্র বা বিদেশী মাস্টার প্ল্যান প্রয়োজন হয়।এই গণঅভ্যুত্থানকেও তাই অনেকে সাধারণ মানুষের গণঅভ্যুত্থান হিসেবে বিশ্বাস করতে রাজি না। অনেকে তাই এর পেছনে আমেরিকার ভূমিকা, ফরহাদ মজহারের ভূমিকা, জামাত-শিবিরের মাস্টার প্ল্যান ইত্যাদি খুঁজে বেড়াচ্ছে। এরই অংশ মাহফুজ আলম এই গণঅভ্যুত্থানের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে।
এটির সূত্রপাত বর্তমান প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলমের একটা স্ট্যাটাস থেকে। উনিই সর্বপ্রথম মাহফুজ আব্দুল্লাহকে এই গণঅভ্যুত্থানের পেছনের ব্রেইন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সেই সাথে আন্দোলন চলাকালীন একটি দৈনিকে একটা রিপোর্ট, যেখানে তাকে “ইন্টেলেকচুয়াল তরুণ” হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছিল, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যাহোক মাহফুজ আব্দুল্লাহ ব্রিলিয়ান্ট এটা সন্দেহাতীত। এই আন্দোলনের শুরুর দিকের দিনগুলোতে কর্মসূচী নির্ধারণে তার কৌশলগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
যেমন প্রথমদিকের বাংলা ব্লকেড (যেটাকে পিনাকী ভট্টাচার্য ভারতীয় ষড়যন্ত্র বলে সন্দেহ করেছিলেন), পরের দিকের কমপ্লিট শাটডাউন, প্রোফাইল পিকচার লাল করা, পরবর্তীতে একদফা ঘোষণা এবং সর্বশেষ লংমার্চ টু ঢাকা তাদের প্রতিটা কর্মসূচীই ছিল ব্রিলিয়ান্ট এবং সময়োপযোগী। এগুলোর যেকোনো একটা যদি না হতো, শুধু তাই না, যদি ঠিক সময় মতো না হতো, তাহলেই হয়তো এই আন্দোলন পথ হারিয়ে ফেলতে পারত। এদিক থেকে এই কর্মসূচীগুলো যার বা যাদের মাথা থেকে এসেছে, তারা সবাই ব্রিলিয়ান্ট, এদেরকে তো মাস্টারমাইন্ড তো বলাই যায়।
ওদিকে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সারাদেশের নেতাকর্মীরা এ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। ঢাকার চারপাশে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা ছাত্রদের সামনে রেখে মাঠের দখল নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিল বলে দাবি করা হয়। যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলনের শেষ দিন পর্যন্ত ছিলেন ছাত্রদলের সাবেক সহসভাপতি মামুন খান। তিনি বলেন, এ আন্দোলনে সব শ্রেণির মানুষ মাঠে নেমেছিল।
বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের ডাকে নেতাকর্মীরা মাঠে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে বিভিন্ন স্পটে নেতৃত্ব দিয়েছে। তাই কাউকে এককভাবে মাস্টারমাইন্ড বলা অনুচিত। এখানে মাস্টারমাইন্ড ইত্যাদি যে আলোচনাগুলো যারা করছে, তারা নিজেদেরকে বিতর্কিত করছে, ছোটো করছে। এ ক্ষেত্রে আন্দোলনে নিজ দল ও নেতার ভূমিকা তুলে ধরে তার প্রশ্ন- কিসের ভিত্তিতে কাকে মাস্টারমাইন্ড বলা হবে?
তিনি বলেন, ঢাকাকে দশটা স্পটে ভাগ করা হয়েছিল। এইটার মাস্টারমাইন্ড কে ছিল? এটার মাস্টারমাইন্ড ছিল আমাদের বিএনপি এবং তারেক রহমান। যেমন এই (যাত্রাবাড়ী) স্পটে আমি ছিলাম এবং আমাদের অনেক নেতাকর্মীরা এই স্পটে ছিল। একবারের জন্যেও আমরা চিন্তা করি নাই যে আমাকে শাহবাগে যেতে হবে, শহীদ মিনারে যেতে হবে। আমরা স্পট আমাকে রাখতে হবে শেষ পর্যন্ত। প্রকৃতপক্ষে মাস্টারমাইন্ড বলতে হলে বলতে হবে শহীদ আবু সাইদকে, মুগ্ধকে, ছাত্রদলের আকরামকে।
জামায়াতের নেতারাও বিভিন্ন সভায় ছাত্রদের পাশাপাশি দলটির অবদানকে সামনে আনছেন। আন্দোলনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতির আত্মপ্রকাশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কমিটি প্রকাশ করার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। অনেকে মনে করেন, আন্দোলনে অবদান তুলে ধরা আর কৃতিত্ব জাহির করতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির আত্মপ্রকাশ করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি মো. আবু সাদিক (কায়েম) বলেন, আন্দোলন যেন বিতর্কিত না হয় সেজন্য পরিচয় গোপন রেখেই তিনি আন্দোলনে সক্রিয়া ভূমিকা রেখেছেন। তবে তার রাজনৈতিক পরিচয় থাকার কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক তালিকায় তিনি ছিলেন না।
‘এ আন্দোলনের শুরু থেকে, ৫ জুন থেকে ৫ অগাস্ট পর্যন্ত পলিসি মেকিং এবং মাঠ পর্যায়ে আন্দোলনের সাথে আমরা যুক্ত ছিলাম। এবং অন্যান্য যে ছাত্র সংগঠনগুলো ছিল ছাত্রদল, বামপন্থী যে ছাত্র সংগঠন সবাই এখানে যুক্ত ছিল’, বলেন আবু সাদিক। আন্দোলনের শুরুর দিকে কোটা সংস্কার তাদের টার্গেট ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, উনিশ তারিখের পর থেকে আপনারা দেখেন নয় দফা সামনে আসে। এই নয় দফার মধ্যেই কিন্তু একদফা ছিল।
আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড প্রসঙ্গে সাদিকের বক্তব্য, যারা শহীদরা আছে তারা হচ্ছে মূল মাস্টারমাইন্ড। এই শহীদদের মাধ্যমে আমরা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি। সকল ছাত্র সংগঠনের পরিকল্পনা ছিল, পাশাপাশি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এ আন্দোলনের ভ্যানগার্ড হিসেবে কাজ করেছে। এখানকার সকল সমন্বয়করা মাস্টারমাইন্ড ছিল। পাশাপাশি মাহফুজ আব্দুল্লাহ ভাইও একজন মাস্টারমাইন্ড ছিল।
এ আন্দোলনের গতিবিধি অনুযায়ী দুটি পর্যায়ে বিভক্ত ছিল। প্রথমটি কোটা সংস্কার আন্দোলন, পরের ধাপে হয় গণঅভ্যুত্থান। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা এবং ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাইদ হত্যার পর আন্দোলন ভিন্ন মাত্রা পায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ছাত্রদের হল ছাড়তে বাধ্য করার পর ১৮ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মাঠে নামে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলন শুরু হলেও এ আন্দোলনে এক পর্যায়ে নজিরবিহীন ভূমিকা রাখে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষার্থী, সমন্বয়ক এবং সংগঠনগুলো আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলতে সারা দেশের ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অবদানের কথা স্বীকার করেন।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন সমন্বয়ক কাওসার হাবিব বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা হল ছাড়া হয়, তখন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হাল ধরে আন্দোলনের।
তিনি বলেন, আন্দোলনের বড় স্টেকহোল্ডার কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ছিল। আমাদের প্রগতি সরণিতে নর্থসাউথ, ব্র্যাক, ইস্টওয়েস্ট, আইইউবি, এআইইউবিসহ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের আন্দোলনকে মূলধারার আন্দোলনে নিয়ে যায় এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনের মাধ্যমে আসলে এই স্বৈরাচের পতন ত্বরান্বিত হয়। পরবর্তীতে সকল রাজনৈতিক দল সর্বস্তরের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে নেমে আসে।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস ইউল্যাবের শিক্ষার্থী আন্দোলনের একজন সমন্বয়ক শ্যামলি সুলতানা বলেন, এ আন্দোলনে সাধারণ মানুষের অবদান সবার আগে স্বীকার করতে হবে। আমাদের তথাকথিত সমাজব্যবস্থায় এই যে নিম্নশ্রেণির পেশাজীবী মানুষ যাদেরকে বলা হয়, তাদের অবদানের কথা কিন্তু আমরা বলি না। তাদের অবদান যদি না থাকতো এ আন্দোলন কখনো গণঅভ্যুত্থানে কিন্তু পরিণত হতে পারতো না।
তিনি বলেন, এই আন্দোলনটা সফল হতে সবচাইতে বেশি অবদান রেখেছে তারাই, যারা রক্ত ঝরিয়েছে, শহীদ হয়েছে। কারণ তাদের রক্ত বা মৃত্যুর পরে যে অনুপ্রেরণা, যে সাহস, যে স্পৃহা আমাদের মধ্যে ছিল এটা মনে হয় না যে অন্য কোনো কারণে আমাদের মধ্যে আসতো।
জুলাই-অগাস্ট অভ্যুত্থানের শুরুটা হয় সাধারণ ছাত্রদের ব্যানারে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি হয়। ছাত্র নির্যাতের প্রতিবাদে মাঠে নামে দেশের আপামর জনতা, সাধারণ মানুষ। প্রতিবাদে করে শিক্ষক, পেশাজীবীরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ বলেন, সবমিলিয়ে এ দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ ছিল এ সরকারের উপর। একটা সুযোগ খুঁজেছিল এ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য। সেই ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য এ দেশের মানুষ যখন একসাথে রাস্তায় নেমে এসেছে তখন সরকারের পতন ঘটেছে। এটা পরিকল্পিত ছিল না, কেউ মাস্টারমাইন্ডও ছিল না।
৩৬ দিনের গণআন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৮ জুলাইয়ের পর। এ পর্যায়ে সরকারের ছাত্রদের ওপর হামলা মামলা ও গুলির পর ৯ দফা থেকে এক দফার আন্দোলন সৃষ্টি হয়। দেশের নারী পুরুষ নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ প্রতিবাদ করে। রাস্তায় নেমে আসে।
মাসুদ বলছেন, এটার ক্রেডিট প্রধানত এ দেশের মানুষ, এ দেশের জনগণ, এ দেশের ছাত্রসমাজ, এ দেশের শ্রমিক, এ দেশের নাগরিকদের। মানুষ নেতৃত্ব হিসেবে আমাদেরকেই গ্রহণ করেছে এবং আমাদের ডাকেই মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো আমাদের ডাকেই রাজপথে এসেছে। তারা সকল রাজনৈতিক দলকে একসাথে করে রাজপথে নামাতে ব্যর্থ হয়েছে, যার কারণে আমরা ষোলোটা বছর একটা স্বৈরাচারী ফ্যাসিবাদী শাসনে শাসিত হয়েছি।
ছাত্র আন্দোলনকে সফল করতে অতীতের বিভিন্ন আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রস্তুতি নেয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়করা। চারটি লেয়ারে সমন্বয়কদের ভাগ করা হয়। প্রথম স্তরের ছাত্র নেতাদের গ্রেপ্তারের পর দায়িত্ব নেয় দ্বিতীয় স্তরের থাকা সমন্বয়করা। প্রস্তুত রাখা হয় তৃতীয় চতুর্থ স্তর। অভিনব কর্মসূচি এবং দফাভিত্তিক আন্দোলন কীভাবে এগুবে সেগুলো নির্ধারিত হয় নেপথ্যে থেকে।
সমন্বয়করা বলেন, এ আন্দোলন থেকে সরকারের পতন ঘটানোর কোনো পরিকল্পনা শুরু থেকে ছিল না। তবে আন্দোলনে ব্যাপক প্রাণহানি এবং নির্যাতনের পর মানুষ যখন ক্ষুব্ধ হয়, তখন এই আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে পরিণত হয়।
এ ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক এবং বর্তমানে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, একেবারেই এটা আমরা যারা স্টুডেন্টরা ছিলাম বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের, তারা সমন্বয় করেই এ আন্দোলন পরিচালনা করেছি। হ্যাঁ এ আন্দোলনে তো বিভিন্ন শ্রেণিপেশার, দল-মতের, রাজনৈতিক বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীরা কিন্তু অংশগ্রহণ করেছে। তার মানে এই না যে তাদের সাথে কোনো ধরনের যোগাযোগ বা কোনো ধরনের পরিকল্পনার ভিতর থেকে এই অভ্যুত্থান হয়েছে।