আইন আদালতবিশেষ প্রতিবেদনশিল্প-সাহিত্য

দুদকের কব্জায় লাকি-নিয়োগ জালিয়াতি-ফেল করাদের চাকরি

লাবণ্য চৌধুরী : অবশেষে বাংলাদেশ শিল্পকলার ‘শিল্পিত ডাকাত’ নামধারী লাকি ধরা খাচ্ছে। শিল্পকলা একাডেমীর সাবেক মহাপরিচালক জনাব মোহাম্মদ লিয়াকত আলী (লাকি) এবং পরিচালক (প্রশাসন) জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরীসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ থেকে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুদকের বিশেষ অনুবিভাগের উপপরিচালক সুমিত্রা সেন বাদী হয়ে রবিবার (৬ অক্টোবর) মামলা দায়ের করেন।

দুর্নীতি দমন কমিশন গঠিত অনুসন্ধান টিম কর্তৃক দাখিলকৃত প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, জনাব লিয়াকত আলী লাকি এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর পরিচালক (প্রশাসন) জাহাঙ্গীর হোসেন চৌধুরী তাদের নিকট সংগৃহীত ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রেরিত বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার নম্বরপত্রে অসৎ উদ্দেশ্যে পরস্পর যোগসাজসে জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার উদ্দেশ্যে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষার নম্বরপত্রে নম্বর বাড়িয়ে অবৈধভাবে ১০টি পদে ২৩ জন প্রার্থীকে নিয়োগ প্রদান করেছেন।

“পরবর্তীতে লিখিত পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ প্রার্থীদের উত্তীর্ণ করে— বিভিন্ন পদে যোগদান করে তাদের বেতনভাতা বাবদ সরকারী তহবিল থেকে গৃহীত ৮ কোটি ২৮ লাখ ৪৯৫ টাকা উত্তোলন করে সরকারী অর্থ আত্মসাৎ/ক্ষতিপূরণপূর্বক দন্ডবিধি, ১৮৬০ এর ৪০৯, ৪২০, ৪৬৮, ৪৭১, ১০৯ ও ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিগণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন” – প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে।
কে এই শিল্পিত ডাকাত লাকি

বহু অপকর্মের নায়ক শিল্পকলার ডাকাত লাকি টানা ৭ বার শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে থেকে লোপাট করেছেন আড়াই হাজার কোটি টাকা। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ২টি তদন্ত কমিটি করলেও লাকির লাগাম টানতে পারেনি। বরং তদন্ত নিষ্পত্তি হওয়ার আগে আবারও তাকেই পুন:নিয়োগ দেয় ডিজি হিসেবে। এরপর শুরু করে প্রকল্প ও নিয়োগ বানিজ্য। তার বিরুদ্ধে রয়েছে বহু অডিট আপত্তি।

মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে ২২৭ কোটি ৭১ লাখ ১৭ হাজার ৪৫৯ টাকার অনিয়মের সন্ধান পেলেও লাকির টিকিটিও ছুতে পারেনি। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত অনুসন্ধান করে এই অনিয়মের তথ্য পাওয়া যায়। মন্ত্রণালয়ের চিফ অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড ফাইন্যান্স অফিসার বলেছেন, লাকি ৭২টি ভয়াবহ অনিয়ম করে ২২৭ কোটি টাকােখেয়ে ফেলেছে।

প্রায় এক যুগ ধরে মহাপরিচালকের দায়িত্বে থাকা লিয়াকত আলী লাকির বিরুদ্ধে অনিয়মের মাধ্যমে ২৬ কোটি টাকা তুলে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে চুক্তিভিত্তিক এক কর্মকর্তাকে সচিবের দায়িত্ব দিয়ে এ অর্থ উত্তোলন করে নেয় লিয়াকত আলী লাকীসহ একটি সিন্ডিকেট।দুদকে দাখিল করা অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, ২০২১ সালের ৩০ জুন শিল্পকলা একাডেমির আগের সচিব নওশাদ হোসেন বদলি হলে সেদিনই নতুন আদেশ জারি করে একাডেমির চুক্তিভিত্তিক পরিচালক সৈয়দা মাহবুবা করিমকে সচিবের দায়িত্ব দেন লাকী। ৩০ জুন থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে প্রায় ২৬ কোটি টাকা বিভিন্ন কৌশলে উত্তোলন করা হয়। সরকারি বরাদ্দের অর্থ খরচ দেখাতেই এমন অনিয়ম দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলে দুদকে দাখিল হওয়া অভিযোগে বলা হয়েছে।

এছাড়া লিয়াকত আলী লাকীর বিরুদ্ধে একাধিক অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। সংগীত বিভাগের কক্ষে ব্যবহারের জন্য পর্দা, ক্রোকারিজ ও ফার্নিচার না কিনে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে অর্থ বরাদ্দ, ডান্স অ্যাগেইনস্ট করোনা কর্মসূচির আওতায় নৃত্যদলের সম্মানী, হার্ডডিস্ক কেনা, ডকুমেন্টেশন, প্রপস-কস্টিউম, প্রচার ও বিবিধ ব্যয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের তোলার অভিযোগ উঠেছে।অভিযোগের বিষয়ে জানতে ডিজি লিয়াকত আলী লাকীর মোবাইলে ফোনে একাধিকবার কল দিলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

দীর্ঘ ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে লিয়াকত আলী লাকি প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ছিলেন। এই পদে থাকাকালে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তবে শত শত অভিযোগ উপেক্ষা করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার তাকেই মহাপরিচালকের দায়িত্ব দিয়ে গেছেন।এর আগে লাকির বিরুদ্ধে চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে। তদন্তে নেমে দুদক শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালককে ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে শিল্পকলার ঢাকা কার্যালয়ে বরাদ্দকৃত বাজেট ও ব্যয়সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র সংবলিত নথির ফটোকপি এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে অব্যয়িত ৩৫ কোটি টাকা ২০২১ সালের ৩০ জুনে ব্যয়করণ-সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র তলব করেছিল।

সংশ্লিষ্ট খবর

Back to top button