তিক্ততায় ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ
কূটনৈতিক রিপোর্টার : বাংলাদেশ ও ভারতের ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কার্যত ভেঙে পড়ার অবস্থায় পৌঁছেছে। গত আগস্ট মাসে শিক্ষার্থী-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে টিকতে না পেরে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে পলায়নের পর থেকেই হিমশীতল পর্যায়ে পৌঁছেছিল দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তবে গত কয়েক সপ্তাহের ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর দিলে সহজেই অনুমেয় যে হিমশীতল অবস্থা থেকে চরম তিক্ত অবস্থার দিকে যাচ্ছে দু’দেশের সম্পর্ক। এই অবস্থার শুরু বাংলাদেশের সম্মিলিত সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের পর। একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার আসামি হিসেবে গত ২৫ নভেম্বর গ্রেপ্তার হন চিন্ময় কৃষ্ণ দাস।
এদিকে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মুক্তির দাবিতে বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন দুই ভারতীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় আন্দোলন শুরু করে বিজেপি এবং তার অন্যান্য মিত্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। সেই ধারাবাহিকতায় সোমবার ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় বাংলাদেশের হাইকমিশন কার্যালয়ে ভাঙচুর চালিয়েছে হিন্দু সংঘর্ষ জোট নামের একটি সংস্থার শতাধিক কর্মী-সমর্থক।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়েছে।অন্যদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারও এ ঘটনাকে ‘খুবই দুঃখজনক’ বলে উল্লেখ করেছে। হাইকমিশন কার্যালয়ে হামলার অভিযোগে ইতোমধ্যে ৭ জনকে গ্রেপ্তারও করেছে ত্রিপুরা পুলিশ।
আপাতভাবে মনে হতে পারে যে শেখ হাসিনার ভারতে পলায়ন এবং চিন্ময় দাসের গ্রেপ্তারই বাংলাদশ এবং ভারতের সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের উৎস বা কারণ; কিন্তু সত্য হলো— এই টানাপোড়েনের শেকড় অনেক গভীরে। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, ভারতের সঙ্গে সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের শেকড় আওয়ামী লীগের বিগত ১৫ বছরের শাসনামলে বিরোধী ও ভিন্নমতালম্বীদের দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের মধ্যে নিহিত।
তবে তা হলেও এ কথা সত্য যে আগস্টে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে ভারতের প্রতি বৈরী মনোভাব নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস গত মাসে এক সাক্ষাৎকারে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শিক্ষার্থী-জনতার ওপর গুলি চালানোর জন্য শেখ হাসিনাকে দায়ী করে বলেছেন, “বাংলাদেশের পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে প্রত্যার্পণের জন্য আমরা ভারতের সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বান জানাব।”
অন্যদিকে, বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে আওয়ামী লীগের এক জনসভায় ভার্চুয়াল মাধ্যমে দেওয়া বক্তব্য দেন শেখ হাসিনা। সেখানে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে শিক্ষার্থী-জনতার হত্যার জন্য ড. মুহম্মদ ইউনূসকে সরাসরি দায়ী করে বলেন, “আজ আমাকে গণহত্যার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। কিন্তু সত্য হলো ইউনূস যাকে সুক্ষ্ম ও নির্ভুল পরিকল্পনার আন্দোলন বলেছেন, সেই আন্দোলনের গণহত্যার সঙ্গে তিনি নিজে যুক্ত।”
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ধর্মীয়সংখ্যালঘু নির্যাতনের সংবাদ পাওয়া গেছে। ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোতে এসব সংবাদ বেশ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়েছে এবং নয়াদিল্লিও আনুষ্ঠানিক ও দাপ্তরিকভাবে এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের সাম্প্রতিক টানাপোড়েনের এটিও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। কারণ, ড. মুহম্মদ ইউনূসের দাবি, যে বাংলাদেশে ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে কোনো জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৈষম্য করা হয় না।
এখানে উল্লেখ্য যে ১৭ কোটি মানুষ অধ্যুষিত বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ হিন্দু এবং ঐতিহাসিক কারণেই এই হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ আওয়ামী লীগের সমর্থক। সরকার পতনের পর পর তদের লক্ষ্য করে বেশ কিছু হামলার ঘটনা ঘটেছে, তা ও সত্য।
শুক্রবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়ালি এক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমাদের অবস্থান একদম পরিষ্কার, আর তা হলো সেই দেশের বর্তমান সরকারকে অবশ্যই ধর্মীয় সংখ্যালঘু সব সম্প্রদায়ের দায়িত্ব নিতে হবে।তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম দাবি করেছেন, অতীতের যে কোনো সরকারের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশেল হিন্দুরা বেশি সুরক্ষিত।বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলা দু’ দেশের সম্পর্কে কেমন প্রভাব ফেলবে?
বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক বলেন, আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন কার্যালয়ে হামলা নিশ্চিতভাবেই দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনাকে আরও বৃদ্ধি করবে। বিগত সরকারের আমলে উভয় দেশের মধ্যে যে স্থিতিশীল সম্পর্ক ছিল, বর্তমানে এটি পুরেপুরি এলোমেলো হয়ে পড়েছে। দুই প্রতিবেশীর মধ্যে দিন দিন আস্থার সংকট প্রকট হচ্ছে। বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়বে কি না, তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলার উপায় নেই।
বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত প্রণয় ভার্মা মঙ্গলবার ভারতের দৈনিক দ্য হিন্দুকে বলেছেন, “বাংলাদেশ এবং ভারতের সম্পর্ক শুধু একটি এজেন্ডার ওপর ভিত্তি করে চলতে পারে না। এই সম্পক্র বহুমাত্রিক এবং উভয় দেশই পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের অংশীদার হতে ইচ্ছুক।”
বাংলাদেশের সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অনিল ত্রিগুনায়েত বলেন, “বাংলাদেশে তথাকথিত মব কালচারের অবসান এবং আইনের শাসন যত শিগগির ফিরে আসবে, ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্কও তত দ্রুত স্বাভাবিক হবে।”