অপরাধ

ইউসিবিতে জাভেদের লুটপাট ২০০০ কোটি

 

লাবণ্য চৌধুরী  :  বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে  সাবেক ভূমি মন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ ২০০০ কোটি টাাক লুটপাট করেছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে। জাভেদের তৎপরতায় নিয়মবহির্ভূতভাবে এই দুই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে জেনেক্স ইনফোসিসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আদনান ইমামের চার প্রতিষ্ঠান। এই ঋণ দিতে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কমিটি কোনো সুপারিশ না করলেও পরিচালনা পর্ষদে তা অনুমোদিত হয়েছে। এর বাইরে যথাযথ প্রক্রিয়া না মেনে জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ার কিনেও লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৪ সালের জুলাই সময়ে এসব অনিয়ম হয়।

ইউসিবির বর্তমান চেয়ারম্যান দুদকে পাঠানো চিঠি থেকে এসব তথ্য মিলেছে। সেখানে আরও বলা হয়, আনিসুজ্জামান, বশির আহমেদসহ অন্য পরিচালকদের অনুমোদনে ২০২১ সালে জেনেক্স ইনফোসিসের ৬০ লাখ ৮৩ হাজার ৬২৬ বিক্রয় অযোগ্য (লকড-ইন) শেয়ার কেনে ইউসিবি। প্রতিটি ১৭২ টাকা ৫০ পয়সা হিসাবে মোট ১০৪ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়।

এসব সম্পর্কে জানতে ইউসিবির চেয়ারম্যান শরীফ জহিরকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন এর ফোন ধরেননি। ম্যাসেজ পাঠানো হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।

দুদক বলেছে, ইউসিবিতে যখন এসব অনিয়ম ঘটে, তখন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী ওরফে জাভেদের স্ত্রী রুকমিলা জামান ও নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁর ভাই আনিসুজ্জামান চৌধুরী। মোহাম্মদ আদনান ইমাম যুক্তরাজ্যের নাগরিক, সে দেশে আবাসন খাতে তাঁর ব্যবসা রয়েছে।সাইফুজ্জামান চৌধুরীর শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ি রয়েছে বলে বিভিন্ন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এসব বাড়ির বর্তমান বাজারমূল্য বাংলাদেশি টাকায় ৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি। আবাসন খাতের সূত্রে এই দুজন বেশ ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।

২০১৮ সালে ইউসিবি দখলে নেয় সাইফুজ্জামানের পরিবার। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ইউসিবির পরিচালনা পর্ষদ পরিবর্তন করে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ব্যাংকটির ঋণের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে একাধিক নিরীক্ষা হয়। এতে ঋণ দেওয়ায় অনিয়মসংক্রান্ত এসব তথ্য উঠে এসেছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে জানিয়েছেন ইউসিবির চেয়ারম্যান শরীফ জহির। তিনি ব্যাংকের আমানতকারী ও শেয়ারধারীদের স্বার্থ রক্ষায় সাইফুজ্জামান চৌধুরী, জেনেক্স ইনফোসিসের শেয়ার বিক্রেতা আমির রসুল ও জাহারা রসুল, আদনান ইমাম এবং ব্যাংকের সাবেক উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর কবিরের (অপু) বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।

ইউসিবি সূত্রে জানা গেছে, জেনেক্স ইনফোসিসকে যে ঋণ দেওয়া হয়েছে, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তা খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে।
এ নিয়ে আদনান ইমামের বক্তব্য জানতে একাধিকবার হোয়াটসঅ্যাপে ফোন ও বার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো জবাব দেননি।সাইফুজ্জামান চৌধুরীর শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টি বাড়ি রয়েছে বলে বিভিন্ন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। এসব বাড়ির বর্তমান বাজারমূল্য বাংলাদেশি টাকায় ৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকার বেশি। আবাসন খাতের সূত্রে এই দুজন বেশ ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে।

শরীফ জহিরের চিঠিতে ব্যাংক দখল হওয়ার পর সাইফুজ্জামান চৌধুরী কীভাবে ব্যাংকের চেয়ারম্যানের ভূমিকা পালন করেছেন, তা তুলে ধরা হয়েছে। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সময়ে তিনি ভূমিমন্ত্রী ছিলেন। তবে দেশের আইন অনুযায়ী, কোনো মন্ত্রী ব্যাংক পরিচালনায় থাকতে পারেন না।

চিঠিতে বলা হয়, ২০১৯ সালে নিয়মবহির্ভূতভাবে বড় অঙ্কের ঋণ বিতরণ করা হয়েছে বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেড, জেনেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড, এ অ্যান্ড পি ভেঞ্চার লিমিটেড, এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্ট এবং এডব্লিউআর রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের স্বার্থে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন করা হয়। ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের সুপারিশ ছাড়াই এই ঋণগুলো অনুমোদিত হয় বলে নিরীক্ষায় উঠে এসেছে। এডব্লিউআর ডেভেলপমেন্ট এবং এডব্লিউআর রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান আদনান ইমামের বাবা চৌধুরী ফজলে ইমাম।

চিঠিতে বলা হয়, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর চাচাতো ভাই আলমগীর কবীর অপুকে সম্পূর্ণ ‘অযৌক্তিকভাবে’ ফার্স্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট পদ থেকে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তিনিই ব্যাংক কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে নিয়মবহির্ভূত ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ নিশ্চিত করেন। সরকার পতনের পরপরই তিনি বিদেশে পালিয়ে যান এবং ই-মেইলের মাধ্যমে নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন। বর্তমানে তিনি বরখাস্ত অবস্থায় আছেন।

দুদকে পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়, আনিসুজ্জামান, বশির আহমেদসহ অন্য পরিচালকদের অনুমোদনে ২০২১ সালে জেনেক্স ইনফোসিসের ৬০ লাখ ৮৩ হাজার ৬২৬ বিক্রয় অযোগ্য (লকড-ইন) শেয়ার কেনে ইউসিবি। প্রতিটি ১৭২ টাকা ৫০ পয়সা হিসাবে মোট ১০৪ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়। গত সেপ্টেম্বরে প্রতিটি শেয়ারের বাজারমূল্য কমে হয়েছে ৩৮ টাকা, ফলে প্রায় ৭৮ কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ইউসিবি। এই শেয়ারের বিক্রেতা ছিলেন জাহারা রাসূল, যিনি জেনেক্স ইনফোসিস লিমিটেডের চেয়ারম্যান আদনান ইমামের বোন ও আমির রাসূল তাঁর বোনের জামাতা। আদনান ইমাম প্রবাসীদের উদ্যোগে গঠিত এনআরবিসি কমার্শিয়াল ব্যাংকের উদ্যোক্তা ও সাবেক পরিচালক।

দুদকে পাঠানো চিঠিতে আরও বলা হয়, আনিসুজ্জামান, বশির আহমেদসহ অন্য পরিচালকদের অনুমোদনে ২০২১ সালে জেনেক্স ইনফোসিসের ৬০ লাখ ৮৩ হাজার ৬২৬ বিক্রয় অযোগ্য (লকড-ইন) শেয়ার কেনে ইউসিবি। প্রতিটি ১৭২ টাকা ৫০ পয়সা হিসাবে মোট ১০৪ কোটি টাকার শেয়ার কেনা হয়।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে আওয়ামী লীগের নেতা প্রয়াত আখতারুজ্জামান চৌধুরীর পরিবারের হাতে ইউসিবির নিয়ন্ত্রণ ছিল। সাইফুজ্জামান চৌধুরী তাঁর ছেলে। শুরু থেকে ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত ছিল ব্যবসায়ী গোষ্ঠী পারটেক্স গ্রুপ ও অনন্ত গ্রুপ। কিন্তু ২০১৭ সালে পারটেক্স গ্রুপের প্রতিনিধিদের ইউসিবি ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন রুকমিলা জামান। তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থান করায় তাঁর পক্ষে সাইফুজ্জামান চৌধুরীই ব্যাংকটি পরিচালনা করতেন। এই সময়ে এসব অনিয়ম হয় বলে নিরীক্ষায় বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট খবর

Back to top button