মেডিকেল রিপোর্টার : ফের রোগীর মৃত্যু হলো রাজধানীর গ্রীন লাইফ হাসপাতালে। অতি সম্প্রতি এই হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মারা যায় আজিজুর রহমান নামের ব্যক্তি। এর কিছুদিন আগে মারা যায় এক প্রসূতি। ওই সময় চিকিৎসা অবহেলায় অনেত হৈ চৈ হয়েছিল। এবার হৃদরোগে আক্রান্ত এক রোগী মারা গেছেন। স্বজনদের দাবি, ওপেন হার্ট সার্জারির সময় তিনি মারা যান; যা নিয়ে ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। রোগীর মৃত্যুরও সাড়ে তিন ঘণ্টা পর জানানো হয় পরিবারকে।
ঘটনা ধামাচাপা দিতে দেয়া হয় চাকরি ও অর্থের প্রলোভন।জানা গেছে, গত বুধবার (১৮ ডিসেম্বর) হৃদরোগে আক্রান্ত মোশাররফ হোসেন নামে এক রোগীকে গ্রীন লাইফ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার পরিবার বলছে, অস্ত্রোপচারের আগেও স্বাভাবিক ছিলেন তিনি। তবে শনিবার (২১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় ওপেন হার্ট সার্জারি করতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়।
ভুক্তভোগীর ছেলে আতিকুর রহমান লিটু বলেন, ভুল চিকিৎসার কারণে আমাদের উপার্জনক্ষম লোকের মৃত্যু হলো। এর দায় কে নেবে? এর দায় গ্রীন লাইফ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের।স্বজনের অভিযোগ, অপারেশন করতে গিয়ে রোগীর মৃত্যুর পর ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয় কর্তৃপক্ষ। মৃত্যুর খবর পরিবারকে সাড়ে তিন ঘণ্টা পর জানানো ছাড়াও দেয়া হয় অর্থ ও চাকরির প্রলোভন।
এ বিষয়ে ভুক্তভোগীর মেয়ে ফারজানা আক্তার বলেন, আমার পড়ালেখার খরচ এবং পড়ালেখা শেষে গ্রীন লাইফে চাকরি দেয়া হবে বলে প্রস্তাব দেয় হাসপতাল কর্তৃপক্ষ। এছাড়া চিকিৎসকের সহকারীর হাতে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বলা হয়েছে রোগীর স্বজনদের দেয়ার জন্য।
এদিকে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ অস্বীকার করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তবে ঘটনা তদন্ত করে কারও গাফিলতি পেলে ব্যবস্থার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।গ্রীন লাইফ হাসপাতালের জেনারেল বিভাগের পরিচালক হাসান খালিদ বলেন, ‘সার্জনই কাজটা করে। কিন্তু ড্রেসিং, রোগীকে বেডে নেয়া, পজিশনিং করা, তৈরি করার কাজ করতে সব সময় সার্জন লাগে না।’
এ ঘটনায় অভিযুক্ত চিকিৎসকের শাস্তির দাবি করে হাসপাতালে হট্টগোল করেন বিক্ষুব্ধ স্বজনরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশ। এ সময় পরিবারকে দেয়া হাসপাতালের বিল ভাউচারে অসংগতি পাওয়া গেছে বলে জানায় পুলিশ। পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাসে রাত ৩টার দিকে মরদেহ নিয়ে যায় পরিবার।
কলাবাগান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘তাদের ম্যানেজমেন্টে সমস্যা আছে। সেটা হলো- টাকা দেয়ার পর রশিদ দেয়ার কথা কিন্তু সেটা না দিয়ে হাতে লিখা একটা রশিদ দেয়া হয়েছে। তারা আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে এলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।’
এর আগে গত ১৬ ডিসেম্বর এই হাসপাতালে চিকিৎসা অবহেলায় মারা যায় আজিজুর রহমান নামে এক ব্যক্তি। ভুক্তভোগীরা বলেন, মৃত ব্যক্তিকে আইসিইউতে রেখে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তোলেন আজিজুর রহমানের ছেলে সাজিদ হাসান কলাবাগান থানায় মামলা করেন পরিবারের পক্ষ থেকে মো. সুমন নামের একজন। সে মামলায় আজিজুর রহমানকে জরুরি বিভাগে চিকিৎসা দেওয়া ডা. সজীব নজরুলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
গ্রিন লাইফ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাপের মুখে কোনও তদন্ত ছাড়াই ডা. সজীব নজরুলকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।প্রথমে মামলাটি হয়েছিল ১৭ জনের বিরুদ্ধে। যেখানে গ্রিন লাইফের কর্তাব্যক্তিরাও ছিলেন আসামি। কিন্তু ঘটনার পরিক্রমায় এজাহার পরিবর্তনে এখন আসামি রাখা হয়েছে কেবল ডা. সজীব নজরুলকে। আর তারপরই তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
মামলাকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমন কোনও ধরনের চাপ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন। শুধু ডা. সজীবকে আসামি করা নিয়ে তিনি বলেছেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা করবেন তিনি।এদিকে যথাযথ তদন্ত ছাড়াই শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে একজন চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করায় ক্ষুব্ধ চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন না হওয়ায় এই ধরনের গ্রেপ্তারের মাধ্যমে চিকিৎসাকর্মীদের নিরাপত্তাহীনতা আবার স্পষ্ট হলো।
গ্রিন লাইফ হাসপাতালের নথিপত্রে দেখা যায়, ৫৮ বছরের আজিজুর রহমানকে ১৬ ডিসেম্বর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়েছিল ৭টা ৫৭ মিনিটে। তখন আজিজুরের শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল, অক্সিজেন স্যাচুরেশন ছিল ৮৭। তাকে তখন অক্সিজেন দেওয়া হয়, করানো হয় ইসিজি।
জরুরি বিভাগ থেকে দেওয়া আজিজুরের ব্যবস্থাপত্রে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, সিকেডি (ক্রনিক কিডনি ডিজিজ), হৃদরোগের কথা উল্লেখ আছে।এই হাসপাতালেই তিনি এর আগেও দুবার আইসিইউতে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন। এবার আইসিইউতে নিতে দেরি করায় তার মৃত্যু হয় বলে স্বজনদের অভিযোগ।
কতটা দেরি হয়েছিল কিংবা কেন দেরি হয়েছিল- জানতে চাইলে সেখানে কর্তব্যরত একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “তাকে তো আগে জরুরিভাবে ইভ্যালুয়েট করতে হবে। কোমর্বিড (অন্য দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হয়ে ঝুঁকিতে থাকা) রোগী, সেজন্য তার প্রিভিয়াস হিস্ট্রি নিতে হবে। নয়ত তাকে সিসিইউ নাকি আইসিইউতে পাঠানো হবে, সেটা বোঝা যাচ্ছিল না।”
কার্ডিয়াক সমস্যা হলে সিসিইউতে পাঠানো হয়। আজিজুরকে কোথায় পাঠানো হবে, তা চিকিৎসকরা বোঝার আগেই তার ছেলে সাজিদ হাসান আইসিইউতে পাঠানোর কথা বলছিলেন বলে ওই চিকিৎসক জানান।তিনি বলেন, “আইসিইউতে পাঠানোর পরে অনেক সময়ই রোগীর স্বজনরা আমাদের বলেন, কেন পাঠানো হলো? এরকম অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক আছে। আবার হাসপাতালের প্রটোকল অনুযায়ী আইসিইউর খরচটাও এখানে অনেক বড় ফ্যাক্টর। যার কারণে রোগীর স্বজনদের বলা হয়েছিল, খরচ সম্পর্কে জানার জন্য। নইলে পরে রোগীর স্বজনরা তা নিয়েও ঝামেলা করেন। এটা ম্যানেজমেন্ট থেকেই বলা আছে আমাদের।
আমরা তো চিকিৎসক, হাসপাতালের নিয়ম তো আমরা বানাই না।এই চিকিৎসকের ভাষ্য অনুযায়ী, রোগীর ছেলেকে তখন বলা হয়েছিল, সঙ্গের অন্য স্বজনদের নিয়ে আইসিইউতে গিয়ে শয্যা ফাঁকা রয়েছে কি না, তা দেখে আসতে।তবে ডা. সজীব নজরুল এসময় রোগীকে দেখছিলেন। রোগীর অবস্থা খারাপ বিবেচনা করে আইসিইউর চিকিৎসকদের সঙ্গেও কথা বলছিলেন তিনি।
রাত ৮টা ৪১ মিনিটে আজিজুরকে আইসিইউতে ঢোকানো হয়, হাসপাতালের নথিপত্রে তাই রয়েছে।তখন তার সিপিআর বা কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন (জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা পদ্ধতি, যা জরুরি অবস্থায় হৃৎপিণ্ড এবং শ্বাস-প্রশ্বাস পুনরুদ্ধারে দেওয়া হয়। এটি সাধারণত কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট (হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাওয়া) বা শ্বাসরোধজনিত পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা হয়) চলছে।
আইসিইউতে নেওয়ার পর ২১ মিনিট পর এরপর ৯টা ২ মিনিটে আজিজুর রহমানকে মৃত ঘোষণা করা হয়।চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে ওই চিকিৎসক বলেন, রোগীর হাসপাতালে আসা, তাকে চিকিৎসকের দেখা, জরুরি বিভাগ থেকে তাকে আইসিইউতে নেওয়া, সব তো ‘ডকুমেন্টেড’। তা যে কোনও বিশেষজ্ঞ দেখলেই বুঝতে এখানে কোনও ধরনের গাফিলতি ছিল না।