রুপের আঁধারে ধান্ধা
হলমার্কের লুটের গডফাদার হেনরী
দুদকে ৩৮৯৩ কোটি লেনদেনের তথ্য
শফিক রহমান : রুপের আঁধারে নানা ধান্ধা’বাজীতে হেনরীর অবিশ্বাস্য উত্থান ঘটেছে সিরাজগঞ্জে। বর্তমানে শুধু সিরাজগঞ্জ নয় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে হেনরীর সম্পদের পাহাড়। রিকশা থেকে এক লাফে ৮৭ লাখ টাকার ল্যান্ড ক্রুজারে উঠেন হেনরী। একসময়কার গানের টিচার থেকে হয়ে ওঠেন বড় নেতা। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।
২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী তার বাৎসরিক আয় ছিল ১ লাখ ২২ হাজার টাকা, আর সম্পদের মূল্য ছিল ৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। ২০২৪ সালের হিসাব অনুযায়ী তার সম্পদের পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকারও বেশি। সরকারি হিসাবেই তার সম্পদ বেড়েছে ৮৮৪ গুণ। এছাড়া, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা ও গাজীপুরে তিনি বিশাল সম্পত্তির মালিক। তার নামে রয়েছে ৯টি বিলাসবহুল গাড়ি এবং একাধিক বাণিজ্যিক ভবন।
রুপ-লাবণ্য আর রাজনীতির ধান্ধাবাজীতে সম্পদে টইটুম্বর বনে যান হেনরী। দুদক দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেছেন, এই দুই লুটেরার ৪৯ ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৩ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে প্রায় ৭৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনেরও প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
আমাদের সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানায়, সিরাজগঞ্জ-২ আসনের আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য জান্নাত আরা হেনরী ও তার স্বামী শামীম তালুকদার মিলে ৩৮৯৩ কোটি টাকা ধান্ধা করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। দুদক দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেছেন, এই দুই লুটেরার ৪৯ ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৩ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একই সঙ্গে প্রায় ৭৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনেরও প্রমাণ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে।
সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) দুদকের ঢাকা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আসিফ আল মাহমুদ বাদী হয়ে মামলা দুটি দায়ের করেন। দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন।দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৫ নভেম্বর জান্নাত আরা হেনরী, তার স্বামী ও মেয়ের দেশত্যাগে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা দেয় আদালত। হেনরীর বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয় গত ২০ আগস্ট। গত ১ অক্টোবর মৌলভীবাজার থেকে স্বামীসহ গ্রেপ্তার হন তিনি।
এজাহার সূত্রে জানা যায়, মামলায় সাবেক এ সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ৫৭ কোটি ১৩ লাখ ৭ হাজার ২২৩ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্যদিকে তার স্বামীর অবৈধ সম্পদের পরিমাণ ২০ কোটি ৪৭ লাখ ৩৩ হাজার ২১৫ টাকা। হেনরী অবৈধভাবে প্রাপ্ত অর্থ বা সম্পত্তির অবৈধ উৎস গোপন বা আড়াল করার উদ্দেশ্যে ৩৫টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ২ হাজার ২ কোটি ৬৬ লাখ ৫৭৭ টাকা ও ১৩ কোটি ৭৮ লাখ ৪৬ হাজার মার্কিন ডলারের (১১৫ টাকা হিসাবে প্রায় ১৫৮৫ কোটি টাকা) সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন।
সোনালী ব্যাংকের পরিচালক থাকার সময়ে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী হওয়ার সুবাদে হেনরী অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে। অপর এজাহারে বলা হয়, আসামি মো. শামীম তালুকদার (লাবু) তার স্ত্রী জান্নাত আরা হেনরীর অপরাধলব্ধ অর্থ দ্বারা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মালিক হয়েছেন। তিনি তার ১৪টি ব্যাংক হিসাবে ৩০৬ কোটি ৬৭ লাখ ৬৯ হাজার ৮৬০ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করেছেন।তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা ও মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২), ৪(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
গানের টিচার থেকে হেনরীর উত্থান-
সাদামাটা গৃহবধূ, সংগীতশিল্পী এবং স্কুল শিক্ষিকা থেকে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক নেত্রী বনে যাওয়া জান্নাত আরা হেনরীর জীবন এক রূপকথার গল্পের মতো। তবে তার এই উত্থান যেমন চমকপ্রদ, তেমনি বিতর্কিতও। সিরাজগঞ্জের এই প্রভাবশালী নেত্রী, যিনি একসময় ছিলেন এক সাধারণ গৃহবধূ, এখন কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক। রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাবের মাধ্যমে তার ভাগ্য বদলে যাওয়ার পেছনে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে।
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার সয়দাবাদ ইউনিয়নের সদানন্দপুর গ্রামের আব্দুল হামিদ মিঞার মেয়ে জান্নাত আরা হেনরী। তার জীবন বদলে যায় যখন তিনি জেলার বিখ্যাত রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক মোতাহার হোসেন তালুকদারের ছেলে শামীম তালুকদার লাবুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সবুজ কানন উচ্চ বিদ্যালয়ে সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি। সেইসঙ্গে রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে জেলার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
বিবাহসূত্রে রাজনৈতিক পরিবারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুবাদে জান্নাত আরা হেনরী আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন মহিলা আওয়ামী লীগে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে তিনি মহিলা আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদকের পদ পান।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিরাজগঞ্জ-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে তৃণমূল ভোটে অংশগ্রহণ করেন জান্নাত আরা হেনরী। সেই নির্বাচনে প্রথম হয়েছিলেন দলের বর্ষীয়ান নেতা মোহাম্মদ নাসিম। কিন্তু দুর্নীতির মামলায় মোহাম্মদ নাসিম নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য হলে, জান্নাত আরা হেনরীর ভাগ্য খুলে যায়। তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান। তবে নির্বাচনে সারা দেশে আওয়ামী লীগের জয়জয়কারের মধ্যেও জান্নাত আরা হেনরী পরাজিত হন।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পরও জান্নাত আরা হেনরীর রাজনৈতিক উত্থান থামেনি। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর জান্নাত আরা হেনরীকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য করা হয়। এখান থেকেই তার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান। তিন বছরের মধ্যেই তিনি হয়ে ওঠেন শত কোটি টাকার মালিক। ঢাকায় এবং সিরাজগঞ্জে গড়ে তোলেন একাধিক বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে তার নামও জড়িয়ে যায়।
সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য হওয়ার পর থেকেই জান্নাত আরা হেনরীর সম্পদ দ্রুত বাড়তে থাকে। রিকশা থেকে এক লাফে ৮৭ লাখ টাকার ল্যান্ড ক্রুজারে উঠেন তিনি। ঢাকার পাশাপাশি সিরাজগঞ্জেও বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, জান্নাত আরা হেনরীর নামে রয়েছে কয়েকশ বিঘা জমি, একাধিক বাড়ি, বিলাসবহুল রিসোর্ট এবং অর্ধডজন বিলাসবহুল গাড়ি।
দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন পাওয়ার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন জান্নাত আরা হেনরী। তবে ২০২৩ সালে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পর তার রাজনৈতিক প্রভাব বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। সাংসদ হওয়ার তিন মাসের মাথায় কোটি কোটি টাকা খরচ করে স্বামী শামীম তালুকদার লাবুকে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানিয়ে আনেন। এ নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী ক্ষুব্ধ হন।
জান্নাত আরা হেনরীর সম্পদের উত্থানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিভিন্ন বিতর্ক। সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য থাকাকালীন তিনি আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এই কেলেঙ্কারিতে তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে। তবে ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ও অন্যান্য পরিচালকগণ ওই অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি পান।পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পালিয়ে থেকে হেনরী ও তার স্বামী লাবু গ্রেফতার হন।বর্তমানে তারা জেলে রয়েছেন।