
পাতানো নির্বাচনের নির্দেশগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়েছিল সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করার বিষয় জানা দরকার।হাজার কোটি টাকা কীভাবে খরচ করেছেন সেই হিসাব দেননি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরো যারা জড়িত ছিল তাদের তথ্য বের করা প্রয়োজন।
কোর্ট রিপোর্টার : ‘জনগণের ভোট ছাড়া’ নির্বাচন সম্পন্ন করা, রাষ্ট্রদ্রোহ ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার বিরুদ্ধে করা মামলাকে ত্রুটিপূর্ণ দাবি করে তার আইনজীবী আদালতকে বলেছেন, মামলাটি ‘আইনগতভাবে চলার সুযোগ’ নেই।এই আইনজীবী বলেছেন, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করবে সরকার, ব্যক্তি করেছে, এমন ঘটনা ‘বিরল’।
শুক্রবার ঢাকার মহানগর হাকিম আওলাদ হোসাইন মুহাম্মদ জোনাইদ সাবেক সিইসি নূরুল হুদার রিমান্ড শুনানি নেন, যেখানে তার পক্ষের আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম সজিব মামলার আইনগত দিক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।গত রোববার গ্রেপ্তার করার পর সোমবার নূরুল হুমাকে চার দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছিল আদালত। সেই রিমান্ড শেষে শুক্রবার তাকে আদালতে হাজির করে পুনরায় দশ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার এসআই শামসুজ্জোহা সরকার।
সেখানে বলা হয়, আসামির দেওয়া ‘চাঞ্চল্যকর’ তথ্য যাচাই-বাছাই করা এবং যে তথ্য দিয়েছেন, সেগুলো নথি সংক্রান্ত তথ্য হওয়ায় নথি উদ্ধার করে যাচাই-বাছাই করা প্রয়োজন।আসামি প্রধান নির্বাচন কমিশনার থাকাকালে যেহেতু ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পাতানো ছিল, সেহেতু এটি একটি দাপ্তরিক সংঘবদ্ধ অপরাধ। আসামির নির্দেশে কীভাবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পাতানোভাবে আয়োজন করা হয় তা এবং ওই নির্বাচনের বাজেট ও বাস্তবায়ন সংক্রান্ত তথ্য উদঘাটন করা প্রয়োজন।”
আবেদনে বলা হয়, কে এম নূরুল হুদা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত পলাতক আসামিদের বিষয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য’ দিয়েছেন। পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার করে সেই তথ্য যাছাই করা প্রয়োজন।বেলা ২টা ৪০ মিনিটের দিকে নুরুল হুদাকে আদালতে হাজির করা হয়। ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে রিমান্ড শুনানিকালে তাকে এজলাসে তোলা হয়। তার আগে তাকে রাখা হয় আদালতের হাজতখানায়।
রাষ্ট্রপক্ষে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর ওমর ফারুক ফারুকী রিমান্ডের পক্ষে শুনানি করেন।তিনি বলেন, মামলাটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ। আজকের আসামি বাংলাদেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন। ওনাদের তিনজনের (সাবেক তিন সিইসি) কারণে বাংলাদেশে ফ্যাসিস্টের জম্ম হয়। হাজার হাজার লোকের প্রাণ গেছে।ফারুকী বলেন, যখন নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন পুলিশ, প্রশাসন ইসির অধীনে থাকে। বিভিন্ন জেলায় বিচারকদের নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি গঠনের ক্ষমতা ছিল। উনি সিইসি ছিলেন। সবাই ওনার অধীনে ছিলেন।
বিরোধী রাজনৈতিক দলকে আওয়ামী লীগ পিটিয়ে রাজপথ ছাড়া করেছে। বাড়িতে পুলিশ গিয়ে গ্রেপ্তার করেছে। প্রার্থীদের বাড়িঘর ভাঙচুর, লুটপাট করা হলেও সেই বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।সিইসি নূরুল হুদা ‘প্রহসনের’ ভোট করেন দাবি করে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, রাত ৩টার মধ্যে ২০০ প্রার্থীকে বিজয় ঘোষণা করেন। রাতের ভোট করার বিষয়ে প্রিজাইডিং অফিসারকে নির্দেশ দেওয়া হয়। কাদের সহযোগিতায় রাতের ভোট সম্পন্ন হয়েছে। সেটা জানার প্রয়োজন।
পাতানো নির্বাচনের নির্দেশগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়েছিল সে বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ প্রয়োজন। নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করার বিষয় জানা দরকার।হাজার কোটি টাকা কীভাবে খরচ করেছেন সেই হিসাব দেননি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আরো যারা জড়িত ছিল তাদের তথ্য বের করা প্রয়োজন।এসময় বিচারক জানতে চান, তখন ইসি সচিব কে ছিলেন?
ফারুকী জানান, হেলালুদ্দীন আহমেদ। ওই নির্বাচনে ওনার (নুরুল হুদা) পরিবারের কেউ ছিলেন? জবাবে সরকারি কৌঁসুলি বলেন, পটুয়াখালী-৩ আসনে ভাগ্নে শাহাজাদাকে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মনোনয়ন দিতে সহায়তা করেন।নূরুল হুদার পক্ষে তৌহিদুল ইসলাম রিমান্ডের বিরোধিতা করে জামিন আবেদন করেন।শুনানিতে তিনি বলেন, ২৩ জুনের রিমান্ড আবেদন এবং আজকের রিমান্ড আবেদনের মধ্যে মৌলিক তেমন ‘পার্থক্য’ নেই।
আগের দফা রিমান্ডের প্রসঙ্গ টেনে তৌহিদুল বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা রিমান্ডে কি পেলেন, ১০০ তে কত পেলেন আবেদনে জানাতে হবে। আদালতকে সন্তুষ্ট করতে হবে, কত শতাংশ তথ্য পেলেন। কিন্তু আবেদনে দেখা গেল, মৌলিক তেমন পার্থক্য নেই।তিনি বলেন, “সকল জামিনযোগ্য ধারায় মামলা শুরু। ২৩ জুন আদালতে উপস্থাপন করলাম, সকল ধারা জামিনযোগ্য, জামিন দেন। প্রসিকিউশন দেখলো অবস্থা খারাপ, কথা বলার সুযোগ কম। পরে ধারা সংযোজনের আবেদন করেন।
কথা বলতেও ভয় লাগে। সংশোধন করে যদি আবার ধারা সংযোজনের আবেদন করা হয়।এ আইনজীবী বলেন, তার (নূরুল হুদা) বিরুদ্ধে যে অভিযোগের ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে, এই মামলা চলার ক্ষেত্রে আইনগত বাধা আছে, মামলা প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার আগে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। এখানে তা করা হয়নি। মামলাটা ত্রুটিপূর্ণ, আইনগতভাবে চলার সুযোগ নেই। সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট, দায় সৃষ্টিকারী এমন কিছু মামলায় নাই।
সাবেক এই সিইসিকে রিমান্ডে নিয়ে কোনো তথ্য পাওয়া গেল কি না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তৌহিদুল বলেন, “তাকে নিয়ে কি শুধু আপ্যায়ন করলেন। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করবে সরকার। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ব্যক্তি করেছে এমনটা বিরল।ব্যক্তি মামলা করলে তা ত্রুটিপূর্ণ হয়। আর নির্বাচন সংক্রান্ত অর্থ নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে কি না, তা একজন এসআই তদন্ত করবেন? এই তদন্ত তো করবে এনবিআর। এনবিআরের বড় বড় কর্মর্তারা আছেন, বিষয়টা ওনার দেখবেন।
নুরুল হুদা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গেরিলা যুদ্ধ করেছেন তুলে ধরে তিনি বলেন, “স্বাধীনতা, অস্তিত্বের সাথে বিষয়টা জড়িত। সবকিছু মিলিয়ে রিমান্ড বাতিল চেয়ে তার জামিনের প্রার্থনা করছি।সবশেষে আদালত আসামিপক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশ্য বলেন, সব প্রশ্নের উত্তর দিলেন। রাতের ভোট নিয়ে কিছু বললেন না। তখন নুরুল হুদার আইনজীবী দাবি করেন, এ বিষয়ে কোনো সংবাদমাধ্যম কোনো ‘ডকুমেন্ট’ দেখাতে পারেনি। পরে আদালত তার চার দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন। বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং মামলা, গুম, খুন ও তথ্য সংরক্ষণ সমন্বয়ক সালাহ উদ্দিন খান গত রোববার শেরেবাংলা নগর থানায় এ মামলা দায়ের করেন।
মামলায় ২০১৪ সালের নির্বাচনের সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ, ২০১৮ সালের নির্বাচনে সিইসি এ কে এম নূরুল হুদা ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের পাশাপাশি তাদের সময়ের নির্বাচন কমিশনারদের আসামি করা হয়।পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার, এ কে এম শহীদুল হক, জাবেদ পাটোয়ারী, বেনজীর আহমেদ ও চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনকে আসামি করা হয়েছে মামলায়।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ওই তিন নির্বাচনে ‘গায়েবী মামলা, অপহরণ, গুম খুন ও নির্যাতনের’ ভয় দেখিয়ে, বিএনপি নেতাকর্মীদের ‘গণগ্রেপ্তার’ করে নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে দূরে রাখা হয়।সংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে থাকা সত্বেও সংবিধান লঙ্ঘন, নির্বাচনি আচরণবিধি লঙ্ঘন, সরকারি কর্মচারী হয়েও অবৈধভাবে ভোটে হস্তক্ষেপ, ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটের কাজ সম্পূর্ণ করা ও জনগণের ভোট না পেলেও সংসদ সদস্য হিসেবে মিথ্যাভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
উক্ত ঘটনার সাক্ষী সকল ভোট কেন্দ্র এলাকার ভোটাররা এবং ভোটারদের মধ্যে যারা ভোট প্রদান করতে বঞ্চিত হয়েছেন তারাসহ ভোট কেন্দ্রে নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্যরা। এছাড়া ভোট কেন্দ্রে অনেক সৎ প্রিজাইডিং অফিসার, পুলিংশ অফিসারসহ স্থানীয় লোকজনসহ আরো অন্যান্যরা ঘটনার সাক্ষী হবে।
এছাড়া ব্যালট পেপারে যে সিল ও স্বাক্ষর রয়েছে, তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই প্রকৃতভাবে তারা ভোট দিয়েছে কিনা সে বিষয়ে উল্লেখিত ঘটনার সঠিক রহস্য তদন্তে সত্য উদঘাটিত হবে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার এসআই শামসুজ্জোহা সরকার বুধবার মামলায় দণ্ডবিধির ১২০ (ক)/ ৪২০/৪০৬ ধারায় অভিযোগ যুক্ত করার আবেদন করেন। ঢাকার মহানগর হাকিম মো. মিনহাজুর রহমান শুনানি শেষে আবেদন মঞ্জুর করেন। ফলে রাষ্ট্রদ্রোহ, প্রতারণা এবং অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ যুক্ত হয়েছে এ মামলায়।
নূরুল হুদার পর আরেক সাবেক সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালকে বুধবার ঢাকার মগবাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে হাজির করে ৩ দিনের রিমান্ডে পেয়েছে পুলিশ।