জাতীয়

‘সর্বোচ্চ আইন করতে হবে ‘জাতীয় সনদ’কে’

অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, জাতীয় সনদে একটা বিধান থাকবে হবে; এই সনদের বিরুদ্ধে কোনো আইন, সংবিধান হবে না। যা কিছু এই সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে, ওটা বাতিল হবে

 

বিশেষ প্রতিনিধি : স্বাধীনতার পর দেশে জাতীয় ঐকমত্য দেখা যায়নি। রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠতে পারেনি। এবার জাতীয় স্বার্থে দলগুলোকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কিছু বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি করতে হবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে যে জাতীয় সনদ হবে, সেটাকে জনগণের আকাঙ্ক্ষা বা সর্বোচ্চ আইন হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। সে সনদে এমন একটা বিধান রাখতে হবে যে এই সনদের বিরুদ্ধে যায় সংবিধানে এমন কোনো বিধান বা আইন করা যাবে না। শনিবার ‘রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে প্রস্তাবিত জাতীয় সনদ সম্পর্কে নাগরিক ভাবনা উপস্থাপন’ শীর্ষক এক আলোচনায় এসব কথা উঠে আসে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ওই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন সুজনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন। সামনে যে জাতীয় সনদ বা জুলাই সনদ করা হবে, কেউ পরবর্তী সময়ে সেটা না মানলে তখন কী হবে—এমন প্রশ্ন রেখে নিজের একটি পরামর্শ তুলে ধরেন এম এ মতিন। তিনি বলেন, জাতীয় সনদে একটা বিধান থাকবে হবে—এই সনদের বিরুদ্ধে কোনো আইন, সংবিধান হবে না। যা কিছু এই সনদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে, ওটা বাতিল হবে।

গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত বর্তমান সরকারের আইনগত ক্ষমতা আছে উল্লেখ করে এম এ মতিন বলেন, সনদে যদি থাকে যে হাইকোর্ট ঢাকার বাইরে স্থানান্তর করতে হবে, তাহলে এটাই আইন। কারণ, এটাই জনগণের অভিপ্রায়, জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং এটাই সর্বোচ্চ আইন।

কিছু মৌলিক সংস্কারে রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন উল্লেখ করে সুজনের সম্পাদক ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এগুলো নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে। মৌলিক সংস্কার না হলে নির্বাচন হবে, কিন্তু গণতান্ত্রিক উত্তরণ হবে না।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এমন বিধান করতে হবে যেন কথায় কথায় সংবিধান পরিবর্তন করা না যায়। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার লাগাম টানতে হবে। আর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে সঠিক ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া না গেলে তা হবে পণ্ডশ্রম। ইতিমধ্যে ১০টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। বাকি বিষয়গুলোতেও ঐকমত্য হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

বদিউল আলম মজুমদার বলনে, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর মধ্য বেশ কিছু প্রস্তাব আছে, যেগুলো আইন–বিধি পরিবর্তনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা যায়। এ রকম শত শত সুপারিশ আছে। সেগুলো সরকারকে দেওয়া হয়েছে। রাজনীতিবিদদের এ ব্যাপারে দ্বিমতের সুযোগ খুব কম।

স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বাস্তবায়ন অগ্রগতি না হওয়ায় অনুষ্ঠানে হতাশা ব্যক্ত করেন ওই কমিশনের প্রধানের দায়িত্ব পালন করা অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, তিনি এখন ‘টিজিং’–এর শিকার হন। অনেকে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, রিপোর্ট দিলেন, এরপর কী হলো?

তোফায়েল আহমেদ বলেন, তাঁরা যেসব সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন, সেগুলোর জন্য সংবিধানে বড় পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। তারা চারটি আইনের খসড়াও তৈরি করে দিয়েছেন। স্থানীয় সরকারের জন্য একীভূত একটি আইনের প্রস্তাব দিয়েছেন। কেন এসব আইন প্রয়োজন, সেটাও ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু এখন শুধু মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করছে ঐকমত্য কমিশন। তিনি বলেন, এখনো ছয় মাস সময় আছে। এর মধ্যে অনেকগুলো কাজ করে ফেলতে হবে। তাঁরা যেসব আইন প্রস্তাব করেছেন, সেগুলো অধ্যাদেশ আকারে জারি করার দাবি জানান তিনি।

জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হওয়া উচিত মন্তব্য করে তোফায়েল আহমেদ বলেন, স্থানীয় সরকারে এখন চলছে ‘প্রশাসকের কাল’। নির্বাচন কবে হবে জানা নেই। নির্বাচনের কথা বলাই যাচ্ছে না।

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জেসমিন টুলি বলেন, ৫৩ বছরে জাতীয় ঐকমত্য দেখা যায়নি। এবার যদি ঐকমত্য হয় এবং তার বাস্তবায়ন হয়, তাহলে আর গণ–অভ্যুত্থান দেখতে হবে না। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় থাকলে একরকম আর ক্ষমতার বাইরে গেলে আরেক রকম আচরণ করে। দলগুলোকে দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে দেখা যায়নি। তিনি আশা করেন, এবার দেশের স্বার্থে কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হবে।

অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরাও অংশ নিয়ে বক্তব্য দেন। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ বলেন, অবশ্যই সংস্কার প্রয়োজন। তার আগে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করতে হবে। বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশনকে সংস্কার করতে হবে। ‘সিস্টেম’ সংস্কার করা না গেলে, স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ করা না গেলে রাজনৈতিক দলগুলো ভেতরে যতই সংস্কার আনা হোক, তার ফল আসবে না। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোরও সদিচ্ছা থাকতে হবে।

আগে মৌলিক সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করে তারপর সংসদে যেতে হবে বলে মন্তব্য করে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন। তিনি বলেন, এনসিপি নির্বাচনকে ভয় পায় না। এনসিপি পুরোনো পদ্ধতিকে ভয় পায়। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানো, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, জবাবদিহি ও ক্ষমতার ভারসাম্য—এটাই এনসিপির মূল কথা।

অন্যদের মধ্যে সাবেক সচিব আবদুল আউয়াল মজুমদার, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মুশতাক হোসেন, গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, নাগরিক ঐক্যের সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার, গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান, নাগরিক কোয়ালিশনের সহসমন্বয়ক ফাহিম মাশরুর প্রমুখ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।

 

সংশ্লিষ্ট খবর

Back to top button