৮ বিভাগের খবরঅর্থনীতি

চট্টগ্রাম বন্দরে লুটের ‘সম্রাট’ এনামুলের রামরাজত্ব

দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে একই বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে গড়ে তুলেছেন এক অপ্রকাশিত সাম্রাজ্য। যেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করছেন নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ করছেন কনটেইনার ছাড়, এমনকি লাইসেন্স বাণিজ্য পর্যন্ত। তার বিরুদ্ধে তদন্ত নেমেছে দুদকের চট্টগ্রাম সম্মিলিত জেলা কার্যালয়।

লাবণ্য চৌধুরী : চট্টগ্রাম বন্দরে লুটের ‘সম্রাট’ এনামুলের রামরাজত্ব চলছে। কে ধরবে তাকে তা নিয়ে চলছে নিরীহ ব্যবসায়ীদের নানা জল্পনা কল্পনা।ব্যবসায়ীরা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র। আর এই বন্দরেই প্রায় দুই দশক ধরে অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করে আসছেন এনামুল করিম। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন বিভাগের পরিচালক। দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে একই বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে গড়ে তুলেছেন এক অপ্রকাশিত সাম্রাজ্য। যেখান থেকে নিয়ন্ত্রণ করছেন নিয়োগ, নিয়ন্ত্রণ করছেন কনটেইনার ছাড়, এমনকি লাইসেন্স বাণিজ্য পর্যন্ত। তার বিরুদ্ধে তদন্ত নেমেছে দুদকের চট্টগ্রাম সম্মিলিত জেলা কার্যালয়।

বদলেছে পরিচয়, অপরিবর্তিত প্রভাব: এনামুল করিমের ক্যারিয়ারের শুরু ১৯৯৬ সালে, তৎকালীন নৌপরিবহণমন্ত্রী আ স ম আবদুর রবের মায়ের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে। সে সময় মা’কে করা অনুরোধেই চাকরির দরজা খুলে যায় এনামুলের সামনে। তবে সময়ের পরিক্রমায় রাজনৈতিক পরিচয় বারবার পাল্টালেও ক্ষমতা ও প্রভাব থেকেছে অবিচল। এক সময় নিজেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করলেও বর্তমানে জামায়াত ও বিএনপিপন্থী বলেই পরিচিত তিনি।

নিয়োগ বাণিজ্যে কোটি টাকার খেলা: বন্দরে যেসব শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগ হয়, তার পেছনে একটি চক্র কাজ করে, যার মূল কেন্দ্র এনামুল করিম। প্রতি নিয়োগে ঘুষ নেন ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা। এই নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় তাঁর বিশ্বস্ত তিন সহযোগীর মাধ্যমে—বন্দর শ্রমিক কর্মচারী লীগ (রেজি: ২৭৪৭) এর সভাপতি মীর নওশাদ, সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর ও সাংগঠনিক সম্পাদক সোহেল।

তদন্ত নেমেছে দুদক: জাহাজ থেকে কনটেইনার নামাতে হলে শিপিং এজেন্টের হিসাবে (রিভলভিং একাউন্ট) হ্যান্ডলিং বিলের পর্যাপ্ত অর্থ থাকতে হয়। অর্থ থাকলে তখন কনটেইনার নামতে পারে বন্দরে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ২০১৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে দেখা গেছে ব্যত্যয়। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভিন্ন ঘটনা ঘটে বন্দরে। শিপিং এজেন্ট মেসার্স ইউনিবেঙ্গল কনটেইনার ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের রিভলভিং হিসাবে পর্যাপ্ত টাকা না থাকা সত্ত্বেও রেগুলেশন অনুসরণ না করে তাদের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ছাড়পত্র (পোর্ট ক্লিয়ারেন্স) দেয় বন্দর ট্রাফিক বিভাগ।

ওই সময় এই বিভাগের ডেপুটি ট্রাফিক ম্যানেজার (অপারেশন) ছিলেন এনামুল করিম। তিনিই ছাড়পত্র দিয়েছিলেন। এ কারণে ওই অর্থবছরে মেসার্স ইউনিবেঙ্গল কনটেইনার ম্যানেজমেন্ট লিমিটেডের কাছে ১০ কোটি ৩২ লাখ ৬২ হাজার ৮১৬ টাকা পাওনা থেকে বঞ্চিত হয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। পরে বকেয়া টাকা আদায়ে মামলায় যেতে হয়। এরই মধ্যে ওই টাকা বকেয়া রেখে দেউলিয়া হয় প্রতিষ্ঠানটি। এতে পাওনা আদায়ে সংকটে পড়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ১৬০০ কনটেইনার আটকে রেখেও পাওনা আদায় করতে পারেনি বন্দর।

২০১৬ সালের ওই ঘটনার বিষয় নিয়ে সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করেছে। এরই মধ্যে ওই ঘটনার বিবরণ ও প্রয়োজনীয় নথিপত্র চেয়ে ২০২৩ সালে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্দর চেয়ারম্যানকে একাধিক চিঠি দিয়েছে দুদক। মূলত অভিযোগটি উঠেছে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবহন বিভাগের বর্তমান পরিচালক এনামুল করিমের বিরুদ্ধে।

এদিকে বন্দর চেয়ারম্যানকে দেওয়া দুদকের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, এনামুল করিম শিপিং এজেন্টের সঙ্গে যোগসাজশ করে বন্দরের মাসুলের টাকা আত্মসাৎ করে নিজ নামে ও স্ত্রী-সন্তানদের নামে অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন। ওই চিঠিতে ২০১৪ সালের শুরু থেকে ২০১৬ সালের শেষ পর্যন্ত- এই তিন বছরে বন্দরে জাহাজ ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম, পদবি এবং কনটেইনার হ্যান্ডলিং ও ছাড়করণ প্রক্রিয়ার ধারাবাহিক বিবরণ জানতে চেয়েছে দুদক। এ ছাড়া এ ঘটনায় বন্দর কর্তৃপক্ষ কি কি আইনি পদক্ষেপ নিয়েছে, তার রেকর্ডপত্রও চাওয়া হয়েছে। গত দেড় মাস আগে আবারও তদন্ত চেয়েছেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-১ এর সহকারী পরিচালক মো. এমরান হোসেন।

 

 

সংশ্লিষ্ট খবর

Back to top button