বিশৃঙ্খলা না গাদ্দারি-পিটার হাস কেলেংকারি-৫ নেতাকে শোকজ

প্রশ্ন উঠেছে এনসিপির কেন্দ্রীয় আহবায়ক জানেন না তাদের ৫ নেতা পিটার হাসের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন। দলের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় আহবায়ক শোকজ করতে বাধ্য হন। এতে বেরিয়ে পড়ে লাভ ক্ষতির প্রশ্ন ! তানা হলে রাষ্ট্রের এত বড় প্রোগ্রাম ঢাকায় অথচ এনসিপির পাঁচ স্তম্ভ ঢাকায় থাকবে না তা কি করে সম্ভব!
শফিক রহমান : জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির তাদের ৫ নেতাকে শোকজ করেছে। শোকজে নেতাদের বিশৃঙ্খলা কে দায়ি করা হয়েছে। কিন্তু জনমনে প্রশ্ন উঠেছে তাদের গাদ্দারি নিয়ে! এর আগেও এনসিপির এই নেতাদের বিরুদ্ধে নানা প্রশ্ন উঠেছে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে অনেকটা যেন লাগামহীন অবস্থা। ৫ আগস্ট ‘জুলাই অভ্যুত্থানের’ প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি চলাকালীন ব্যক্তিগত সফরে তাদের কক্সবাজার যাওয়ার অভিযোগ ওঠে এবং তাদের কয়েকজন এখনও কক্সবাজারে অবস্থান করছেন।
অভিযোগ ওঠে, কক্সবাজারের একটি হোটেলে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে এনসিপির শীর্ষ ৫ নেতা গোপন বৈঠক করেছেন।এ খবরে মঙ্গলবার সারা দেশে তোলাপাড় চলে। যদিও এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী এটাকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়ে বলছেন, পদযাত্রায় ক্লান্ত হয়ে তারা কক্সবাজারে ঘুরতে এসেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকমহল এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না। রাজনীতিকরা বলছেন, এ বৈঠকের নেপথ্যে নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র সহ নানা লাভ ক্ষতির অংক মেলাচ্ছেন অনেকে।
এর জের ধরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির পাঁচ নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। বুধবার (৬ আগস্ট) এই নোটিশ দেওয়া হয়। ৫ আগস্ট ‘জুলাই অভ্যুত্থানের’ প্রথম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি চলাকালীন ব্যক্তিগত সফরে তাদের কক্সবাজার যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এরপরই দলের পক্ষ থেকে এই পদক্ষেপ এলো।নোটিশে বলা হয়, সফর সম্পর্কে ‘রাজনৈতিক পর্ষদ’কে আগে কোনো তথ্য বা ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। অভিযুক্তরা হলেন— তাসনিম জারা, খালেদ সাইফুল্লাহ, হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম ও নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী।
এ প্রসঙ্গে এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহ উদ্দিন সিফাতের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সংশ্লিষ্ট নেতাদের আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম ও সদস্যসচিব আখতার হোসেনের কাছে সশরীরে উপস্থিত হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা প্রদান করতে হবে।দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বিষয়টি দলীয় শৃঙ্খলার পরিপন্থী হিসেবে দেখা হচ্ছে। ব্যাখ্যা সন্তোষজনক না হলে সংগঠনের নীতি অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের এই দিনে ছাত্র জনতার আন্দোলনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সমর্থনে রক্তক্ষয়ী পটপরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল। দেশ পরিবর্তনের সেই নেতারা আজ এনসিপি তথা কিংস পার্টির নেতৃত্বে। হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, নাসিরউদ্দীন পাটওয়ারী, তাসনিম জারা এরা সেই প্ল্যাটফর্মের সামনের সারির মুখ। কিন্ত তারা অভিযুক্ত হয়ে গেলেন বিতর্কিত এক কূটনীতিকের সঙ্গে বৈঠক করে। অথচ এনসিপির কেন্দ্রীয় আহবায়ক বলছে তারা এটার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। এই নেতারা পিটার হাসের মতো একজন বিতর্কিত বিদেশী কূটনীতিকের সঙ্গে গোপনে আলোচনা করছে এটি কি সাধারণ কোনো রাজনৈতিক সাক্ষাৎ, নাকি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের সূচনা তা নিয়েই তোলপাড় চলছে।
পিটার হাস বাংলাদেশের রাজনীতিতে কখনোই নির্মোহ পর্যবেক্ষক ছিলেন না। তার কূটনৈতিক কার্যক্রম বারবারই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগে কলঙ্কিত। মার্কিন ডিপস্টেটের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে তিনি বাংলাদেশে যে ভূমিকা রেখেছেন, তাতে এই বৈঠককে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা ছাড়া উপায় নেই।
৫ আগস্টের এই বৈঠক বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন কূটকৌশলের ইঙ্গিত দিচ্ছে। দেশের মানুষ গত এক বছরে রক্তঝরা শিক্ষা নিয়ে এখন সচেতন। রাজনৈতিক সংলাপ গণতন্ত্রের অংশ, কিন্তু যখন তা বিদেশী প্রভাব ও ষড়যন্ত্রের ছায়ায় হয়, তখন তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্ন হলো, পিটার হাস ও এনসিপির এই মিলনমেলা কেন?
আমাদের কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, বিএনপির বিক্ষোভ মিছিলে বক্তারা বলেন, গত ১ বছর ধরে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে গেলেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। এই ষড়যন্ত্রকে বরদাশত করা হবে না। আমাদের লড়াই চলছে এবং আগামীতেও চলবে। তারা বলেন, কিছু কুচক্রী মহল, যারা ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তারা এখানে বসে (সী পার্ল হোটেল) বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।
বক্তারা বলেন, আপনারা বাংলাদেশের দক্ষিণপ্রান্তে এসে ষড়যন্ত্র করবেন, বিলাসবহুল হোটেলে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবেন, নির্বাচন বানচাল করার ষড়যন্ত্র করবেন—সেটা এই জনতা মেনে নেবে না। শুধু এখানে নয়, বাংলাদেশের যেখানেই ষড়যন্ত্র করা হবে। সেখানেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।বক্তারা আরো বলেন, বাংলাদেশকে আরো একটি ওয়ান-এলেভেনের দিকে ধাবিত করা হচ্ছে। গতকাল এক উপদেষ্টা বলেছেন, বাংলাদেশে নাকি আরেকটা ওয়ান-এলেভেন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমরা যারা গত ১৬ বছরে রক্তের বিনিময়ে রাজপথে থেকে শেখ হাসিনার পতন ঘটিয়েছি, তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র বরদাশত করব না।
প্রশ্ন উঠেছে এনসিপির কেন্দ্রীয় আহবায়ক জানেন না তাদের ৫ নেতা পিটার হাসের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছেন। দলের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় আহবায়ক শোকজ করতে বাধ্য হন। এতে বেরিয়ে পড়ে লাভ ক্ষতির প্রশ্ন ! তানা হলে রাষ্ট্রের এত বড় প্রোগ্রাম ঢাকায় অথচ এনসিপির পাঁচ স্তম্ভ ঢাকায় থাকবে না তা কি করে সম্ভব!
ওদিকে বিএনপি বলছে, কীভাবে এই নির্বাচন ঠেকানো যায়, তারই কৌশল নির্ধারণ করতে তারা পিটার হাসের শরণাপন্ন হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ইউনুস তার আমেরিকান যোগাযোগগুলো থেকে সাড়া পাচ্ছেন না বলে, এখন একমাত্র ভরসা পিটার হাস! যার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর উপর চাপ তৈরি করে বিএনপিকে নির্বাচন থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হতে পারে বলে বিএনপি নেতারা বলছেন।
সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে সারজিসের লাইভ-
শোকজের পর কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে ফেসবুকে একটি লাইভ করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম। জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে কক্সবাজার ভ্রমণ নিয়ে দেশজুড়ে নানা আলোচনা-সমালোচনার পর প্রথম ফেসবুক লাইভে আসলেন তিনি। সমুদ্রপাড়ে দাঁড়িয়ে আজ বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে করা লাইভের শুরুতেই সবাইকে শুভেচ্ছা জানান সারজিস। তিনি বলেন, ‘এনসিপি আমাদের পক্ষ থেকে সারা দেশের মানুষের কাছে একটি ২৪ দফার ইশতেহার দিয়েছি। এই ২৪ দফার মধ্যে ২১ নম্বর যে দফা, সেখানে ছিল জলবায়ু সহনশীলতা এবং নদী ও সমুদ্র রক্ষা।’
সারজিস বলেন, ‘বাংলাদেশে আমাদের যে সমুদ্রসীমা, এই সমুদ্রসীমা আমাদের ল্যান্ডের যে সীমা এর কাছাকাছি, প্রায় সমপরিমাণ। আমাদের বিশাল এক অপার সম্ভাবনার জায়গা আমাদের এই সমুদ্র। সবচেয়ে বড় হচ্ছে, এই ব্লু জিনিসটাকে কীভাবে আমরা ব্লু ইকোনমিতে পরিণত করতে পারি, কীভাবে আমরা এই বায়ো-ডারভারসিটি রক্ষা করতে পারি, কীভাবে সমুদ্র তীরবর্তী মানুষ যারা রয়েছে, তাঁদের জীবন ধারণ নিশ্চিত করতে পারি, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের যে উচ্চতা বাড়ছে—এই জায়গায় আমাদের ব্যবস্থা নেওয়া এবং এই সকল জায়গা সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে।’
সারজিস বলেন, ‘আমরা দেখছি- কক্সবাজারের যেখানে-সেখানে ভবন তোলা হচ্ছে। কোনো ব্যবস্থাপনা নেই। যেখানে-সেখানে জমি দখল করছে। সরকারি কর্মকর্তাদের টাকা দিয়ে অবৈধভাবে জমি লিজ নিচ্ছে। সৈকতের পাড়ে প্রাচীর দেওয়া হচ্ছে। কোন গবেষণার ফলে এগুলো হচ্ছে- আমরা জানি না।’এরআগে, দলের রাজনৈতিক পর্ষদকে আগে থেকে না জানিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে কক্সবাজার ভ্রমণ করায় শীর্ষ ৫ নেতাকে কারণ দর্শনো নোটিশ দেয় এনসিপি। তাদের আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে স্বশরীরে উপস্থিত হয়ে নোটিশের ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার জুলাই ঘোষণাপত্রের অনুষ্ঠান উদযাপনে ঢাকায় লাখো জনতার সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এতে যোগ না দিয়ে কক্সবাজার যান এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ ও দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা।
এই ভ্রমণে সারজিস আলমের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী এবং তাসনিম জারার সঙ্গে তাঁর স্বামী খালেদ সাইফুল্লাহও (খালেদ নিজেও এনসিপির নেতা) আছেন।