কেয়া প্রায় এক যুগের সংসারে তাদের চার সন্তানের জন্ম হয়। ১৩ আগস্ট মধ্যরাতে ফাহমিদার মৃত্যু হয়। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, ফাহমিদাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন স্বামী সিফাত। পরে তিনি ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেন।

বিশেষ প্রতিনিধি : সামাজিক অস্থিরতা ও ঝগড়ার বলি হয়েছে ৩২২ জন বলে জানিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)। সংস্থাটির তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে দেশে ৩৬৩টি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩২২ জনের। এর মধ্যে ২০৮ জন নারী ও শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। আর আত্মহত্যা করেছেন ১১৪ জন।

এরকম একটি পারিবারিক কলহে মৃত্যু ঘটে কেয়া নামে এক গৃহবধুর। এই কেয়া ঘাতক সিফাত আলীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। পুরো নাম সৈয়দা ফাহমিদা তাহসিন (কেয়া)। প্রায় এক যুগের সংসারে তাদের চার সন্তানের জন্ম হয়। ১৩ আগস্ট মধ্যরাতে ফাহমিদার মৃত্যু হয়। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, ফাহমিদাকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন স্বামী সিফাত। পরে তিনি ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা করেন।ঘটনাটি রাজধানীর শেওড়াপাড়ার। ঘটনার পরদিন ফাহমিদার মা নাজমা বেগম মিরপুর মডেল থানায় সিফাতসহ ১০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে দেশে ৩৬৩টি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩২২ জনের। এর মধ্যে ২০৮ জন নারী ও শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। আর আত্মহত্যা করেছেন ১১৪ জন।আসকের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি হত্যার ঘটনা ঘটেছে স্বামীর হাতে—১৩৩ জন নারী। স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে হত্যার শিকার হয়েছেন ৪২ জন। আর ৩৩ জন হত্যার শিকার হয়েছেন নিজ পরিবারের সদস্যদের হাতে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে দেশে ৩৬৩টি পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৩২২ জনের।অন্যদিকে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় নারী সুরক্ষা হেল্পলাইন ‘১০৯’-এর তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার নারীর জন্য সহায়তা চেয়ে কল এসেছে ৪৮ হাজার ৭৪৫টি।

জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর তথ্য অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ৮ মাসে নারী নির্যাতনের ঘটনায় ১৭ হাজার ৩৪১টি কল এসেছে। এর মধ্যে পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগে কল এসেছে ৯ হাজার ৭৪৬টি। এসব কলের মধ্যে শুধু স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এসেছে ৯ হাজার ৩৯৪টি।

ঝগড়ার খেসারত-
রাজধানীর ইস্কাটনের বাসিন্দা সৈয়দ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ও নাজমা বেগমের দুই মেয়ের মধ্যে বড় ছিলেন ফাহমিদা (২৬)। তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুলে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। স্কুলে খেলাধুলাসহ সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন তিনি। কিন্তু বিয়ের পর তাঁর আর পড়াশোনা এগোয়নি।ফাহমিদার পরিবার জানায়, সিফাতরা দুই ভাই-বোন। সিফাতের আয়ের উৎস শেওড়াপাড়ায় থাকা তাঁর পৈতৃক সম্পদ (বাড়ি-বিপণিবিতান)।

সেদিন রাতে কী ঘটেছিল, তা
পরিবারের সদস্যরা জেনেছেন ফাহমিদার বড় সন্তানের (১১) কাছ থেকে জেনেছেন, রাত সাড়ে ১১টার দিকে ফাহমিদা রান্না করছিলেন। সে সময় বাইরে থেকে আসেন সিফাত। দুজনের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়। ফাহমিদাকে মারধর শুরু করেন সিফাত। ফাহমিদা বাঁচার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে তাঁকে ঘরের কক্ষে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন সিফাত। দিবাগত রাত প্রায় দুইটার দিকে ফাহমিদার পরিবারকে ফোন করেন সিফাত। তিনি বলেন, ‘কেয়া খুবই অসুস্থ, আপনারা দ্রুত বাসায় আসেন।’

প্রথমে পরিবারের সদস্যদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও পরে পান্থপথের একটি বেসরকারি হাসপাতালে যেতে বলা হয়। হাসপাতালে গিয়ে মা-বাবা দেখেন, ফাহমিদা বেঁচে নেই। সিফাত দাবি করেন, ফাহমিদা আত্মহত্যা করেছেন। একপর্যায়ে লাশ হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যান সিফাত। সন্তানদের বোনের বাসায় রেখে নিজেদের বাসা তালা মেরে পালিয়ে যান তিনি।

শামসুদ্দোহা খান বলেন, পুলিশ নিয়ে তালা ভেঙে তাঁরা শেওড়াপাড়ার বাসায় ঢোকেন। বাসায় ঢুকে দেখেন, রান্নাঘরে রান্নার আয়োজন রাখা। চুলায় হাঁড়ি বসানো। হাঁড়িতে মাংস-মসলাপাতি দেওয়া। রান্নার আয়োজন চলা অবস্থায় চার সন্তান রেখে ফাহমিদা আত্মহত্যা করেছেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। থানায় মামলা করতে বেগ পেতে হয়েছে। ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে তাঁরা সন্দিহান। তাঁদের জানামতে, এখন পর্যন্ত আসামিদের কেউ গ্রেপ্তার হননি।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জাতীয় নারী সুরক্ষা হেল্পলাইন ‘১০৯’-এর তথ্য অনুসারে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ৭ মাসে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার নারীর জন্য সহায়তা চেয়ে কল এসেছে ৪৮ হাজার ৭৪৫টি।

মিরপুর মডেল থানার ওসি মো. সাজ্জাদ রোমন থানায় মামলা করতে ভুক্তভোগী পরিবারের বেগ পাওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মামলাটি নিয়ে পুলিশের একাধিক দল কাজ করছে। তদন্ত অনেক দূর এগিয়েছে। খুব শিগগির রহস্য উন্মোচন হবে। প্রধান আসামিকেও (সিফাত) গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। খুব শিগগিরই রহস্যের উন্মোচন হবে।’

দাম্পত্য কলহে স্ত্রীর লাশ পুকু-
গত ১৮ জুন সিলেটের গোলাপগঞ্জে স্ত্রীকে হত্যা করে লাশ পুকুরে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে স্বামীর বিরুদ্ধে। নিহত নারীর নাম সাবিনা বেগম (৩০)। তাঁর স্বামীর নাম আনু মিয়া (৩৫)। ঘটনার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।ঘটনার বিষয়ে গোলাপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মোল্যা দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, আনু ও সাবিনার মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দাম্পত্য কলহ চলছিল। এর জেরে হত্যার ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। নিহত সাবিনার গলায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

মাদকাসক্তে ট্রিপল মার্ডার –
পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রী, সন্তান ও স্ত্রীর বড় বোনকে হত্যার অভিযোগে গত এপ্রিলে গ্রেপ্তার হন ইয়াছিন আলী নামের এক ব্যক্তি। ঘটনাটি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানার। পুলিশ জানায়, ইয়াছিন মাদকাসক্ত ও বখাটে। উচ্ছৃঙ্খলতা ও ভাঙচুরের অভিযোগে তাঁর সৎমায়ের করা মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে ছিলেন। সে সময় তাঁর স্ত্রী লামিয়া আক্তার (২৩) চার বছর বয়সী সন্তান আবদুল্লাহ রাফসানকে নিয়ে বড় বোন স্বপ্না আক্তারের (৩৫) বাসায় গিয়ে ওঠেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর গত ৮ এপ্রিল ইয়াছিন তাঁর স্ত্রীর বোনের বাড়িতে যান। পারিবারিক কলহের একপর্যায়ে তিনি লামিয়া ও স্বপ্নাকে গলা কেটে ও শিশুসন্তানকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। পরে তিনি লাশ তিনটি বস্তাবন্দী করে মাটিচাপা দেন।

জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’-এর তথ্য অনুসারে, গত জানুয়ারি থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত সাড়ে ৮ মাসে নারী নির্যাতনের ঘটনায় ১৭ হাজার ৩৪১টি কল এসেছে। এর মধ্যে পারিবারিক নির্যাতনের অভিযোগে কল এসেছে ৯ হাজার ৭৪৬টি। এসব কলের মধ্যে শুধু স্বামীর বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এসেছে ৯ হাজার ৩৯৪টি।

পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও আইন প্রয়োগে দুর্বলতার কারণে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা ঘটে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মনিরুল আই খান। তিনি দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন, একটি মেয়ে যখন বিয়ের মাধ্যমে নতুন কোনো পরিবারে যান, তখন তাঁর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন চান, তাঁদের প্রতিটি কথা মেয়েটি মেনে নেবেন। এ ধরনের পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি নির্যাতনের ক্ষেত্র তৈরি করে।

যে নারীর পড়াশোনা কম, পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল, তাঁরা বেশি নির্যাতনের শিকার হন। বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে সমাজে একধরনের সংস্কার আছে। ফলে মেয়েদের পরিবার চায়, যেভাবেই হোক মেয়ে যেন সংসার টিকিয়ে রাখেন। এ মনোভাব থেকে নির্যাতনের ঘটনা বাড়ে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বল অবস্থার কারণেও নির্যাতনের ঘটনা বাড়ে। তিনি বলেন, নারীদের অবশ্যই নির্যাতনমূলক সম্পর্ক থেকে বের হয়ে যেতে হবে। এর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়াও জরুরি। সমাজে শাস্তির ভয় থাকলে নির্যাতনের মাত্রা কমে।