কলরেকর্ড চলছেই

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে আড়িপাতা হতো। আড়িপেতে ক্ষমতার পাকাপোক্ত করছিল হাসিনা সরকার। একাজে২০১৫ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ১০ বছরে নজরদারি আর স্পাইওয়্যার কিনতে বাংলাদেশ খরচ করছে ১৯ কোটি ডলার।বাংলাদেশী টাকায় যা দুই হাজার কোটিরও বেশি।
লাবণ্য চৌধুরী : এখনও বন্ধ হয়নি কল রেকর্ড; নজরদারি’ও চলছে নানাভাবেই! যদিও সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে ‘জনগণের ওপর এখনও নজরদারি করা হচ্ছে কি না’ সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “সরকার বেআইনি কোনো কাজ করছে না”। অথচ টেক গ্লোবালের গবেষণা সামনে আসার পর, আড়িপাতার যন্ত্র কেনার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি তদন্ত কমিটি গঠনে করেছে সরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয়ভাবে আড়িপাতা হতো। আড়িপেতে ক্ষমতার পাকাপোক্ত করছিল হাসিনা সরকার। একাজে২০১৫ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ১০ বছরে নজরদারি আর স্পাইওয়্যার কিনতে বাংলাদেশ খরচ করছে ১৯ কোটি ডলার।বাংলাদেশী টাকায় যা দুই হাজার কোটিরও বেশি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের নজরদারি পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা প্রযুক্তি বিষয়ক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের করা সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, নজরদারি কেবল কল রেকর্ডেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং যেকোনো ডিভাইসের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল।
এছাড়াও ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে আড়িপাতার সরঞ্জাম কেনার প্রবণতা বেড়ে গিয়েছিল, যা থেকে বোঝা যায় ভিন্নমত দমনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখতেই এসব নজরদারি প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়েছে। তবে গত বছর গণঅভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পরও এমন কিছু ভিডিও বা আলাপচারিতা ছড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে, যার পেছনে শোনা যায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টতার গুঞ্জন।
আড়িপাতার সব যন্ত্র এখনও বহাল তবিয়তে আছে। বহাল আছে নজরদারি করা প্রতিষ্ঠান ও সরঞ্জাম। ফলে জনসাধারণের ওপর আড়িপাতার সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। একইসাথে বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচ করে গণ-নজরদারির জন্য যে বিস্তৃত কাঠামো তৈরির তথ্য সামনে এসেছে, তা যথাযথ আইনি ব্যবস্থার মধ্যে আনতে না পারলে আবারও অপব্যবহার হবার শঙ্কা করছেন অনেকে।
এ প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ২০১৫ সালে প্রয়াত বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে তার ফোনে কথোপকথনের একটি রেকর্ড ফাঁস করা হয়। সেই ফোন রেকর্ডের ওপর ভিত্তি করে মান্নার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও সেনাবাহিনীকে বিদ্রোহের জন্য উসকানি দেয়ার অভিযোগ আনা হয়। যার ফলে দুই বছর জেলও খাটেন এই রাজনীতিবিদ। তিনি বলেন, আড়িপাতার কোনো প্রযুক্তি ব্যবহার করেই কল রেকর্ড ধারণ করা হয়েছিল।
এদিকের সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নজরদারি আরো বেড়েছে। নজরদারি ও আড়িপাতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওঠা সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশনস মনিটরিং সেন্টার – এনটিএমসি এখনও চালু রয়েছে। ২০০৮ সালে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মোবাইল অপারেটরদের অর্থায়নে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই’র ভবনে গঠিত হয় ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার – এনএমসি। পরে ২০১৩ সালে তা নাম বদলে এনটিএমসি হয়। ২০১৪ সাল থেকে স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে এটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কার্যক্রম শুরু করে।
টেক গ্লোবাল ইন্সটিটিউটের হিসেবে, নজরদারি ও আড়িপাতায় সবচেয়ে বেশি খরচ করেছে এনটিএমসি, ২০১৬ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে যার পরিমাণ ৫২ মিলিয়ন ডলার বা ৬৩১ কোটি টাকা। জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন সংক্রান্ত জাতিসংঘের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং প্রতিবেদনেও সংস্থাটিকে বিলুপ্ত করার এবং জনগণের ওপর বেআইনি নজরদারি বন্ধের সুপারিশ করা হয়েছিল।
গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এনটিএমসি জনসাধারণের ওপর নজরদারি বন্ধ করেছে কি না, সে বিষয়ে জানতে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বকশ চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ‘এবিষয়ে জানানোর মতো এই মুহূর্তে কোনো তথ্য নেই’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির গনমাধ্যমকে বলেন, অভ্যুত্থানের পর বিভিন্ন ধরনের সংস্কার হলেও গোয়েন্দা সংস্থা বা তাদের কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়নি, যার প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু এক বছরেও তা না করায় নির্বাচন পরবর্তী সরকার চাইলেই আগের মতো ক্ষমতার ‘এবিউজ’ বা অপব্যবহার করতে পারবে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশে ২২টি আইনে নজরদারি কার্যক্রম বৈধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অথচ টেক গ্লোবাল ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অন্তত ২২টি আইনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নজরদারি কার্যক্রম বৈধতা পেয়েছে।
আর আড়িপাতার যে কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল, নির্ধারিত কোনো প্রক্রিয়া না মেনেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের তাতে প্রবেশাধিকার ছিল। অথচ বাক-স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা যেকোনো দেশেই, গোপনীয় তথ্য পেতে হলে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।মানবাধিকার আইনজীবী সারা হোসেনের মতে, ‘২২টি আইনে যেহেতু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এই ধরনের ক্ষমতা দেয়া আছে, সেটার একটি পর্যালোচনা হওয়া উচিত।’
একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বরাতে এসেছে উল্লেখ করে সারা হোসেন বলেন, অন্যান্য আইন নিয়ে যে পর্যালোচনা হয়েছে কিংবা সংস্কার কমিশনের যেসব প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেখানেও এবিষয়টি আলোচনায় আসেনি। এটা যেহেতু অনেক বড় কনসার্ন ছিল অনেকের, গণঅভ্যুত্থানের সময়ও যে আড়িপাতা হতো, বিভিন্নভাবে তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে অনেককে গুরুতরভাবে হয়রানি করা হয়েছে, সেজন্য এই সময়ে এই ধরনের পর্যালোচনা খুবই জরুরি।’
এ বছরের ২৫শে মার্চ জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘স্টারলিংক চালু হলে ভবিষ্যতে কোনো সরকার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে মানুষকে আর তথ্যবন্দি করার সুযোগ পাবে না।’অথচ স্টারলিংকের খসড়া গাইডলাইনে নজরদারি ও আড়িপাতার সুযোগ রাখা হয়েছে। লাইসেন্স পাওয়ার জন্য মোবাইল অপারেটরদের দুই বছর পর্যন্ত ফোন রেকর্ড আর ছয় মাস পর্যন্ত ইন্টারনেট ডেটা রেকর্ডের নীতিমালাও আছে অপরিবর্তিত।
ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত জাতিসংঘের প্রতিবেদনে, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছিল। সম্প্রতি সেই উদ্যোগও নিয়েছে সরকার। তবে আইনটি সংশোধনের যে প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে, সেখানে আড়িপাতার বিষয়টি আগের মতোই রয়েছে বলে খবর এসেছে গণমাধ্যমে।এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ সাবির মনে করেন, ‘জুডিশিয়ারি, অন্য লিগ্যাল সিস্টেম, বুরোক্রেসি – সবগুলোকেই একটা চেক এন্ড ব্যালেন্সের জায়গায় রাখতে হয়।’তার মতে, প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা চাওয়ার যে প্রবণতা আছে, তা নিয়ন্ত্রণের জায়গা থাকা প্রয়োজন। “সেই জায়গাটা আমাদের দেশে আসলে মিসিং।’একই কথা বলছেন সারা হোসেনও। তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো ব্যক্তিগত তথ্য কীভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হচ্ছে- সেটা দেখার মতো “রক্ষাকবচ হিসেবে কোনো স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ” নেই। সরকারি কর্তৃপক্ষ সরাসরি এ ধরনের তথ্য নিয়ে নিচ্ছে।’