টেকনাফে উত্তেজনা-ওপারে গোলাগুলি এপারে উত্তাপ-কক্সবাজারে রোহিঙ্গা সম্মেলন

আন্তর্জাতিক সম্মেলন ঘিরে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে টেকনাফ সীমান্তে। রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরাতে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ফেরাতে রোববার কক্সবাজারে শুরু হচ্ছে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ঠিক তার আগ মুহূর্তে গোলাগুলির ঘটনার খবরে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে টেকনাফে।
লাবণ্য চৌধুরী : ওপারে গোলাগুলির শব্দ এপারে রবিবার রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঘরে ফেরানোর তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন ঘিরে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে টেকনাফ সীমান্তে। এঅবস্থায় রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরাতে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ফেরাতে রোববার কক্সবাজারে শুরু হচ্ছে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। ঠিক তার আগ মুহূর্তে গোলাগুলির ঘটনার খবরে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে টেকনাফে। টেকনাফের ই্উএনও শেখ এহসান উদ্দীন দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেছেন, এপারে নতুন করে অনুপ্রবেশের কোনো তথ্য তার কাছে নেই।
এ প্রসঙ্গে টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে বলেন,কিছু লোক সীমান্তে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। কিন্তু আমরা কাউকে ঢুকতে দিচ্ছি না।যেসব পয়েন্ট দিয়ে প্রবেশের চেষ্টা করছে, সেখানে আমরা টহল বৃদ্ধি করেছি। ওদিকে ‘রোহিঙ্গাদের বাড়ি’ ফেরানোর আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আগে ‘বড় ধরনের সংঘাতের আশঙ্কায়’ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বাড়িঘর ছেড়ে অনুপ্রবেশের আশায় সীমান্তে অবস্থান করছেন শত শত রোহিঙ্গা। এপারে ভেসে আসছে ওপারের সংঘাতের গোলার শব্দও।
কক্সবাজারের উপকূলবর্তী রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের বসবাসরত রোহিঙ্গারা রাখাইনে থাকা আত্মীয়-স্বজনদের মাধ্যমে এ ধরনের খবর পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। রোহিঙ্গারা ওপারের স্বজনদের বক্তব্যে বলছেন, রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের দক্ষিণে মেরুল্লা এলাকায় মিয়ানমারের জান্তা সরকার নতুন করে সেনা মোতায়েন করেছে। আর এই খবরে সেখানকার স্থানীয় রোহিঙ্গাদের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ-
টেকনাফের আশ্রয়শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গারা জানান, ওপারে থাকা তাদের স্বজনদের কাছ থেকে খবর এসেছে, তারা জান্তা সেনা ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ আশঙ্কায় শত শত রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছেড়ে বাংলাদেশের জালিয়া দ্বীপের বিপরীতে মিয়ানমারের লালদিয়া নামক দ্বীপে আশ্রয় নিয়েছে।তবে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষা বাহিনী-বিজিবির কড়া নজরদারির কারণে শনিবার দুপুর পর্যন্ত তারা নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারেনি।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মো. জুবায়ের বলেন, “মংডু এলাকায় সেনা ও আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষের শঙ্কায় অনেক রোহিঙ্গা লালদিয়াতে জড়ো হয়েছে। তারা সুযোগ পেলে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করতে পারে।”তিনি বলেন, “এর আগে আরাকান আর্মি ও জান্তা সৈন্যদের মধ্যে মংডু এলাকায় সংঘর্ষের সময় রোহিঙ্গা গ্রামগুলোকে যুদ্ধক্ষেত্র বানানো হয়েছিল। গোলাগুলি ও বোমা হামলায় অনেক রোহিঙ্গা প্রাণ হারায়। তাই এবার তারা সেই অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি এড়াতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসার চেষ্টা করছে।”আরাকান আর্মির নির্যাতন ও চাঁদাবাজি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার আরেকটি কারণ বলে মনে করেন জুবায়ের।
টেকনাফের ২৭ নম্বর ক্যাম্পের মাঝি মোহাম্মদ কালাম বলেন, শুক্রবার সকাল ১০টার দিকে মিয়ানমার নেভির একটি জাহাজে প্রায় ৩০০ জানতা সেনা মেরুল্লা এলাকায় অবস্থান নেয়। দুপুর ২টার দিকে তারা স্থানীয়ভাবে ‘বিজিপি ক্যাম্প-৮’ নামে পরিচিত আরাকান আর্মির ঘাঁটিতে ড্রোন হামলা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন আরাকান আর্মির সদস্য নিহত হয় এবং বাকিরা পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়।তিনি আরও বলেন, “সংঘর্ষের পর স্থানীয় রোহিঙ্গাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে প্রায় ৭০০ রোহিঙ্গা ঘরবাড়ি ছেড়ে লালদিয়াতে আশ্রয় নেয় এবং বর্তমানে তারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে।”
মাঝি মোহাম্মদ কালাম এসব খবর তার স্বজন ও ওপারের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে পেয়েছেন বলে জানান।টেকনাফে অবস্থানরত তিনজন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা নিশ্চিত করেছেন যে, জান্তা সেনারা মংডুর দক্ষিণাঞ্চলে প্রবেশ করেছে। তবে কতজন রোহিঙ্গা লালদিয়াতে আশ্রয় নিয়েছে, তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তাদের হিসেবে সংখ্যা ৪০০ থেকে ৭০০ এর মধ্যে হবে।
কিছুদিন আগে মংডু থেকে পালিয়ে আসা করিমুল্লাহ নামে এক রোহিঙ্গাও জান্তা ও আরাকান আর্মির সংঘর্ষের খবরে শরণার্থীদের বাংলাদেশমুখী হওয়ার তথ্য জানিয়েছেন।কিন্তু শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, তার কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য নেই।তবে কমিশনের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, বৃহস্পতিবার থেকে টেকনাফ সীমান্তে বিজিবির সদস্যদের তৎপরতা বেড়েছে।
ওপারে গোলাগুলির শব্দ
অনুপ্রবেশের আশায় ওপারে রোহিঙ্গাদের বসে থাকার খবরের মধ্যে শুক্রবার মধ্যরাত থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত ফের গোলার শব্দ ভেসে এসেছে।টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তে নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারে ব্যাপক গোলাগুলির শব্দ পায় সীমান্ত পাড়ের লোকজন।টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের ২ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য সিরাজুল মোস্তফা চৌধুরী লালু বলেন, “গত রাত থেকে আজ ভোর পর্যন্ত থেমে থেমে সীমান্তের ওপারে কুমিরখালী, শীলখালী ও সাইডং এলাকা থেকে ব্যাপক গোলাবারুদের শব্দ পাওয়া গেছে। ফলে সীমান্তের কাছাকাছি চিংড়ির প্রজেক্টে থাকা লোকজন ভয়ে পালিয়ে এসেছে।”
তিনি বলেন, “দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর ফের গোলার শব্দ পাওয়া গেছে। ফলে আবার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের শঙ্কা রয়েছে।”গোলার শব্দ পেয়েছেন একই ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডর মেম্বার হাজি জালাল আহমদ। তিনি বলেন, “আমি অসুস্থ। ভোরে উঠেছিলাম, তখন বেশ কয়েকটি গুলির শব্দ পেয়েছি।”
হোয়াইক্যংয়ে বেড়িবাঁধের কাছাকাছি চিংড়ি প্রজেক্টে বসবাসকারী আব্দুর রহমান বলেন, “গতকাল রাত থেকে মিয়ানমারের ওপার থেকে গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। শনিবার ভোরেও সকালে কয়েকবার গোলার বিকট আওয়াজ পেয়ে পার্শ্ববর্তী বাজারের কাছাকাছি দৌড়ে আসি। এই সীমান্তের ওপারে ফের যুদ্ধের মতো গোলার শব্দ ভেসে আসছে।”
এ ব্যাপারে বিজিবি-২ টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, “গেল রাতে সীমান্তের ওপার থেকে গোলার শব্দের বিষয়টি জেনেছি। কিন্তু সেটি আমার ইউনিটের বাইরে।”গোলাগুলির শব্দ আসা টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্ত ৬৪ বিজিবির আওয়াতাধীন।৬৪ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. জসিম উদ্দিন জানান, ওপারে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। এ ব্যাপারে বিজেপি সতর্ক আছে।তবে কাদের মধ্যে এ গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা আন্তজার্তিক সম্মেলন-
রোহিঙ্গাদের দিকে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি ফেরাতে রোববার থেকে কক্সবাজারে শুরু হচ্ছে তিন দিনের সম্মেলন। যে সম্মেলনের অন্যতম উদ্দেশ্য রোহিঙ্গাদের ‘বাড়ি ফেরানো’ অর্থাৎ ‘নিরাপদ প্রত্যাবাসন’। গত বছরের শুরুতে সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমার সেনা ও আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়। ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে মংডু টাউনশিপ দখল করে আরাকান আর্মি। বর্তমানে রাখাইনের ১৭টি টাউনশিপের মধ্যে ১৪টিই তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এলাকা পুনর্দখলে মরিয়া মিযানমারের সেনারা সম্প্রতি নতুন করে অভিযান শুরু করেছে।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধিরা সেখানে রোহিঙ্গাদের কথা শুনবেন। নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরবেন জাতিগত নিধনের শিকার মিয়ানমারের রাখাইনের এ জনগোষ্ঠী।দ্বিতীয় দিন সোমবার সম্মেলনে যোগ দেবেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান মুহাম্মদ ইউনূস। সমাপনী দিনেও রোহিঙ্গাদের নিয়ে বিভিন্ন সেশনে অংশ নেবেন তিনি।এই সম্মেলনে অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে রোহিঙ্গা সিভিল সোসাইটির সভাপতি ১৫ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা মৌলভী সৈয়দ উল্লাহর।
তিনি বলেন, আমারা অধিকার, মর্যাদা এবং সমতার সঙ্গে নিজেদের মাতৃভূমি আরাকানে ফিরতে চাই। সে লক্ষ্যে আমরা রোহিঙ্গারা ঐক্যবদ্ধ। সুযোগ পেলে নিজভুমিতে ফেরার আকুতি জানাবো বিশ্ব প্রতিনিধিদের কাছে।রোহিঙ্গা অধিকারকর্মী খিন মং বলেন, “আমাদের দায়িত্ব হলো আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে যুক্ত থাকা, ক্যাম্পে শান্তি বজায় রাখা এবং শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো আমাদের প্রত্যাবাসন।