রাজনীতি

পাকিস্তান টাকা দেয়না-পাওনা ৪০০০ মিলিয়ন ডলার

১৯৭৪ সালের জুনের শেষদিকে ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরকালে দুটি দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে যে খসড়া দলিল দেওয়া হয়, তাতে সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওই সময়ের বৈঠকে বাংলাদেশ স্বর্ণ, বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ১১,০০০,০০০ ডলারসহ মোট ৪০০০ মিলিয়ন ডলার সম্পদ দাবি করে।

শফিক রহমান : পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশ তার পাওনা টাকা চাইতে গেলে কোনো সময়ই সঠিক জবাব দেয়নি পাকিস্তান। ইতিপূর্বে এনিয়ে বহুবার দেনদরবার হলেও পাকিস্তান নানা ছলচাতুরি করে বিষয়টি পাশ কাটিয়ে গেছে। সর্বশেষ রবিবার ২৪ আগস্ট একাত্তরের অমীমাংসিত ইস্যু সমাধানের বিষয়ে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার যে দাবি করেছেন, তার সঙ্গে একমত হতে পারেননি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেছেন, দুই দেশের অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে আগামী দিনে উভয় পক্ষই আলোচনা চালিয়ে যাবে। রোববার সকালে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। এরপর দুপুরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ওই বৈঠকের আলোচনা নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আপনারা বৈঠকে আলোচনা করেছেন বলে উল্লেখ করলেন। আবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর ইসহাক দার বলেছেন, বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি দুবার হয়েছে। আপনি বলছেন, আলোচনা করেছেন। এ নিয়ে যে অস্পষ্টতা, তা আপনি দূর করবেন কিভাবে? তিন অমীমাংসিত ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান কী—সে প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা চাই, হিসাবপত্র হোক, যেটা টাকাপয়সার ব্যাপার সমাধান হোক। আমরা চাই, এখানে যে গণহত্যা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করুক, মাফ চাইবে। আমরা চাই, আটকে পড়া মানুষগুলোকে তারা ফেরত নেবে। আমি বাংলাদেশের অবস্থান শক্তভাবে তুলে ধরেছি।’

ভূট্টোর বাংলাদেশ সফরে যা ঘটেছিল-

১৯৭৪ সালের জুনের শেষদিকে ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরকালে দুটি দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে যে খসড়া দলিল দেওয়া হয়, তাতে সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। ওই সময়ের বৈঠকে বাংলাদেশ স্বর্ণ, বৈদেশিক মুদ্রার মজুতের ১১,০০০,০০০ ডলারসহ মোট ৪০০০ মিলিয়ন ডলার সম্পদ দাবি করে। (তথ্যসূত্র: Denis Wright, Bangladesh Origin and Indian Ocean Relations (1971-1975), Dhaka: Academic Publishers, 1988, p. 198)

অবশ্য প্রথমদিকে বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আলোচনা করতেই রাজি হয়নি। ভুট্টো মনে করেন, তাঁর সফরসঙ্গীর ১০০ জনের মধ্যে কোনো বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। বাংলাদেশের চাপে পাকিস্তান এ বিষয়ে শেষ পর্যন্ত একটি কমিটি গঠনে রাজি হয়। তবে পাকিস্তান এ কথাও জানিয়ে দেয় যে নীতিগতভাবে সে এই প্রস্তাব গ্রহণে প্রস্তুত নয়। (তথ্যসূত্র: Dilara Chowdhury, Bangladesh and South Asian International System, Dhaka: Academic Publishers) এর থেকে এই ইস্যুতে ভুট্টোর কমিটি গঠনের প্রস্তাবটি যে সময় ক্ষেপণের চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই ছিল না সেটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই বৈঠকে বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা, অস্থাবর সম্পত্তি, শিপিং, বিমানসহ সব সম্পদ নিয়ে গিয়েছে। তাই তিনি শুধু মজুত স্বর্ণ ও বৈদেশিক মুদ্রার খাতে শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ কিছু অর্থ দুই মাসের মধ্যে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। (তথ্যসূত্র: New York Times, 9 July 1974) কিন্তু পরে পাকিস্তান এই প্রস্তাব শুধু প্রত্যাখ্যানই করেনি, বরং কোনো কোনো উৎস থেকে ভুট্টোর বাংলাদেশের কাছে বৈদেশিক ঋণ খাতে পাল্টা ৪-৬ বিলিয়ন ডলার দাবির প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। (তথ্যসূত্র: Ibid, 29 June 1974) পাকিস্তানের এই অনমনীয় মনোভাবের ফলে অমীমাংসিত ইস্যু বিশেষ করে সম্পদ বণ্টন বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি এবং বাংলাদেশের দৃষ্টিতে সফরটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। যদিও পাকিস্তানের দৃষ্টিতে অমীমাংসিত ইস্যু মীমাংসার লক্ষ্য থেকে নয়, বরং সফরটি ছিল মূলত অনুসন্ধানমূলক এবং তাই এটি সফল।

অবশ্য পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী দলগুলো স্বাধীনতার পর স্বীকৃতির বিরুদ্ধে অন্যতম যুক্তি হিসেবে বাংলাদেশের পাওনা সম্পদ-সংক্রান্ত দাবিকে তুলে ধরে। ভুট্টোর সফরের সময় তারা বাংলাদেশের এই দাবির সমালোচনায় আবারও মুখর হয়ে ওঠে। স্বয়ং ভুট্টো ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকা এলেও সফরের ব্যর্থতার বিষয়টি আড়াল করতে দেশে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের দাবির সমালোচনায় এসব দলের সঙ্গে একাত্ম হন।

১৯৭৪ সালের ২০ ডিসেম্বর ফরেন প্রেস অ্যাসোসিয়েশন অব পাকিস্তানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন সম্পদ বণ্টনের নতুন বিষয় উত্থাপন করছে। আমি খুশি হতাম যদি সম্পদ বণ্টনের পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ এবং তার দায়-দায়িত্বের বিষয় নিয়েও আলোচনা হতো। কিন্তু তারা শুধু সম্পদ চায়, দায় গ্রহণ করতে চায় না। এর অর্থ দাঁড়ায় জনসংখ্যার ভিত্তিতে তারা ৫৬ শতাংশ সম্পদ পাবে এবং পাকিস্তান তাদের তা দিয়ে দেবে। যা আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো অসম্ভব এবং এর ফলে সম্পর্ক স্থাপন বাধাগ্রস্ত হবে। (তথ্যসূত্র: POT Pakistan Service, Vol. II, 30 December 1974, p, 956)

ওদিকে ১৯৭৫-এর ফেব্রুয়ারি মাসে জাপানের দৈনিক মিয়ানচি পত্রিকায় দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশের সম্পদ দাবির সমালোচনা করেন। (তথ্যসূত্র: Pakistan Times, 18 February 1975) অন্যদিকে পাকিস্তান কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হলে বাংলাদেশ এ ব্যাপারে পূর্বশর্ত হিসেবে সম্পদ বণ্টন ও অবাঙালি প্রত্যাবাসনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়। এ বিষয়ে দুটি দেশের দৃষ্টিভঙ্গিগত অমিলের কারণেই শেখ মুজিব আমলে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়নি। দ্বিপক্ষীয়ভাবে সম্পদ বণ্টন বিষয়ে তেমন অগ্রগতি না হওয়ায় বাংলাদেশ ইস্যুটির অনুকূলে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের চেষ্টা চালায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পথে ১৯৭৪ সালের ৪ অক্টোবর লন্ডনে হিথরো বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অগ্রগতি অমীমাংসিত সমস্যাবলির সমাধানের ওপর নির্ভরশীল। আমরা আমাদের সম্পদের ন্যায্য হিস্যা চাই। আমরা তো কারও কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি না। (তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলা, ৫ অক্টোবর ১৯৭৪)

বাংলাদেশের সম্পদের হিসাব ওআইসি সম্মেলনে-

১৯৭৫ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত জ্যামাইকার রাজধানী কিংসটনে কমনওয়েলথ সরকার-প্রধানদের বৈঠকে সম্পদ বণ্টন-সংক্রান্ত ইস্যুটির সমাধানে আলাদাভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেলমন্ত্রী ওতেইবা ১৮ জুন ঢাকা সফর শেষে পাকিস্তান সফর করেন। এরপর ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে জেদ্দায় ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্পদ বণ্টন-সংক্রান্ত ইস্যুটি উত্থাপন করার সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা ফিরেই বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের এমন একটি ধারণাও দেন। (তথ্যসূত্র: POT Pakistan Services, Vol, III Part 4, 16 July 1975, p. 433)

বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কূটনৈতিক উদ্যোগ অব্যাহত রাখে এবং কুয়েত, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের মধ্যে যেকোনো একটি দেশের মধ্যস্থতা কামনা করে। ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশের উদ্যোগের কারণে তিনটি বিষয় সফল হয়: প্রথমত, পাকিস্তানের অপচেষ্টা সত্ত্বেও মুসলিম দেশ, বিশেষ করে আরব দেশগুলো সম্পদ বণ্টন বিষয়ে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে; দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ আরব বিশ্বের পূর্ণ আস্থা অর্জন করে; তৃতীয়ত, পাকিস্তানের অপপ্রচার ব্যর্থ হয় এবং সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে আসন্ন জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে আবারও আলোচনা হবে। (তথ্যসূত্র: Iftekhar A. Chowdhury, “Bangladesh’s External Relations: the Strategy of Small Power in A sub-System,” Unpublishet Phd. Thesis, Canberra : Australian National University, 1979, p. 124)

অবশ্য পাকিস্তানের পত্রপত্রিকায় বাংলাদেশের সম্পদ বণ্টন ইস্যু উপস্থাপনের সমালোচনা করে মন্তব্য করা হয় যে যেহেতু বিষয়টি খুবই জটিল, তাই বাংলাদেশের প্রথম সহজ সমস্যাগুলোর সমাধান করে এদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। (তথ্যসূত্র: POT Pakistan Series, op.cit, p. 433) অবশ্য পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত অপর ইস্যু অর্থাৎ বিহারি প্রত্যাবাসনও ছিল একই ধরনের জটিল সমস্যা এবং বাংলাদেশ সম্পর্কের পূর্বশর্ত হিসেবে এ দুটো বিষয়কেই চিহ্নিত করে। তাই পাকিস্তানের পত্রিকাগুলো নিছক সমালোচনার স্বার্থে সমালোচনা করলেও সমস্যা সমাধানে কোনো পথ দেখায়নি।

১৯৭৫ পরবর্তী সম্পদ বণ্টন ইস্যু-

তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডের ফলে আগস্টে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে পূর্ব নির্ধারিত সম্পদ বণ্টন ইস্যুটি উত্থাপিত হয়নি। পাকিস্তানের সঙ্গে দ্রুত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে অতি-উৎসাহের কারণে বাংলাদেশের নতুন শাসকেরা সম্পদ বণ্টনের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে এড়িয়ে যাওয়াই সঠিক মনে করেন। এমনকি সম্পদ বণ্টনের দাবি প্রত্যাহারেও রাজি হয় এবং সেই শর্তেই অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

এর ফলে আন্তর্জাতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার সুফল ঘরে আনতে ব্যর্থ হয় এবং লেনদেনে এবারও বঞ্চিত হয়। ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ এক সরকারি ঘোষণায় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে খুশি হয়, কারণ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বড় অংশই তাদের মালিকানাধীন ছিল এবং এ খাতে বিদেশি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সরকারের কাছে পাওনা ছিল প্রায় ৫০.৫ মিলিয়ন ডলার, যার বড় অংশই ছিল পাকিস্তানিদের। (তথ্যসূত্র: মতিউর রহমান, পূর্বোক্ত, পৃ. ২৬) বাংলাদেশে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ হওয়া সত্ত্বেও সরকার ১৯৭৮ সাল থেকে কিছু কিছু পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ দিতে থাকে।

১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে সরকারের এক আদেশে পরিত্যক্ত সম্পদের মালিকানা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সাপেক্ষে পরিত্যক্ত সম্পত্তির দাবি করে হাইকোর্টে রিট আবেদনের সুযোগ পান। এই অধ্যাদেশে যেসব অবাঙালি প্রতিষ্ঠানের শতকরা ৬০ ভাগের বেশি মালিকানা বাঙালিদের হাতে ন্যস্ত সে সমস্ত সম্পত্তির বেলায় আলাদা নিয়ম জারি করা হয়। এ নিয়ম অনুযায়ী পরিত্যক্ত সম্পত্তির বাঙালি মালিকদের অংশ বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ অধ্যাদেশের পরপর দুই প্রক্রিয়ায় সরকার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরোনো নন-জুডিশিয়াল স্টাম্পে পাকিস্তান মালিকানাধীন পরিত্যক্ত শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের শতকরা ৬০ ভাগের বেশি মালিকানা বাঙালিদের অনেকে নিজেদের নামে লিখিয়ে আনে ও পরবর্তীকালে সেসব সম্পত্তির ওপর নিজেদের অধিকার দাবি করে।

রিটের মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিক হয় পাকিস্তানিরা

এরপর পাকিস্তানি মালিকেরাও ঢাকা এসে নিজেদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি পুরোনো দলিলের মাধ্যমে কম ক্ষেত্রে পাকিস্তানি মালিকেরাও ঢাকা এসে নিজেদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি পুরোনো দলিলের মাধ্যমে কম দামে বিক্রি করে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বহু অবাঙালি মালিক এ সুযোগে ঢাকা এসে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট, নন অপশন সার্টিফিকেট ইত্যাদি বের করে নিজেরাই রিটের মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিক হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্পত্তি ফিরে পাওয়া অবাঙালি ব্যবসায়ীরা তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে। এসব অবাঙালি টাকা পাকিস্তান বা অন্যত্র পাচার করে। এভাবে আইনের ফাঁকে অবৈধভাবে বাড়ি ও অন্যান্য সম্পত্তি নতুনভাবে হস্তান্তরিত হওয়ায় কোটি কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রার আকারে দেশের বাইরে পাচার হয়। অথচ কোনো বাঙালি পাকিস্তানে অবস্থিত তাদের সম্পত্তির ওপর মালিকানা ফিরে পায়নি। (তথ্যসূত্র: জগলুল আলম, “করাচিতে লেনদেন ২০ কোটি টাকার লোকসান”, সাপ্তাহিক বিচিত্রা ১৯৮১, পৃ. ২১-২২)

১৯৭৬ সালে পাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগা শাহী’র অস্বীকার-

বাংলাদেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার আকাঙ্ক্ষা থেকে সম্পর্ক জোরদারের পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও পাকিস্তান স্বাধীনতার আগে ও পরে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার নীতি অব্যাহত রাখে। ফলে বাংলাদেশের আশাবাদ নিরাশায় পরিণত হয়। ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগা শাহী ঢাকা সফরে এলে বিষয়টি প্রথমবারের মতো নতুন সরকারের আমলে উত্থাপিত হলে তিনিও বিষয়টির ওপর বিস্তারিত মূল্যায়ন প্রয়োজন বলে তাঁর পূর্বসূরিদের মতো তা এড়িয়ে যান। ১৯৭৭ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব তবারক হোসেনের পাকিস্তান সফরকালে সম্পদ বণ্টন প্রসঙ্গটি আবারও উত্থাপন করা হলে জেনারেল জিয়াউল হকের সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক সংকটের দোহাই দিয়ে বিষয়টি আবারও এড়িয়ে যায়। একই বছরের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া পাকিস্তান সফরকালে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় সম্মত বলে উল্লেখ করা হয়। (তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩ ডিসেম্বর ১৯৭৭)

তবে আগা শাহীর একটি মন্তব্য থেকে বোঝা যায় এ বিষয় পাকিস্তান কতটুকু আন্তরিক ছিল। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন, বাংলাদেশ যেহেতু উত্তরাধিকার রাষ্ট্র নয় তাই সে সম্পদের দাবি করতে পারে না। বাংলাদেশ এই মন্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করে এবং সমতার ভিত্তিতে সম্পদের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরে। (তথ্যসূত্র: Mohammad Shamsul Haq, Bangladesh in International Politics the Dilemmas of the Weak States, Dhaka: UPL, 1993, p. 156)

বাংলাদেশের এই প্রতিবাদের কোনো জবাব পাকিস্তান না দিলেও বাংলাদেশ তার সম্পদের হিস্যার দাবিতে অনড় থাকে। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শামস-উল-হক পাকিস্তানের কাছে এ বিষয়টি উত্থাপন করলে তারা জানায়, পাক পররাষ্ট্রসচিবের আসন্ন বাংলাদেশ সফরের সময় সচিব পর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু আগা শাহী না আসায় দীর্ঘদিন আর এ নিয়ে আলোচনা হয়নি।

পাকিস্তানের নতুন পররাষ্ট্রসচিবের ফের আশ্বাস-

দুই বছর পর পাকিস্তানের নতুন পররাষ্ট্রসচিব রিয়াজ পিরচা ১৯৮০ সালের ২৪ অক্টোবর তিন দিনের সফরে ঢাকা এলে বিষয়টি উত্থাপিত হয়। আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হয়, দুটি দেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন এবং দুই দেশের পররাষ্ট্রসচিবদের কাছে প্রেরিত রিপোর্টের ভিত্তিতে শিগগিরই ইসলামাবাদের সচিব পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এরপর দুদেশের পররাষ্ট্রসচিবদের কাছে রিপোর্ট পেশ করবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব এম এ এস কিবরিয়া সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে বৈঠক ও সিদ্ধান্তকে ইতিবাচক পদক্ষেপ বলে মন্তব্য করলেও সে যাত্রায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। (তথ্যসূত্র: The Hindu, 28 October 1980)

১৯৮০ সালে এ ব্যাপারে একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করলেও সম্পদ ভাগ-বাঁটোয়ারার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এরপর ১৯৮১ সালের মধ্যে পাকিস্তানের অসহযোগিতার কারণে এ সম্পর্কিত কোনো বৈঠকই হয়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব কাঠমান্ডু সফরকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবকে বৈঠক ডাকার আহ্বান জানালে দেশে ফিরে তিনি বৈঠকের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। তারপরও এ ব্যাপারে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। অবশ্য বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে দুরকমের বক্তব্য দেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পাকিস্তান সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে একটি যৌথ কমিশন গঠন-সংক্রান্ত বাংলাদেশের প্রস্তাবে রাজি হয়েছে। অন্যদিকে ১৯৮১ সালের ২৪ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান বলেন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে এটা একটা আলোচনাসাপেক্ষ ব্যাপার। এ ব্যাপারে আলোচনায় উভয় সরকার নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। (তথ্যসূত্র: দৈনিক সংবাদ, ২৫ এপ্রিল ১৯৮১)

সম্পদের হিসাব এড়িয়ে এরশাদ পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাব নিলেন-

এ থেকে বোঝা যায় যে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে কার্যত কোনো রকম অগ্রগতি হয়নি, বরং জিয়ার মৃত্যুর পরপর টাইমস অব ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে মন্তব্য করে যে বাংলাদেশ সম্পদের দাবি প্রত্যাহার করেছে। যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র একে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। সূত্রটি আরও উল্লেখ করে, ইতিমধ্যে ১৯৮০ সালে যে ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের সদস্যদের নাম পাকিস্তানকে জানানো হয়েছে এবং কমিটি শিগগিরই কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। (তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলা, ২৫ জুন ১৯৮১)

এরপর ১৯৮৬ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পাকিস্তান সফরে গেলে তাঁকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব দেওয়া হলেও সম্পদ বণ্টন বিষয় কোনো আলোচনা হয়নি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও খুব বেশি চাপ পাকিস্তানের ওপর ছিল না তা জেনারেল এরশাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদের ১৯৮৯ সালের ৮ জুনের একটি বিবৃতি থেকে বোঝা যায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রাপ্য সম্পদের সঠিক ও স্বীকৃত পরিমাণ নির্ণয়ের চেষ্টা নিরবচ্ছিন্নভাবে চালানো হচ্ছে। (তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ জুন ১৯৮৯)

এলেন বেনজির ভূট্টো-দায়সারা বিবৃতি

একই বছর অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ঢাকা সফরে এলে ‘বাংলাদেশের যখনই প্রয়োজন হবে পাকিস্তানিরা আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে’—এ ধরনের গালভরা মন্তব্য করলেও সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে যুক্ত বিবৃতিতে দায়সারা গোছের কয়েক লাইন এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়। বিবৃতিতে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত এ বিষয়ে একটি সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছানোর লক্ষ্যে আশু পদক্ষেপ গ্রহণে উভয় সম্মত হন বলে শুধু উল্লেখ করা হয়। এরপরও একই ধারার বিবৃতি দিয়ে সব সময় পাকিস্তান পাশ কাটিয়ে যায়। বিষয়টিকে বরাবর জটিল হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও জটিলতা নিরসনে কখনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তিন বছর দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৮৯ সালের অক্টোবর মাসে দেশে ফেরার প্রাক্কালে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনার রিয়াজ হোসেনের মন্তব্যে এর প্রতিফলন ঘটে। তিনি বলেন, I don’t think it will beg easy solution. These are very complicated and complex issues. But given the goodwill and understanding on both sides some sort of a solution could be found out.

নব্বইয়ের দশকে এসেও সম্পদ বণ্টন বিষয়টি গুরুত্ব পায়নি। বাংলাদেশের তৎপরতার অভাবে শুধু উভয় দেশের নেতাদের সফরকালে বিক্ষিপ্তভাবে বিষয়টি কখনো কখনো হালকাভাবে আলোচিত হয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেবজাদা ইয়াকুব খান ১৯৯০ সালের মার্চে ঢাকা সফরে এলে অমীমাংসিত বিহারি সমস্যা প্রসঙ্গে আলোচনা করলেও সম্পদ বণ্টন বিষয় গুরুত্ব পায়নি। তিনিও তাঁর পূর্বসূরিদের মতো বলেন, ‘সম্পদ ভাগাভাগির ব্যাপারটি অত্যন্ত জটিল। এ প্রশ্নে আরও অনেক আলোচনা করতে হবে। ত্বরিত কোনো সমাধান যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তা আশাপ্রদ নয়।’

একই বক্তব্য দেন পরের বছর এপ্রিলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত যোগাযোগমন্ত্রী মীর হাজাম খান। ঢাকা সফরে এসে তিনি সম্পদ বণ্টনের এমন সমাধান চেয়েছেন, যাতে উভয় দেশের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক দৃঢ় হবে। কিন্তু এই ভ্রাতৃত্ব কীভাবে দৃঢ় করা যায়—দাবিটি করে, নাকি প্রত্যাহার করে তা তিনি উল্লেখ করেননি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ১৯৯২ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান সফরের প্রাক্কালে পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয় উপস্থাপনার ব্যাপারটি বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনায় আসে।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং মন্তব্য করেন সম্পদ বণ্টন বিষয়টি আলোচনায় আসবে। ৫২ জন সফরসঙ্গী নিয়ে তিনি পাকিস্তান সফরে গেলেও এ ব্যাপারে যুক্ত ঘোষণায় এক লাইনের গতানুগতিক বিবৃতি ছাড়া প্রাপ্তিযোগ কিছুই ঘটেনি। যদিও প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব এ ব্যাপারে অগ্রগতিকে কিছুটা বাড়িয়ে বলার চেষ্টা করেন। তিনি মন্তব্য করেন উভয় দেশ দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান এ সমস্যার দ্রুত সমাধানে উপনীত হতে সম্মত হয়েছে।

২০০২ সালে পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ঢাকা সফরে-

দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৯৬ সালে সম্পদ বণ্টন বিষয় আবারও কিছু আলোচনা হয়। এ বছর আগস্ট মাসের ৯-১১ তারিখে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব পাকিস্তান সফরকালে এবং ১৬-১৮ আগস্ট পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিব নাজিমুদ্দিন শেখ ঢাকা সফরকালে সম্পদ বণ্টন বিষয় আলোচনা হয়। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রসচিবের মন্তব্য থেকে এ বিষয়ে তাদের পাশ কাটিয়ে যাওয়া নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন, সম্পদ বণ্টন ব্যাপারে পাকিস্তানের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে যে কারণে খুব দ্রুত এর সমাধান সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন পর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ বিষয় অগ্রগতি হবে, পর্যবেক্ষক মহল বেশ আশাবাদ ব্যক্ত করলেও ১৯৯৭ সালের ২৪ মার্চ পাকিস্তান সফর শেষে দেশে ফিরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার কথা উল্লেখ করেন। (তথ্যসূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, ২৫ মার্চ ১৯৯৭)
কোনো অগ্রগতি যে হয়নি তা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ থেকেই প্রমাণ হয়। ২০০২ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ঢাকা সফরে এলে আবারও হালকাভাবে সম্পদ বণ্টন বিষয়টি উপস্থাপিত হয়। উভয় দেশ তাঁর সফরে সন্তোষ প্রকাশ করলেও সম্পদ বণ্টন বিষয়টি ছিল ফলশূন্য।

খালেদা জিয়ার পাকিস্তান সফর-২০০৬ সালের ১২-১৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সফর করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। তাঁর সফরের প্রাক্কালে ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে আসন্ন পাকিস্তান সফরকালে বিহারি প্রত্যাবাসন ও সম্পদ বণ্টন বিষয় প্রধানমন্ত্রী পাকিস্তানে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা করবেন বলে জানান। যদিও খালেদা জিয়ার সফরকালে চারটি সমঝোতা স্মারক, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ দ্বিপক্ষীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয় সমঝোতা হলেও পাকিস্তানের সঙ্গে অমীমাংসিত সহযোগিতা বিষয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। দেশে ফিরে খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খান মনের মাধুরী মিশিয়ে আগের সব সফরের মতো ১৫ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, We’ve been discussing the issue and it will continue. (তথ্যসূত্র: Bangladesh Observer, 16 February 2006)এমনিভাবে অমীমাংসিত বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো চাপ না থাকায় দিনের পর দিন পাকিস্তান বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী শাসনামলেও এ ব্যাপারে কোনো আলোচনা হয়নি।

অমীমাংসিত সম্পদ বণ্টন বিষয়ে উপসংহারে বলা যায় যে বিগত সাড়ে তিন দশক দুদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের উভয় দেশ সফর এবং বিভিন্ন বৈঠকে সম্পদ বণ্টন বিষয় আলোচনায় উঠলেও কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। উভয় দেশের এসব সফরকালে সফরের বিপুল সাফল্য পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমে প্রচার করা হলেও বিধি মোতাবেক কোনো আলোচনা হয়নি। নামে মাত্র একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হলেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় ও বিভিন্ন পর্যায়ে তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও ওয়ার্কিং গ্রুপের কোনো সভাই অনুষ্ঠিত হয়নি। শেখ মুজিব আমলে বিষয়টি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশেষ করে কমনওয়েলথ ও ইসলামি সম্মেলন সংস্থায় তোলা হলেও ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশের সরকারগুলো দ্রুত পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে সম্পদ বণ্টন বিষয়ে বিশেষ তৎপর হয়নি।

উল্টো ক্ষতিপূরণ নিয়েছে পাক শিল্পপতিরা-

বাংলাদেশ বরং পাকিস্তানি শিল্পপতিদের পরিত্যক্ত ঘোষিত সম্পত্তির ক্ষতিপূরণ ও কোনো কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান জিয়ার আমলে ফিরিয়ে দেয়। বাংলাদেশ এ সময় ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়ে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। শুধু দেশে নয়, জাতিসংঘ, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথসহ বিভিন্ন সংস্থায় ভারতের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও পাকিস্তানের ব্যাপারে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। আমাদের দেশে গণমাধ্যমও সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে তেমন তৎপরতা দেখায়নি। বুদ্ধিজীবী, ছাত্রসংগঠনসহ কোনো সংগঠনও এ ব্যাপারে সচেতনতা দেখায়নি। যে কারণে বাংলাদেশের কোনো সরকারই এ ব্যাপারে চাপের মুখোমুখি হয়নি। এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে পাকিস্তান বিষয়টিতে দীর্ঘসূত্রতার আশ্রয় নিয়েছে, কখনো পাশ কাটানোর চেষ্টা করেছে, যার সম্মিলিত ফল হচ্ছে দাবিটির অপমৃত্যু।

১৯৭৪ সালে দাবিকৃত অর্থের পরিমাণ ছিল ৪০০০ মিলিয়ন ডলার। তখন ডলারের মূল্যমান ছিল ৮ টাকা, বর্তমানে ১২১ টাকা প্রতি ডলার। সে হিসাবে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের বর্তমানে পাওনা দাঁড়ায় ৪৮৪০০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশী। এই হিসাবটা পাকিস্তানও জানে। ফলে তারা হিসাব নিয়ে বসতে চায় না। কাজেই দ্বিপক্ষীয় পর্যায় এবং জরুরি প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি তুলে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা জরুরি। পাকিস্তানি শিল্পপতিদের পরিত্যক্ত ঘোষিত সম্পত্তির হিসাব এবং পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের পাওনার সমন্বয় করেও এ সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব। তথ্যসূত্র: বাংলাদেশী ইতিহাসবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক আবু মো. দেলোয়ার হোসেন এর ১০ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে প্রতিচিন্তায় প্রকাশিত নিবন্ধ থেকে।

সংশ্লিষ্ট খবর

Back to top button