আন্তর্জাতিকলিড নিউজ

যুক্তরাষ্ট্রের অ’মানবিকতায় হাতে-পায়ে শিকল পড়ে ফিরলো ৩০ বাংলাদেশী

 

এয়ারপোর্টে অভিবাসীদের কল্যাণে কাজ করে এমন কয়েকটি সূত্র দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানিয়েছে, হাত পায়ে শিকল পরিয়ে এসব কর্মীকে আনা হয়। তবে বিমান থেকে নামার আগে তাদের শিকল খুলে ফেলা হয়। এ সময় কাউকে তাদের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি।

 

কূটনৈতিক রিপোর্টার : এবার যুক্তরাষ্ট্রের অ’মানবিকতার কবলে পড়ল ৩০ বাংলাদেশী নাগরিক। এদের হাতে হাতকড়া ও পায়ে শিকল পড়িয়ে বাংলাদেশে আনা হয়। হাতে হাতকড়া ও পায়ে শিকল যাতে কেউ বুঝতে না পারে সেজন্য রাত ২টা পর্যন্ত তাদের বিমানটি রানওয়েতেই রাখা হয়। পরে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশিদের শিকল ও হাতকড়া খুলে তাদের অ্যারাইভাল এরিয়ায় নেওয়া হয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের চরম অমানবিকতা কেউ প্রত্যক্ষ করতে পারে নাই।

গতকাল বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাতে তাদের বহনকারী বিশেষ ভাড়া করা বিমান শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। ঢাকা এয়ারপোর্টের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন রাজিব সামাদ তাদের পৌঁছানোর কথা দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে নিশ্চিত করলেও তবে তাদের হাত-পায়ের শিকল পরানোর বিষয়টি তিনি জানেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘রানওয়ে এবং এয়ারপোর্ট এর ভেতরে সবকিছু ঠিক ছিল। বিমানের ভিতরে কি হয়েছে সেটা আমরা জানি না। এটা আমাদের জুরিজডিকশনে পড়ে না।’

তবে এয়ারপোর্টে অভিবাসীদের কল্যাণে কাজ করে এমন কয়েকটি সূত্র দৈনিক সত্যকথা প্রতিদিন কে জানিয়েছে, হাত পায়ে শিকল পরিয়ে এসব কর্মীকে আনা হয়। তবে বিমান থেকে নামার আগে তাদের শিকল খুলে ফেলা হয়। এ সময় কাউকে তাদের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। কাউকে কোন ধরনের ছবি তুলতে দেওয়া হয়নি। গণফেরত আসাদের মধ্যে ১ জন নারীও আছেন।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাত ১১ টার পরপর বিমানটি নামলেও তিন ঘণ্টা সেটি রানওয়েতে ছিল। এই তিন ঘণ্টায় বিমানের যাত্রীদের হাতকড়া ও শিকল খোলা হয়, বিমানবন্দরের এরাইভ্যাল এড়িয়াতে পৌছানোর আগেই সবাইকে শিকলমুক্ত করে দেওয়া হয়, পরে রাত ২ টার দিকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে তাদের বিমানবন্দরে আনা হয়। এ সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ দল, কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার বিশেষ দল এবং যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘ যাত্রা ও শিকল পরে থাকার কারণে আগতরা ছিলেন বিধ্বস্ত।

বিমানবন্দরের কর্তব্যরত একটি সূত্র নোয়াখালীর ২২ বছর বয়সী আব্দুল্লাহর অবস্থা তুলে ধরেন। আব্দুল্লাহ তাদের কাছে হতাশা প্রকাশ করে বলতে থাকেন, এই লম্বা যাত্রায় পুরোটা সময় হাতে পায়ে দাগী আসামীদের মতো শিকল পরিয়ে রেখেছিলো, একে তো দেশে ফেরত আসার হতাশা তার উপরে সন্ত্রাসীদের মতো হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে মাতৃভূমিতে আসার মত ভয়াবহ পরিস্থিতি আর কারো না হোক।

বিমানবন্দর সূত্র জানিয়েছে, বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের পক্ষ থেকে তাদের বাড়ি পৌঁছানোর জন্য অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়।ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর অভিযান আরও জোরদার করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় একাধিক দফায় বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে। গত কয়েক মাসে অন্তত ১৮০ জন বাংলাদেশিকে ফেরত আসার তথ্য জানা গেছে।

প্রথম দিকে হাতকড়া ও শিকল না পরানো হলেও ২ আগস্ট একটি সামরিক পরিবহন উড়োজাহাজ সি-১৭ তে করে এক নারীসহ ৩৯ বাংলাদেশিকে দেশে পাঠানো হয়। তাদের সবার হাতকড়া ও শিকল ছিলো। গতকালও সবার হাতে হাতকড়া ও শিকল পরানো।

ফেরত আসা ব্যক্তিরা জানান, প্রায় ৬০ ঘণ্টার দীর্ঘ যাত্রায় তাদের হাতকড়া ও শিকলে বেঁধে রাখা হয়েছিল। ফলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যন্ত্রণা নিয়ে বসে থাকতে হয়েছে। খেতে দেওয়া হয়েছে শুধু রুটি আর পানি। এমনকি টয়লেটে যাওয়ার সময়ও একজন অফিসার নিয়ে যেতেন, আবার শিকলে বেঁধে দিতেন।

পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও এইচএসআইএর ইমিগ্রেশন বিভাগের সূত্র বলছে, এর আগে চলতি বছরের ৮ জুন একটি চার্টার্ড ফ্লাইটে ৪২ বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়। এর আগে চলতি বছরের ৬ মার্চ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত একাধিক ফ্লাইটে আরো অন্তত ৩৪ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। ২০২৪ সালের শুরু থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশির সংখ্যা অন্তত ১৮০ ছাড়িয়েছে।

মার্কিন আইন অনুযায়ী বৈধ কাগজপত্র ছাড়া অবস্থানকারী অভিবাসীদের আদালতের রায় বা প্রশাসনিক আদেশে দেশে ফেরত পাঠানো যায়। আশ্রয়ের আবেদন ব্যর্থ হলে অভিবাসন কর্তৃপক্ষ (আইসিই) তাদের প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করে। সাম্প্রতিক সময়ে এ প্রক্রিয়া দ্রুততর করার কারণে চার্টার্ড ও সামরিক ফ্লাইটের ব্যবহার বেড়েছে। বেশির ভাগ অভিবাসী মেক্সিকো বা লাতিন আমেরিকার দেশ বা অন্য কোন পন্থায় ৩০ থেকে ৫০ লাখ টাকা খরচ করে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করেছিলেন।

এর আগে ২০১৬ সালে ২৭ বাংলাদেশিকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে। তারা বিশেষ ফ্লাইটে এসেছিলেন, আর যাত্রাপথে হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছিল। এই দৃশ্য তখন দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এভাবে শিকল পরানোয় মানবাধিকার ও মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন, যা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও মার্কিন প্রশাসনের মধ্যে আলোচনাও হয়েছিল।

অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রত্যাবাসনের সময় হাতকড়া ও শিকল ব্যবহার পরানো উচিত নয়। সাধারণ অভিবাসীদের হাতকড়া বা শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোটা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ডের পরিপন্থী। অভিবাসীদের এভাবে হাতকড়া বা শিকল পরিয়ে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক (মাইগ্রেশন ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্ম) শরিফুল হাসান বলেন, ‘উন্নত জীবনের স্বপ্ন নিয়ে মানুষ অভিবাসী হতে চাইবেন, এটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। একই সঙ্গে গন্তব্য দেশ চাইলে তাদের ফিরিয়েও দিতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাতকড়া পরিয়ে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এটি অভিবাসনপ্রত্যাশী মানুষের জন্য সারা জীবনের ট্রমা হয়ে থাকে। আমরা আশা করি, আগামীতে প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়া আরও মানবিক হবে এবং যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে গুরুত্ব দেবে।’

সংশ্লিষ্ট খবর

Back to top button