কূটনৈতিক রিপোর্টার : একেই বলে বাপেরবেটা হামাস! ২০ মিনিটে ৫ হাজার রকেট ছুঁড়ে ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছে শক্তিধর ইসরায়েলের। শুধুই কি তাই স্থলপথ ও সমুদ্র পথ দিয়ে ইসরায়েলে ঢুকে পড়েছে হামাস। হামাসের রকেট হামলায় ইতিমধ্যে ইসরায়েলের শতাধিক নিহত হয়েছে। হামাস বলেছে পবিত্র আল আকসা মসজিদ ইহুদি মুক্ত করতেই এই হামলা চালানো হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের এমন মুহুর্মুহু হামলার পরিপ্রেক্ষিতে দেশে যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘোষণা করেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী।
বিশ্বের কথিত বাঘা গোয়েন্দা মোসাদ’রা কেন হামাসের হামলার খবর আঁচ করতে পারল না তা নিয়ে সারা বিশ্বও যেন অবাক। বলা হচ্ছে ‘এটা কীভাবে ঘটল, আমরা ভাবতেও পারছি না’—এত খ্যাতি, নিরাপত্তা ও নজরদারি সরঞ্জাম থাকার পরও ইসরায়েল কেন হামাসের হামলার বিষয়ে আগাম আঁচ করতে পারল না, সেই প্রশ্নে এভাবেই প্রতিক্রিয়া জানালেন ইসরায়েলের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। বললেন, এ নিয়ে আগাম তথ্য পাননি তাঁরা।
শনিবার স্থানীয় সময় ভোর সাড়ে ছয়টায় সীমান্ত পার হয়ে ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েন হামাস যোদ্ধারা। কিন্তু এমন হামলা হতে পারে, তার বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না ইসরায়েলি বাহিনীর। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, শিন বেত ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর গোয়েন্দাদের কেউই জানত না, হামাস এ ধরনের একটি হামলা করতে যাচ্ছে। ইসরায়েলিদের কাছে এটা খুবই অবাক করার মতো বিষয়। আবার হতে পারে, গোয়েন্দাদের কেউ কেউ হামলার বিষয়ে আগাম তথ্য পেলেও সেই অনুযায়ী দ্রুত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই হামলার জন্য দীর্ঘদিন ধরে পরিকল্পনা করতে হয়েছে হামাসকে। ইসরায়েলের গোয়েন্দা তৎপরতা সম্পর্কে অন্য অনেকের চেয়ে ভালো জানে ফিলিস্তিনি এই সংগঠন। ফলে এই হামলার বিষয়টি যাতে ফাঁস না হয়, সে জন্য নানাভাবে ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের ফাঁকি দিতে হয়েছে এবং তাদের দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করতে হয়েছে।
ইসরায়েলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হামাসের এই হামলা নিয়ে গোয়েন্দা ব্যর্থতার বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বড় ধরনের একটি তদন্ত শুরু হয়েছে। তবে এ তদন্ত শেষ করতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে।খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস অনেকটা আকস্মিকভাবেই ইসরায়েলে হামলা চালিয়েছে। আজ শনিবার সকালের এই হামলা ইসরায়েলিদের পাশাপাশি অনেককে বিস্মিত করেছে। সাধারণত ইসরায়েলি হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা হামলা চালিয়ে আসছিল হামাস। এবার হামাস কেন আগে হামলা চালাল, তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত হামাসের হামলায় নিহত ইসরায়েলির সংখ্যা ১০০-এ দাঁড়িয়েছে। আর ইসরায়েলি হামলায় ১৯৮ ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফায় একের পর এক হতাহত ব্যক্তিকে আনা হচ্ছে। লোকজনকে রক্তদানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, আজ শনিবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ছয়টায় ইসরায়েলে হামাসের হামলা শুরু হয়। জবাবে গাজায় হামাসের বিভিন্ন অবস্থানে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। একই সঙ্গে ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে ঢুকে পড়া হামাস যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়াই চলছে।
হামাসের মুখপাত্র খালেদ কাদোমি আল-জাজিরাকে বলেছেন, দশকের পর দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো নৃশংসতার জবাবে এই সামরিক অভিযান চালানো হয়েছে।খালেদ বলেন, ‘আমরা চাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজায়, ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর এবং আমাদের পবিত্র স্থাপনা আল-আকসায় ইসরায়েলি নৃশংসতা বন্ধে উদ্যোগ নেবে।
এগুলোই হামাসের এই অভিযানের কারণ।এর আগে হামাসের সামরিক কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ বলেন, ‘দুনিয়ার বুকে সর্বশেষ দখলদারত্বের অবসানে সবচেয়ে বড় যুদ্ধের দিন আজ।’ তিনি বলেন, ‘যাঁর কাছেই একটি বন্দুক রয়েছে, তাঁর উচিত সেটা নিয়ে বের হওয়া। সময় এসে গেছে।’
ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে দেওয়া এক পোস্টে পশ্চিম তীরের প্রতিরোধযোদ্ধাদের পাশাপাশি আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে এই যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। গাজায় হামাস সরকারের সাবেক উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী গাজি হামাদ আল-জাজিরাকে বলেন, যেসব আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে, এই অভিযান তাদের জন্যও একধরনের বার্তা।
গাজি হামাদ বলেন, ‘আমি মনে করি, এটা তাদের জন্য লজ্জার। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে আরব দেশগুলোর প্রতি আমি আহ্বান জানাই। কারণ, ইসরায়েল শান্তি ও সহ-অবস্থানে বিশ্বাস করে, এমন কোনো দেশ নয়। এটা শত্রুরাষ্ট্র; তাদের প্রতিহত করতে হবে।’
সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মুসলিমদের পবিত্র স্থাপনা আল-আকসা মসজিদ চত্বরে ইহুদিদের অনুপ্রবেশের ঘটনা বেড়েছে। ফিলিস্তিনিরা এ ধরনের অনুপ্রবেশের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। এ নিয়ে আল-আকসায় মুসল্লিদের ওপর বেশ কয়েকবার হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী।
হামাসের পক্ষ থেকে আল-আকসার ‘স্থিতাবস্থায়’ কোনো ধরনের পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টাকে ‘চূড়ান্ত সীমা’ হিসেবে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। এরপরও সেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর পাহারায় ইহুদিদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত ছিল।হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়া বলেছেন, ‘আল-আকসার মর্যাদা রক্ষায় আমরা এই যুদ্ধ শুরু করেছি।’
এদিকে পরিস্থিতি পর্যালোচনায় জরুরি বৈঠক ডেকেছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। তিনি বলেছেন, ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের সন্ত্রাস এবং দখলদার সেনাদের থেকে আত্মরক্ষার অধিকার ফিলিস্তিনিদের আছে। ফিলিস্তিনি জনগণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছেন আব্বাস।