সমঝোতা সংলাপ চাই-জাতীয় সংলাপে রাজনীতিকরা
বিশেষ প্রতিনিধি : জাতীয় নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট সংকট সমাধানে সংলাপের বিকল্প নেই। নিজেদের সমস্যা নিজেদেরই সমাধান করতে হবে। সংলাপ হলে পারস্পরিক আস্থা রাখতে হবে, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা রাখতে হবে। সেখানে সুনির্দিষ্ট কিছু এজেন্ডা নির্ধারণ করতে হবে, যাতে আমরা ভবিষ্যতে সংকট এড়াতে পারি। আলোচনার টেবিলে বসেই সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার।
সোমবার রাজধানীর তোপখানা রোডে সিরডাপ মিলনায়াতনে আয়োজিত এক জাতীয় সংলাপে দেশের বিশিষ্টজনরা এ কথা বলেন। দি হাঙ্গার প্রজেক্টের উদ্যোগে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন’র সহযোগিতায় এ সংলাপ হয়। এতে সারা দেশে অনুষ্ঠিত আটটি বিভাগীয় কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে পাওয়া মতামত ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
সংলাপে অতিথি ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. রওনক জাহান, সুজন’র নির্বাহী সদস্য বিচারপতি এমএ মতিন, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, সুজন’র নির্বাহী সদস্য ড. রোবায়েত ফেরদৌস, বিশিষ্ট ব্যাংকার নুরুল আমিন প্রমুখ।
রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক, বিএনপি’র সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট হারুন অর রশিদ, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, সিপিবি’র সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদের সহসাধারণ সম্পাদক রাজেকুজ্জামান রতন, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর প্রমুখ।
সংলাপে সঞ্চালনা করেন দি হাঙ্গার প্রজেক্ট’র গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং কান্ট্রি ডিরেক্টর ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার।
স্বাগত বক্তব্যে ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘স্বাধীনতার পর ৫২ বছর পেরিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যেও আমরা আমাদের গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনি ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে পারিনি। আমরা আশা করি, আমাদের রাজনীতিবিদরা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।’
ড. রওনক জাহান বলেন, ‘বড় দুটো দলের মধ্যে যে সংলাপ হতে হবে সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু সংলাপের ব্যাপারে ঐকমত্য নেই। বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য রাজনৈতিক ও আইনি সংস্কার দরকার। কিন্তু শুধু আইনি সংস্কার করেই সমস্যার সমাধান হবে না।
একই সঙ্গে দরকার রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক উন্নয়ন। নির্বাচনে পরাজিত দলের নেতাকর্মীদের জীবন-জীবিকা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য থাকা দরকার।’
নাহিম রাজ্জাক বলেন, ‘বিভিন্ন পক্ষ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি তোলা হলেও কোন প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে তা কেউ বলতে পারছে না। এর দায় শুধু সরকারি দল ও ক্ষমতাসীন জোটের ওপর চাপিয়ে দিলে হবে না। নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে একটি ঐকমত্য তৈরি হওয়া দরকার। কিন্তু নৈরাজ্য সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা হওয়া দরকার।’
হারুন অর রশিদ বলেন, ‘রাজনৈতিক সমঝোতার লক্ষ্যে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। যারা সংলাপে বসতে রাজি নন, তারা মূলত সংকট এড়িয়ে যেতে চান। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক সংকটের একটি স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার। এজন্য কতগুলো রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংস্কার দরকার।’
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত সংলাপে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আমার ওপর আস্থা রাখুন, নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেননি। আমি মনে করি, এখন আর সংলাপের পরিবেশ নেই। তাছাড়া সংলাপের লক্ষণও নেই। মানুষের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি বিরাজ করছে। সরকারি দল আস্থা ও বিশ্বাসের পরিবেশ নষ্ট করছে।’
রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থা নির্বাসনে চলে গেছে। গণতন্ত্র ও নির্বাচনি ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও কার্যকর করার জন্য এ ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার নেই। নির্বাচনে টাকার খেলা বন্ধ করতে হবে, আনুপাতিক নির্বাচনি পদ্ধতি চালু করতে হবে। এজন্য জনগণের শক্তির ওপর নির্ভর করতে হবে এবং মুক্তিযুদ্ধের ধারার আলোকেই রাজনীতি করতে হবে।’
রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, ‘অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, নির্দলীয় সরকার ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সহায়ক নির্বাচনকালীন সরকার ছাড়া নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে পরিশুদ্ধ করার জন্য সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনি পদ্ধতি চালু করা দরকার।’
বিচারপতি এমএ মতিন বলেন, ‘নব্বইয়ে প্রণীত তিন জোটের রূপরেখায় বলা হয়েছিল, আমরা ভবিষ্যতের সমস্যা সমাধানে আলাপ-আলোচনা করেই সমাধান করব। কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা সেই প্রতিশ্র“তির কথা ভুলে গেছেন। এ অবস্থায় রাজনীতি নিয়ে মানুষের মধ্যে অনীহা তৈরি হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই।’
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও সদিচ্ছা থাকা দরকার। আর বৃহত্তর সমঝোতার লক্ষ্যে সংলাপের বিকল্প নেই। খোলামন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে এটি করতে হবে।’
ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘২০১৪ সালে যে সংকট তৈরি হয়, তার শুরু হয়েছে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী পাশের মাধ্যমে। সংবিধান থাকলেও সাংবিধানিকতা নেই, প্রাতিষ্ঠানিকতা নেই।’
অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ৫টি ভিন্ন নির্বাচনি প্রক্রিয়া এবং সংঘাতের আশঙ্কা শোনা যাচ্ছে। আমরা মনে করি, শত্রুর সঙ্গেও সংলাপ হতে পারে। আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়েছে। তাই যে কোনো উপায়ে একটি নির্বাচন করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না।’
জোনায়েদ সাকী বলেন, ‘বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ চাইলেও সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে পারবে না। কারণ এখানে আরও অনেক স্টেকহোল্ডারের স্বার্থ রয়েছে।’