বিএনপির মদদে ভুল তথ্য ইইউতে
ইইউ পার্লামেন্টে বললেন জার্মান এমপি ০ অধিকার হেফাজত নিয়ে ভুল তথ্য দিয়েছিল
কূটনৈতিক রিপোর্টার : বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি ইউরোপীয় পার্লামেন্টে উত্থাপিত একটি রেজুলেশনের তুমুল নিন্দা করা হয়েছে খোদ ইউরোপীয় পার্লামেন্টেই।ইইউ টুডের সাথে কথা বলার সময় জার্মান ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য (এমইপি) ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ বলেন, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কিছু এনজিও ইচ্ছাকৃতভাবে এসব ভুল তথ্য সরবরাহ করেছে।এক্ষেত্রে অধিকার বিএনপির পক্ষ নিয়ে মদদ দিয়েছে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টে উথাপন হওয়া ওই রেজুলেশন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি এর বিপক্ষে ছিলাম, কারণ সাধারণভাবে আমি এই রেজুলেশনগুলির বিরুদ্ধে সত্যিই সন্দিহান। কারণ বর্তমানে এনজিও বাবল থেকে তারা খুব বেশি আসে।’
ক্রাহ বলেন, ‘তারা সাধারণত এ কেসগুলির বিষয়ে যত্ন নেয়। সেগুলি দু’বার চেক করা হয় না। কিন্তু আমি অন্তত সেগুলি দুবার চেক করার চেষ্টা করি। তাই, আমি দূতাবাসগুলিকে তাদের যুক্তি দেওয়ার সুযোগ দিই এবং আমি এটি সব দিক থেকে গুগল করি। সাধারণত আমি মনে করি না যে এই মামলাগুলি বিশ্বাসযোগ্য।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই। মামলাটি বিশ্বাসযোগ্য ছিল না কারণ একজন এনজিও কর্মী পুলিশি সহিংসতার বিষয়ে একটি ভুল বিবৃতি দিয়েছিলেন এবং এটি একটি সত্যিকারের দাঙ্গার কারণ হওয়ার ঝুঁকি ছিল এবং এই ধরনের ‘ভুল তথ্য’ ইউরোপেও শাস্তিযোগ্য। সুতরাং, আমরা ইউরোপে যে আচরণের বিচার করব, সেই আচরণের জন্য আমরা বাংলাদেশিদেরও দোষারোপ করি এবং এটি মোটেও বিশ্বাসযোগ্য নয়।’
ক্রাহ বলেন, কিছু ভুয়া এনজিও, যা প্রায়শই মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশ করে, এরপর সন্দেহজনক নানা প্রক্রিয়ায় আইন প্রণয়ণ প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করতে চায়। তিনি বলেন, তারা কখনও কখনও, সাম্প্রতিক ‘কাতারগেট কেলেঙ্কারির’ মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত, কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিদেশীদের দ্বারা কমিশন করা হয় যারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বৈদেশিক নীতিকে প্রভাবিত করতে চাইছে- এটি এমন একটি ঘটনা যা ইইউ প্রতিষ্ঠানগুলি বর্তমানে সমাধান করতে চাইছে।
কীভাবে বিষয়টি মোকাবেলা করতে হবে- সে সম্পর্কে তার নিজস্ব সুপারিশের জন্য জিজ্ঞাসা করা হলে, ক্রাহ বলেন, ‘অবশ্যই প্রথম যখন ভুল তথ্য আসে তখন আরও সক্রিয়ভাবে কাজ করা, তবে সাধারণভাবে আপনাকে এই এনজিও শক্তির পুরো কাঠামোর উপর ফোকাস করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘একটি বিশাল মানবাধিকার শিল্প রয়েছে- যা সারা বিশ্বে পশ্চিমা পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থকে উন্নীত করার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। এর মানে হল যে আপনাকে সচেতন হতে হবে যে মানবাধিকার ইস্যুগুলি আবেগিক ইস্যু এবং এর জন্য নিবেদিত এনজিও রয়েছে। তবে আপনাকে এটিও সচেতন থাকতে হবে যে এটি এখন সারা বিশ্বে পশ্চিমের পররাষ্ট্রনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার।’তিনি বলেন, আমাদের অবশ্যই এই আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় এনজিও কাঠামোগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কারণ তা না করলে আমরা যদি আমাদের দেশীয় রাজনীতিতে বিদেশী প্রভাবকে ডেকে নিয়ে আসবো।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের রেজ্যুলেশন বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা বাণিজ্য সম্পর্ককে পরবর্তী উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, আমি মনে করি, এই রেজ্যুলেশনের এখানেই সমাপ্তি, যার কোনো আইন প্রণয়ন ক্ষমতা নেই এবং এটি এমন কোনো হুমকি হবে না যা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো না।’
এছাড়াও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন অক্সফোর্ড ম্যাট্রিক্সের আইনি পরামর্শদাতা ড. রায়হান রশিদ (ডিফিল, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়)। ডা. রশিদও এ রেজুলেশনকে সমানভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং তিনি এটিকে ‘বড় ধরনের ভুল তথ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।রশিদ বলেন, অবশ্যই, সংসদ সদস্যরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি গল্প শোনার পরে যেমন প্রতিক্রিয়া দেখানোর তেমনটাই দেখিয়েছেন। আমি পুরোপুরি বুঝতে পারি যে, তারা সংবেদনশীল ছিলেন, কিন্তু পুরো পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের সম্পূর্ণরূপে জানানো হয়নি। এ ঘটনা কীভাবে ঘটলো জানতে চাইলে ডা. রশিদ আমাদের বলেন, এই পুরো ঘটনাটি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এটি শুরু হয়েছে ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
তিনি আরও বলেন, দেশটি তালেবানবাদী জঙ্গি বিদ্রোহের দ্বারপ্রান্তে ছিলো এবং হেফাজত তাদের দল ছিলো। যার অর্থ তারা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। তাই এর বিরুদ্ধে ক্র্যাকডাউন হলেও তা ছিলো উন্মুক্ত এবং বিবিসিসহ কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাংবাদিকের উপস্থিতিতেই তা করা হয়েছিল। মিডিয়ার উপস্থিতিতে এই ধরনের ইসলামি জঙ্গিদের শুধুমাত্র ছত্রভঙ্গ করতেই এই ক্র্যাকডাউন চালিয়েছিল পুলিশ।
‘ওই ঘটনার পরের দিন অধিকার (একটি বাংলাদেশভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা) একটি গল্প নিয়ে আসে যে, ৬৩ জন এর শিকার হয়েছেন। হেফাজত (মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের একটি অতি-ডানপন্থী ইসলামিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ) ২০ হাজার লোকের মতো বড় সংখ্যা নিয়ে সামনে এসেছিল। হেফাজতের দাবির ওপর ভিত্তি করে অধিকার বলেছিল যে ক্র্যাকডাউনের কারণে ৬৩ জন নিখোঁজ হয়েছে।’
ব্যক্তিগতভাবে আমি একজন মানবাধিকার কর্মী উল্লেখ করে রশিদ বলেন, সবাই উদ্বিগ্ন ছিলো এবং এ ব্যাপারে প্রশ্ন করছিল। কয়েকদিন পরে আমরা দেখতে পেলাম যারা নিখোঁজ হয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে তারা সকলেই ঠিকঠাক আছেন। সুতরাং, আমি এটি বুঝতে পারি। গণমাধ্যম বা মানবাধিকার সংস্থাগুলির তথ্যে গরমিল রয়েছে, কিন্তু তারা এ দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করেনি।
অধিকার বাংলাদেশ সরকারের কাছে কোনো বিশেষ দাবি করেছে কি না? জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, যখন তারা এই মিথ্যা তথ্যটি নিয়ে এসেছিল, তারা তদন্তের দাবি করেছিল। একটি দেশে, এমনকি একটি তালেবানী অভ্যুত্থান বা অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টা করলেও, ৬৩ জন লোক নিখোঁজ হওয়া গ্রহণযোগ্য নয়।
তিনি বলেন, আমিসহ সবাই এ ঘটনার তদন্ত চেয়েছি। কিন্তু পরে এর আসল রহস্য উন্মোচিত হয়। অধিকারের সমস্যা হচ্ছে তারা তাদের তথ্য সংশোধন করেনি বরং তারা আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবং অন্যান্য বন্ধুত্বপূর্ণ মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মধ্যে এই গল্পের পুনরাবৃত্তি করেছিল। আন্তর্জাতিক এই সংস্থাগুলোর বাংলাদেশে কোনো কার্যালয়ও নেই। দেশে তাদের সক্রিয় কোনো অনুসন্ধানী ব্যবস্থাও নেই, তাই তারা অধিকারের সংস্করণের ওপর নির্ভর করছে। আর এভাবেই অধিকারের গল্পটিই বারবার পুনর্ব্যবহৃত হয়েছে।
অধিকার তালেবানের সাথে যুক্ত কিনা বা এ সংক্রান্ত কোনো প্রমাণ আছে কিনা জানতে চাইলে, ড. রশিদ বলেন, না, অধিকারের জন্য আমি এটা বলবো না। আমার মনে হয় অধিকারের সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খানের জন্যই এর গুরুত্ব বেশি ছিলো। তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী হলেও বিএনপি শাসনামলে তিনি একজন অ্যাটর্নি জেনারেলও ছিলেন। আমি জানি না তার মনে বা তার সংগঠনের মধ্যে কী চলছে বা তাদের কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিলো কিনা।
অধিকার এবং হেফাজতের মধ্যে কোনো সংযোগ আছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে ড. রশিদ বলেন, ২০১৩ সালে, এই ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটির (হেফাজত) মাদ্রাসা থেকে আসা ছাত্রদের বিশাল সমর্থনের ভিত্তি ছিলো এবং তারা আসলে একটি ইসলামিক স্টেট বা বলা যায় একটি তালেবান ধাঁচের ইসলামিক রাষ্ট্রের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল। আর তাদের দাবিগুলো ছিলো হুবহু তালেবানের আদেশের মতোই। নারী সম্পর্কে, শিক্ষা সম্পর্কে, সবকিছু সম্পর্কে। তারা ছিলো তালেবানদের একটি কার্বন-কপি।
তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যবশত, অন্যান্য ইসলামিক বড় বড় স্কলারদের কাছ থেকেও তারা সমর্থন পেয়েছিল। যারা রাস্তায় নেমেছিল এবং মূলত দেশটি তখন একরকম বন্ধের পথেই ছিল। এ সময় সরকার গণমাধ্যমের উপস্থিতিতে এসব গ্রুপকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু ছত্রভঙ্গ হওয়ার পর হঠাৎ করেই তারা ২০ হাজার লোক নিখোঁজ হওয়ার কথা রটিয়ে দেয়। পরবর্তীতে ২০ হাজার নয়, ৬৩ জন দাবি করা হয়। এর ভিত্তিতেই ৬৩ জন নিখোঁজ হয়েছে বলে দাবি করে অধিকার।
অধিকার একটি মানবাধিকার সংস্থা যার নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) শাসনামলে থাকা একজন অ্যাটর্নি জেনারেল। তাই সম্ভবত একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এখানে থাকতে পারে বলে মনে করেন ড. রশিদ।তিনি বলেন, কিন্তু আমি তার মনে ঢুকতে পারি না। তারা যখন প্রথম এ দাবি নিয়ে আসে তখন আমি সত্যিই এটিকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। এবং আমি ভেবেছিলাম যে, যদি এটি বাস্তব হয় তবে এটির সমাধান করা উচিত। কিন্তু আমি হতাশ হয়েছিলাম যে ৬৩ জন নিখোঁজ ব্যক্তিদের সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে।
ভবিষ্যতে এই ধরনের বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা প্রতিরোধে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কী করা উচিত? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. রশিদ বলেন, ইউরোপীয় পার্লামেন্টের উচিত তাদের নিজস্ব হোমওয়ার্ক করা। প্রতিটি সংসদ সদস্যেরই তাদের সহযোগী ও গবেষকদের একটি পুরো দল থাকে। আমি মনে করি তারা অন্য কারও চেয়ে অনেক বেশি সজ্জিত। তারা আসলে ক্রসচেক করতে পারেন। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন উৎস থেকে, আলাদাভাবে তথ্য নিয়ে এ সিদ্ধান্তে নেয়া উচিত। কারণ এই ভুল তথ্যের ব্যবহার মানবাধিকারের জন্য সহায়ক নয়।