স্টাফ রিপোর্টার : রাজধানীতে পুলিশের চাকরির আড়ালে বীরদর্পে ডাকাতি ছিনতাই করে বেড়াচ্ছিল এএসআই দেলোয়ারের দল । গড়ে তুলেছিল বিরাট এক অপরাধী সিন্ডিকেট। অপরাধ মিশনে নেমে ঘটনাস্থল রেকি করত পুলিশের সোর্স দিয়ে; অতঃপর অপারেশন সাকসেস করে পুলিশের পোশাক পড়ে থানায় যেত। রাজধানীতে এ অপকর্মের সর্দার পুলিশের বিষফোঁড়া এএসআই দেলোয়ার এখন পুলিশের খাঁচায় বন্দী। অপরাধের টাকায় একবার চাকরী খুইয়েও ফের পুলিশে যোগ দিতে সক্ষম হয় এএসআই দেলোয়ার।
ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত সে রাজধানীর গুলশান থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই)। এর আগে চাকরিরত অবস্থাতেই ২০১৫ সালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মাদকের কারবারে জড়িয়ে গ্রেপ্তারও হয়েছিল। সেবার হয়েছিলেন চাকরিচ্যুত। তবে শেষ পর্যন্ত সব ‘বাধা জয়’ করে ঠিকই ফেরত পেয়ে যান চাকরি। পোস্টিং হয় গুলশানের মতো গুরুত্বপূর্ণ থানায়।তারপরও অপরাধ থেকে বিরত থাকেনি দেলোয়ার।
তদন্ত সূত্র জানায়, এএসআই দেলোয়ারের অপরাধী চক্রে আবু সায়েম নামে পুলিশের আরেক সদস্য যুক্ত। আছেন ছিনতাই কাজে ব্যবহার করা মাইক্রোবাসের চালকও। ব্যাংকে টাকা জমা বা উত্তোলনকারীদের টার্গেট করার জন্য আছে বিশ্বস্ত সোর্স। এরপর অভিযানের নামে পুলিশ পরিচয়ে মাইক্রোবাসে তুলে হাতিয়ে নেয় সর্বস্ব। সর্বশেষ গত রোববার রাজধানীর শ্যামপুরে এক ব্যবসায়ীর ৫৪ লাখ টাকা ছিনতাই করে মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগের কাছে ফের গ্রেপ্তার হন এই পুলিশ কর্মকর্তা। তার সঙ্গে গ্রেপ্তার হওয়া কনস্টেবল আবু সায়েমের বিরুদ্ধে পল্টন থানায় অবৈধ অস্ত্র আইনের মামলা রয়েছে। ২০১৩ সালে সেটি করা হয়। সাসপেন্ড হয়ে তিনি রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ব্যারাকে ছিলেন।
গত ৮ অক্টোবর সকাল ৯টার দিকে শ্যামপুরের ব্যবসায়ী আবুল কালাম ৫৪ লাখ টাকা নিয়ে তার নাতি তানভীর হোসেন নয়নকে মতিঝিলে একটি ব্যাংকে পাঠান। শ্যামপুরের পশ্চিম দোলাইরপাড়ের বাসা থেকে টাকাভর্তি স্কুলব্যাগ নিয়ে হেঁটে দোলাইরপাড় ইউনিক হাসপাতালের
সামনে যেতেই পুলিশ পরিচয়ে নয়নের গতিরোধ করেন অভিযুক্ত দেলোয়ার ও সায়েম। এরপর জোর করে তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যান। মাওয়া রোড হয়ে কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর রসুলপুর এলাকার ফাঁকা সড়কে গিয়ে টাকার ব্যাগ রেখে নয়নকে নামিয়ে দেন। ওই ঘটনায় শ্যামপুর থানায় অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা হলে ডিবির ওয়ারী বিভাগ ছায়াতদন্ত শুরু করে। পরে এএসআই দেলোয়ার, কনস্টেবল আবু সায়েম, মোশারফ হোসেন এবং আ. বাতেন নামে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই ঘটনায় সোর্স মোশারফ ও চালক বাতেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিলে ওই এএসআই’র সব অপকর্ম ফাঁস হয়ে যায়।
শ্যামপুরে অর্ধকোটি টাকা ছিনতাইয়ে পুলিশের সম্পৃক্ততার বিষয়ে গতকাল বুধবার সাংবাদিকদের সঙ্গে নিজ কার্যালয়ে কথা বলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি জানান, পরিচয় বিবেচ্য নয়। অপরাধ করলে তাকে অপরাধী হিসেবেই দেখি। তাকে কোনো ছাড় দেওয়া হয় না। আগেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য কিংবা এই পরিচয় দিয়ে ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তার করেছি।পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান হারুন আরও বলেন, গ্রেপ্তারদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তাদের তথ্যের ভিত্তিতে পরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি জানান, তদন্তে নেমে জানতে পারি ঘটনার সঙ্গে পাঁচজন জড়িত। এখন পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মামলা ছিনতাইয়ের হলেও তদন্তে নেমে দেখা যায়, এটি ডাকাতির ঘটনা। গ্রেপ্তারদের থেকে ৪১ লাখ ৫৭ হাজার টাকা, ব্যবহৃত গাড়ি ও হ্যান্ডকাফ উদ্ধার করা হয়েছে। পলাতককে গ্রেপ্তার করতে পারলে বাকি টাকা উদ্ধার হবে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রথমেই নগদ টাকা বহনকারীদের টার্গেট করে দেলোয়ারের চক্র। এরপর দামি হায়েস মাইক্রো ভাড়া করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ এড়াতে গাড়ির সামনে পুলিশ লেখা স্টিকার লাগায়। দেলোয়ার নিজের কাছেই রাখেন হ্যান্ডকাফ। সঙ্গে ওয়াকিটকি সেট থাকায় সন্দেহও করেন না কেইউ। এভাবেই টার্গেট ব্যাক্তিকে গাড়িতে তুলে হাত-পা, মুখ ও চোখ বেঁধে ফেলা হয়। পরে টাকা রেখে সুযোগ বুঝে ভিকটিমকে নির্জন স্থানে ছেড়ে দেওয়া হয়।
শ্যামপুরে ৫৪ লাখ টাকা ছিনতাইয়ে গ্রেপ্তার দেলোয়ার চক্রের দুই সদস্য মোশারফ ও বাতেন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্র ও তদন্তকারী সূত্র জানায়, জিজ্ঞাসাবাদ ও জবানবন্দিতে সোর্স মোশারফ জানায়, ছিনতাই হওয়া টাকার মালিক আবুল কালাম তার আপন ছোট ভাই। এএসআই দেলোয়ার এক সময় তাদের এলাকায় ভাড়া থাকতেন। সেই থেকেই পুলিশের ওই কর্মকর্তার সঙ্গে তার সখ্য। ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো না হওয়ায় দেলোয়ার দারোগাকে দিয়ে শায়েস্তা করতে চেয়েছিলেন মোশারফ। জানতেন মাঝেমধ্যেই বড় অঙ্কের টাকা নিয়ে ব্যাংকে যায় নয়ন। ওই লুটের পরিকল্পনা করেন দুজন। ঘটনার দিন দেলোয়ারকে জানিয়েছিলেন সব। এরপর মাইক্রোবাসে করে দলবল নিয়ে ঘটনাস্থলে আসে ওই এএসআই। সঙ্গে ছিল কনস্টেবল সায়েম, গাড়িচালক বাতেন ও হানিফ।
মোশারফ বলেন, নয়নের ব্যাগে কত টাকা ছিল, তা জানতেন না। তবে ছিনতাইয়ের পর তাকে ১২ লাখ টাকা দেওয়া হয়।মাইক্রোবাস চালক বাতেন জবানবন্দিতে বলেন, হানিফের মাধ্যমে পুলিশ কর্মকর্তা দেলোয়ার তার গাড়িটি ভাড়া করেছিল। তাকে আসামি ধরতে যাওয়ার কথা বলা হয়। এরপর দোলাইরপাড় এলাকা থেকে এক ব্যক্তিকে তুলে নেয়। ওই রাতে তাকে গুলশানের কালাচাঁদপুরে ডেকে নিয়ে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছিল এএসআই দেলোয়ার।ডিবির ওয়ারী বিভাগের তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, তারা পলাতক হানিফকে গ্রেপ্তারে চেষ্টা করছেন। তাকে পাওয়া গেলে চক্রের বিষয়ে আরও তথ্য পাওয়া যাবে।