পণ্য খালাস লাইসেন্সে দুর্নীতি
প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চায় শিপ হ্যান্ডলিং অ্যাসোসিয়েশনের-
লাবণ্য চৌধুরী : দরকার নেই তবুও দরপত্র ছাড়াই চট্টগ্রাম বন্দরের বর্হিনোঙ্গরে পণ্য খালাসের লাইসেন্স পেল ২৩ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে মন্ত্রীর স্ত্রী, এমপিসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতেই ২০ লাইসেন্স। ফলে রাজনৈতিক বিবেচনায় পাওয়া এসব লাইসেন্স বাতিল এবং দরপত্রের মাধ্যমে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন জানিয়েছে শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন। তবে বন্দর কর্তৃপকক্ষের দাবি, নিয়ম মেনে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর নিয়োগ করা হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে কার্গো জাহজে আমদানীকৃত পণ্যের ৭০ ভাগ বর্হিনোঙ্গরে বড় জাহাজ থেকে ছোট লাইটার জাহাজে খালাস করে ৩২টি শিপ হ্যান্ডলিং প্রতিষ্ঠান। ৫ বছর পর পর দরপত্রের মাধ্যমে নতুন প্রতিষ্ঠান সংযুক্ত করার কথা থাকলেও ২০১৫ সালের পর নতুন কোন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়নি।
করোনাকালীন সময়ে বিশেষ অনুমতি নিয়ে কাজ করছে আগের প্রতিষ্ঠানগুলো। ৮বছর পর অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে এক সাথে ২৩ প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের মতো জটিল ও বিশেষ কাজের ন্যূনতম অভিজ্ঞতাও নেই।
বর্হিনোঙ্গরে বছরে খালাস হয় ৫কোটি টন পণ্য। বিদ্যমান ৩২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রভাব খাটিয়ে ৫টি প্রতিষ্ঠানই খালাস করে ৩ কোটি টন পণ্য। বাকি ২ কোটি টন পণ্য খালাস করে ২৭ প্রতিষ্ঠান। যেসব প্রতিষ্ঠান কর্মরত তারাই এখন কাজ কম পায়।
বিশেষ করে দেশের বড় পাঁচটি প্রতিষ্ঠান-মেঘনা গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, সেভেন সার্কেল সিমেন্ট-নিজেরাই নিজেদের পণ্য মাদার ভেসেল থেকে হ্যান্ডলিং করছে।
বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং এন্ড বার্থ অপারেটরস এসোসিয়েশনের পরিচালক জসিম উদ্দিন ভুইয়া বলেন, লাইসেন্স প্রথা চট্টগ্রাম বন্দরে বিদ্যমান নেই। দরপত্র ছাড়া নতুন প্রতিষ্ঠান নিয়োগ অবৈধ। স্বচ্ছ দরপত্রের মাধ্যমে শিপ হ্যান্ডলিং প্রতিষ্ঠান নিয়োগের দাবি তাদের। রাজনৈতিক বিবেচনায় পাওয়া এসব লাইসেন্স বাতিল এবং দরপত্রের মাধ্যমে শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন করেছে শিপ হ্যান্ডলিং অ্যান্ড বার্থ অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন।
বন্দরের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. শাহজাহানের শেষ সময়ে ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। যদিও বহু বছর ধরে চলে আসা লাইসেন্স প্রথা ২০০৭ সালে বাতিল করা হয়। এরপর শিপ হ্যান্ডলিং এবং বার্থ অপারেটিং প্রথা চালু করা হয়। অর্থাৎ টেন্ডারের মাধ্যমে হ্যান্ডলিং ঠিকাদার নিয়োগ শুরু হয়। কিন্তু কোনো আবেদন আহ্বান না করে এবং কঠোর গোপনীয়তায় একযোগে ২৩টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স দেওয়া হয়।
নতুন লাইসেন্স দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে-চট্টগ্রামের শালুটিকার অ্যাসোসিয়েটস, বিসমিল্লাহ মেরিন সার্ভিসেস, এনএমটি-এমএসএন লিমিটেড, জিডি হারবার সার্ভিসেস, লামিসা এন্টারপ্রাইজ, পোর্টহারবার ইন্টারন্যাশনাল, আহমেদ মেরিটাইম লজিস্টিকস, শাহী শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং, মা ট্রেডিং, এস ট্রেডিং, মেসার্স তাইফুল এন্টারপ্রাইজ, কিউএনএস গ্লোবাল লজিস্টিকস লিমিটেড, এমএস ওশান কন্ট্রাক্টিং অ্যান্ড সাপ্লাইয়িং ফার্ম, গফুর ব্রাদার্স অ্যান্ড কোং, এসএস কনসাল্টিং লিমিটেড, এবি করপোরেশন, ঢাকার আরিয়ান ট্রেডার্স লিমিটেড, ব্রিজেক্স ইনফ্রাক্সার লিমিটেড, গুড এলায়েন্স সার্ভিসেস লিমিটেড, আর কে করপোরেশন, কেয়ার শিপিং অ্যান্ড ফ্রেইট লিমিটেড, যশোরের কেএএস ট্রেডি, খুলনার খুলনা ইউনিয়ন এন্টারপ্রাইজ লিমিটেড।
লাইসেন্স পাওয়া আরিয়ান ট্রেডার্সের মালিক বরিশালের সাবেক এক মেয়রের পরিবারের সদস্য। খুলনা ইউনিয়ন এন্টারপ্রাইজের মালিক বরিশালের সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত। ব্রিজেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লাইসেন্সের মালিক এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়।
আহমেদ মেরিটাইম লজিস্টিকসের মালিক সরকারের গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিমন্ত্রীর এপিএস। লামিসা এন্টারপ্রাইজের মালিক কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক সীমান্ত তালুকদার, পোর্ট হারবার ইন্টারন্যাশনালের মালিক চট্টগ্রামের এমএইএস কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক জিএস আরশেদুল আলম বাচ্চু। এস ট্রেডিংয়ের মালিক চট্টগ্রামের পাঠানটুলি ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য মোহাম্মদ জাবেদ।
মেসার্স তাইফুল এন্টারপ্রাইজ চট্টগ্রামের এক এমপির সুপারিশে লাইসেন্সের মালিক হয়েছেন। কিউএনএস গ্লোবাল লজিস্টিকের মালিক বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোট অ্যাসোসিয়েশনের (বিকডা) সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান। কেয়ার শিপিং অ্যান্ড ফ্রেইটের মালিক দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক শাহজাদা মহিউদ্দিন। জিডি হারবার সার্ভিসেস লিমিটেডের মালিক চট্টগ্রামের বন্দর-পতেঙ্গা আসনের এমপি এমএ লতিফ ও তার ছেলে।
এবি করপোরেশন লাইসেন্স পেয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার সুপারিশে। তার বাড়ি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায়। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেএ নেতা ব্যবসায়িক অংশীদারত্ব রয়েছে। এসএস কনসাল্টিং লিমিটেডের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন সরকারদলীয় এক নেতা।
চট্টগ্রাম বন্দরের বিদায়ি চেয়ারম্যানের ঘনিষ্ঠজনও লাইসেন্স পেয়েছেন। লাইসেন্স পাওয়া গফুর ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানির মালিক মোস্তফা জেহসান ভুট্টু এবং মা ট্রেডিংয়ের মালিক সরওয়ার এহসান জিয়া। অর্থাৎ দুই ভাই দু’টি লাইসেন্স পেয়েছেন।
এসব লাইসেন্স বাতিলের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আকুল আবেদন জানানো হয়েছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে ‘নীরব প্রতিবাদ’ শিরোনামে গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। এর আগে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন ও মানববন্ধন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েও ‘চাপের মুখে’ পিছু হটেছেন বলে জানান সংশ্লিষ্টরা ।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন এর চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ২৩টি লাইসেন্স স্বচ্ছতার মাধ্যমে দেওয়া হয়নি। এখানে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। তা না হলে সরকারি দলের এমপি-মন্ত্রী পরিবারের সদস্য বা সরকারি দলের নেতারা কেন কেবল লাইসেন্স পাবেন। বন্দরের মতো জাতীয় স্বার্থ জড়িত প্রতিষ্ঠানে এমন অনিয়ম-দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়া সমীচীন নয়। যতটুকু জানি লাইসেন্স দেওয়ার কোনো আবেদন আহ্বান করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। নিয়মের ব্যত্যয় হলে দায় অবশ্যই বন্দরের।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহাফুজুল হক শাহ বলেন, প্রতিযোগিতা হলে পণ্য খালাস দ্রুত হবে পাশাপশি অপারেটর নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা ফিরিয়ে আনা দরকার ।এদিকে চট্টগ্রাম বন্দর কতৃপক্ষেরে সচিব মোঃ ওমর ফারুক দাবী করেন নতুন অপারেটর নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন ধরনের অনিয়ম হয়নি। তিনি আশা করেন অপারেটর বাড়লে প্রতিযোগিতা বাড়বে।
২০১৮ সালে বন্দরে ডক ব্যবস্হাপনা বোর্ড বাতিল করে বার্থ অপারেটর প্রথা চালু করা হয়। স্বচ্ছ দরপত্রের মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগ করা হলে অভিজ্ঞতার অভাবে নতুন নিয়োগ পাওয়া অনেকে লাইসেন্স পাবে না বিধায় অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।